ক্ষমতা মাত্রই দুর্নীতি’ ঠিক ১২৮ বছর আগে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এই উক্তিটি করেছিলেন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ লর্ড অ্যাক্টন। তিনি উক্তিটা পূর্ণ করতে যোগ করেছিলেন, এবং ক্ষমতার মাত্রা যত বেশি, দুর্নীতিপ্রবণতাও তত বেশি হয়। দুর্নীতি যেহেতু ধ্বংসের কারণ, তাই ক্ষমতা স্বভাবতই ক্ষণস্থায়ী হয়।
হ্যাঁ, ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী। অনেকটা খবরের মতো ক্ষণস্থায়ী। নুতন খবরের ভিড়ে পুরনো খবরটা যেমন গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে, তেমনি ক্ষমতাও। যে খবরটা একটু আগেও বক্স স্টোরি হয়েছিল, সেটাও নুতন আরেকটা তাজা খবরের ভিড়ে কোন তলানিতে গিয়ে যে ঠেকল, তার খেয়াল কে-বা রাখে।
ক্ষমতাও তেমনি ক্ষণস্থায়ী। এই একজনের হাতে আছে তো পরক্ষণেই (ক্ষেত্রবিশেষে এই ক্ষণ হবে দিন, মাস বা বছর) অন্যের হাতে। বালিশ খেলায় একটা বালিশ যেমন ঘড়ির কাঁটার মতো করে ঘুরতে থাকে সবার হাতে হাতে, ক্ষমতাও তেমনি এর হাত থেকে ওর হাতে গিয়ে পড়ে।
ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী হয় কেন?
খুঁজলে কারণটা মিলবে লর্ড অ্যাক্টনের ওই কথায়। ১৮৮৭ সালে তিনি তার ভাষায় বলেছিলেন, ‘পাওয়ার টেন্ডস টু করাপ্ট। অ্যাবসোলিউট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসোলিউটলি।’
ক্ষমতা হাতে পেলে যে কেউ নাকি তার অপব্যবহারটাই বেশি করে থাকেন। ফলে তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত হন, অসাধুতার আশ্রয় নেন এবং ক্রমেই কুচক্রী হয়ে ওঠেন। ফলে একটা ব্যবস্থা তখন ধ্বংস হয়ে যায়। এবং অ্যাক্টন বলছেন, কারো হাতে ক্ষমতা যত বেশি হবে, তার মাধ্যমে ওই ব্যবস্থার (প্রতিষ্ঠান/সংগঠন/প্রক্রিয়া) প্রলয় তত ঘনিয়ে আসবে।
লর্ড অ্যাক্টনের এই চিন্তন এই দর্শন, মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণায় দারুণভাবে কাজে লেগেছে। বিশেষত ১৯৭১ সালে লর্ড অ্যাক্টনের এই ‘ক্ষমতা-বাণী’ নিয়েই বিশ্বখ্যাত এক গবেষণা করা হয়েছিল, যার নাম ছিল ‘স্ট্যানফোর্ড প্রিজন এক্সপেরিমেন্ট’।
ক্ষমতা কেন ধ্বংস ডেকে আনে, এর বৈজ্ঞানিক কারণটি অনুসন্ধানের আগে আমরা স্ট্যানফোর্ডের কারাগার পরীক্ষণ নিয়ে একটু আলোকপাত করব।
এই পরীক্ষাটি করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৭১ সালের ১৪-২০ আগস্ট। গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ফিলিপ জিমবার্ডো। এই গবেষণায় উৎসাহ দেখিয়েছিল মার্কিন নৌবাহিনী ও মেরিন কর্পস। কারারক্ষীদের সঙ্গে কারাবন্দীদের সংঘর্ষের কারণ (কজ অব কনফ্লিক্ট) সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জানতে উদগ্রীব ছিলেন তারা। বলা বাহুল্য, মনোবিজ্ঞানী জিমবার্ডো ও তার দল দেখতে চেয়েছিলেন, ক্ষমতা মানুষের মনে কী প্রভাব ফেলে।
২৪ জন ছাত্রকে বেছে নেওয়া হয়েছিল পরীক্ষার জন্য। তাদেরকে কাল্পনিক কারাবন্দী ও কাররক্ষী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হলো। গবেষণার জন্য বিভাগীয় ভবনেই একটা কারাগার কল্পনা করা হলো। ১৪ দিনের একটা সময়সীমা নির্ধারণ করা হলো। গবেষণায় যেসব ছাত্র অংশ নিয়েছিলেন, তারা যে যার চরিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করলেন।
দেখা গেল, কারারক্ষীর চরিত্রে অভিনয় করা ছাত্ররা কারবন্দী ছাত্রদের ওপর মানসিক নির্যাতন শুরু করলেন।
বিস্ময়কর হলেও সত্য, কোনো কোনো কারাবন্দী এই মানসিক নির্যাতনকে পাত্তা দিয়ে প্রায় অসুস্থও হয়ে পড়লেন। এবং আরও বিস্ময়কর, কারারক্ষীদের পরামর্শে তারা আবার অন্য কারাবন্দী ছাত্রদের মানসিক নির্যাতন করা শুরু করলেন।
এটা অধ্যাপক জিমবার্ডোকেও প্রভাবিত করেছিল, তিনি এই নির্যাতনকাণ্ড চলতে দিলেন বিনা বাধায়। পরিস্থিতি এমন হলো, দুদিন যেতে না যেতেই দুই ছাত্র পরীক্ষা থেকে অব্যাহতি চাইলেন। শুধু তাই নয়, কারারক্ষীদের ওপর কারাবন্দীদের মানসিক নির্যাতনের মাত্রা এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, ওই পরীক্ষা ছয় দিনের মাথায় গিয়ে বন্ধ হয়ে গেল!
কারারক্ষীর সঙ্গে কারাবন্দীর সংঘর্ষের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারে স্ট্যানফোর্ড প্রিজন এক্সপেরিমেন্ট (১৯৭১)
ক্ষমতা এমনই; এভাবেই সে ধ্বংস ডেকে আনে। কিন্তু কেন আমরা ক্ষমতা পেলে ‘বাহাদুরি আর জারিজুরি’ শুরু করি, দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ি, জাল বুনি কুচক্রের?
উত্তর খুঁজেছিলেন কানাডার এক দল গবেষক। এদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অধ্যাপক ক্যাথেরিন এ ডিসেলেস। ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টোর ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক।
গবেষণায় প্রাপ্তবয়স্ক ১৭৩ কর্মজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ১০২ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন। ন্যায়নীতি, যত্নআত্তি, মেজাজমর্জি, উদারতা ইত্যাদি বিষয় তাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা জানতে চাওয়া হলো। লিখিত উত্তরে কেউ কেউ সাধারণ একটা দিনের উদাহরণ টেনে এ সব গুণের মূল্যায়ন করলেন। কেউ কেউ লিখলেন, এগুলোই তাদের জীবনের আদর্শ। কেউ বা এমন ঘটনা উল্লেখ করলেন, যেখানে নিজেকে তিনি ‘ক্ষমতাধর’ হিসেবে অনুভব করেছিলেন।
এরপর তাদেরকে ল্যাবে ডেকে এনে আরেকটা পরীক্ষা করা হলো। মোট ৫০০ পয়েন্টের একটা পুলে শেয়ার নেওয়ার জন্য তাদের বলা হলো। বলা হলো শূন্য থেকে ১০— যে কোনো সংখ্যার পয়েন্ট নিতে। আর বলা হলো, যত বেশি পয়েন্ট নেবে ততই ১০০ ডলারের একটি লটারি জেতার সম্ভাবনা বাড়বে তাদের। কিন্তু সঙ্গে বলা হলো আরেকটি শর্ত—অনেক বেশি পয়েন্ট তুলে ফেললে তো পয়েন্টের বাক্সটাই আগেভাগে ফাঁকা হয়ে যাবে, তখন তাই লটারির ড্র এমনিতেই বাতিল ঘোষণা করা হবে।
দেখা গেল, যারা সাধারণ দিনের গল্প লিখেছিলেন, তারা গড়ে তুলেছেন সাড়ে ৬ পয়েন্ট করে। যারা খুব আদর্শিক, তারা তুলেছেন সাড়ে ৫ পয়েন্ট করে। আর যারা নিজেকে ‘ক্ষমতাধর’ বলে ভাবতে ভালোবাসেন, তারা তুলেছেন সাড়ে ৭ পয়েন্ট করে।
কী বুঝতে পারলেন ডিসেলেস ও তার দল?
যারা নৈতিকতাকে তেমন দাম দেন না, তারা যদি ক্ষমতা পান তাহলে, ব্যবস্থাটা (এখানে লটারি ড্র) নষ্ট হয়ে যাবে জেনেও তারা ক্ষমতা জাহির করে থাকেন।
লর্ড অ্যাক্টনের ‘ক্ষমতা-বাণী’কে খাঁটি প্রমাণ করতে এর চেয়ে বড় পরীক্ষা আর কী হতে পারে।
ডিসেলেসের ওই গবেষণার ফলাফল প্রবন্ধাকারে ছাপা হয়েছিল জার্নাল অব অ্যাপ্লাইড সাইকোলজিতে।
না, এখানে ক্ষমতার কোনো দোষ নেই। দোষ ক্ষমতা ধারণকারী ব্যক্তিটির। ক্ষমতা যদি ভালো মানুষের হাতে থাকে, তবে তারা নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জন দেবেন না। যেমনটা আমরা ডিসেলেসের গবেষণাতেও দেখতে পাই— যারা আদর্শিক, যারা নৈতিকতাকে মূল্য দেন, তারা ক্ষমতা পাওয়া সত্ত্বেও ব্যবস্থা (লটারির ড্র) টিকিয়ে রাখার জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করেন না।
তার মানে, ক্ষমতা তখনই বিপদ ডেকে আনে যখন এর ধারক হন কুচিন্তাশীল, কুচক্রী। ডিসেলেস মন্তব্য করেছেন, ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী জেনেই আদর্শিক নেতারা ন্যায়-নীতি আঁকড়ে থাকেন।
তথ্য ঋণ : স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন।