জুভেন্টাসের দুর্গ ভেঙে ট্রেবল বার্সার

SHARE

barca7ফুটবলে নিজেদের রক্ষণভাগ নিয়ে বেশ গর্ব ইতালিয়ানদের। নিশ্চিদ্র রক্ষণভাগ নিয়ে গর্ব ছিল ইতালি চ্যাম্পিয়ন জুভেন্টাসেরও। কিন্তু বার্লিনের মাঠে সেই গর্ব ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছে বার্সেলোনা। জুভেন্টাসকে হৃদয় ভাঙার গান শুনিয়ে উযেফা চ্যাম্পেয়ন্স লিগ ফুটবলের শিরোপা জিতে নিয়েছে স্পেন চ্যাম্পিয়নরা।

শনিবার রাতে উত্তেজনার বারুদে ঠাসা ফাইনালে জুভেন্টাসকে ৩-১ গোলে হারিয়েছে বার্সা; সঙ্গে ইতিহাসের প্রথম ক্লাব হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো জিতে নিয়েছে ট্রেবল। যে জয় এসেছে ইনিয়েস্তা-মেসি-পেড্রোর গড়ে দেওয়া মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে রেকিটিক-সুয়ারেজ-নেইমারের লক্ষ্যভেদী শটে।

ট্রেবল (এক মৌসুমে ৩ বড় আসরের শিরোপা) জেতার স্বাদ কেমন, ২০০৯ সালেই তা জানা হয়ে গিয়েছিল বার্সেলোনার। কিন্তু এই স্বাদ কখনোই পাওয়া হয়ে উঠে নি ইতালির বান্ধবী জুভেন্টাসের। এবারে সেই সুযোগ এসেছিল সাদা-কালো জার্সির দলটির সামনে।

ইতালির সবচেয়ে বড় ঘরোয়া লিগ আর কোপা ইতালিয়ার শিরোপা জেতা জুভেন্টাস প্রথম ট্রেবলের স্বাদ পেতে মরিয়া হয়ে খেলতে নেমেছিল বার্লিনের মাঠে। কিন্তু যে রক্ষণভাগ নিয়ে তাদের গর্ব, ম্যাচের ৪ মিনিটেই তাতে ফাটল ধরিয়েছে বার্সার আক্রমণ ভাগের সৈনিকেরা।

লিওনেল মেসির ঝলক দেখানো পাস থেকে বল গিয়েছে জোর্ডি আলবার কাছে। সেই বল নেইমারকে পাস করেছেন আলবা। নেইমার সুকৌশলে বল দিয়েছেন ম্যাচসেরার পুরস্কার জেতা আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাকে। বার্সার এই বিশ্বস্ত প্লেমেকার তা থেকে রচনা করেছেন ম্যাচের প্রথম গোলের চিত্রনাট্য। আর সেই চিত্রনাট্যকে বাস্তবে রুপ দিয়েছেন তরুণ ইভান রেকিটিক; বল তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন জুভেন্টাসের জালে।

এরপর বার্সেলোনার আক্রমণ আর জুভেন্টাসের কাউন্টার অ্যাটাকে ম্যাচ হয়ে উঠেছে শ্বাসরুদ্ধকর। প্রতিপক্ষের বুকে কাঁপন ধরানো আক্রমণ শানিয়েছে দুদলই। তবে আর কোনো গোলের দেখা না মিলায় প্রথমার্ধ শেষে ১-০ গোলেই এগিয়ে থেকেছে বার্সেলোনা।

বিরতির পর মেসির দুরুন্ত দৌড়ে শুরু হয়েছিল ম্যাচ। কিন্তু জুভেন্টাসের রক্ষণভাগের দৃঢ়তায় সুয়ারেজ বল নিয়ন্ত্রনে ব্যর্থ হলে সেখানেই পরিসমাপ্তি ঘটেছে ওই আক্রমণের। এরপর মেসি-সুয়ারেজ-নেইমার-রেকিটিকদের ভয়াবহ কিছু আক্রমণ সামলে দলের আশা বাঁচিয়ে রেখেছেন জুভেন্টাসের অভিজ্ঞ গোলরক্ষক বুফন।

এরপরই জুভেন্টাস যেন হয়ে উঠেছে ক্ষ্যাপা বাঘ। ওল্ড লেডি বা ‘বুড়ি’ বলে যাদের আরেকটি নাম রয়েছে, বিরতির পর সেই তারাই যেন ইয়ং লেডি বা অষ্টাদশী তরুণীর জীবনী শক্তিতে ভরপুর হয়ে উঠেছিল। এবারে সত্যিকার ভাবেই নিজেদের আরেকটি ডাক নাম ‘দ্য কিলার লেডি’র সার্থকতা প্রমাণ করতে শুরু করেছিল মাসিমিলিয়ানো আলেগ্রির শিষ্যরা।

বলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বার্সা তখন দুর্গ সামলাতে ব্যতিব্যস্ত। তবে জেরার্ড পিকে আর সঙ্গীদের প্রতিরোধ শেষ অব্দি ধোপে টিকে নি। ৫৫ মিনিটে আলভারো মোরাতার গোলে ১-১ সমতায় ফিরেছে জুভেন্টাস। ম্যাচের ৪ মিনিটেই চুপসে যাওয়া জুভে সমর্থকরা যেন তাতে প্রাণ ফিরে পেয়েছেন; তাদের উল্লাসে মুখরিত হয়েছে বার্লিনের অলিম্পিয়া স্টেডিয়াম।

কিন্তু সেই উল্লাস স্থায়িত্ব হয়েছে মাত্র ১৩ মিনিট। কেননা, ম্যাচের পরের গল্পটুকু কেবলই বার্সেলোনার বীরত্মগাঁথার।

এমএসএন, অর্থ্যাৎ কিনা মেসি-সুয়ারেজ-নেইমারে গড়া বার্সার আক্রমণ ভাগ কেন প্রতিপক্ষের হৃদকম্প বাড়িয়ে দেয়, ম্যাচের শেষ ৩৭ মিনিটে (ইনজুরি টাইম সহ) তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে জুভেন্টাস। এমএসএনে ভর করে একের পর এক আক্রমণ শানিয়ে ইতালি চ্যাম্পিয়নদের কোণঠাসা করে ফেলেছে স্পেন চ্যাম্পিয়নরা।

ম্যাচে গোল না পেলেও ফুটবল জাদু কম দেখাননি অনেকের দৃষ্টিতে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে বিবেচিত লিওনেল মেসি। ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট এনে দিয়েছেন তিনিই। ৬৭ মিনিটে পেনাল্টির আবেদন করেছিলেন জুভেন্টাসের ফরাসি ফুটবলার পল পগবা। রেফারি তা আমলে নেননি। আর মেসিও যেন তাতে বিরক্ত হয়েছেন! হয়তো পগবাকে শিক্ষা দিতে গিয়েই ৬৮ মিনিটে জুভেন্টাসের জালে বার্সার দ্বিতীয় গোলের স্ক্রিপ্টটা লিখে ফেললেন তিনি।

জুভেন্টাসের ৩ জন ডিফেন্ডারকে বোকা বানিয়ে মেসি নিয়েছিলেন এক দুরন্ত শট। অভিজ্ঞ বুফন কোনো রকম ঝাঁপিয়ে পরে সেই বল ঠেকিয়েছেন জালে জড়ানোর হাত থেকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়েছে কি? না, রক্ষা পায়নি জুভেন্টাস। মেসির তীব্র শট বুফনের পাঞ্চ খেয়ে জুভেন্টাসের ছোট ডি বক্সের যেখানে পড়েছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন লুই সুয়ারেজ আর রেকিটিক।

রেকিটিক যখন বলে শট নিতে যাচ্ছেন ঠিক সেই মুহূর্তে অদম্য গতিতে বলকে জুভেন্টাসের জালে পাঠিয়ে দিয়েছেন সুয়ারেজ। এগিয়ে যাওয়ার আনন্দে কাতালান উৎসবের ঢেউ বয়ে গেছে অলিম্পিয়া স্টেডিয়ামে।

এরপর ৭২ মিনিটে আরেকাবার তেমন উৎসবের ঢেউ উঠেও্ তা মিলিয়ে গেছে সঙ্গে সঙ্গেই। কারণ, হ্যান্ডবলের কারণ দেখিয়ে নেইমারের একটি গোল বাতিল করেছেন রেফারি। জোর্ডি আলবার ক্রস থেকে হেড করে বল জালে জড়িয়েছেন নেইমার। কিন্তু হেড করার সময় বল তার হাতেও লেগেছিল!

এরপর জুভেন্টাসকে আরও বেশি চেপে ধরতে বার্সার রক্ষণভাগের খেলোয়াড়রাও যোগ দিয়েছেন এমএসএনর সঙ্গে। তার সুফল হিসেবে জেরার্ড পিকে একটি গোল পাচ্ছেন, পাচ্ছেন করেও শেষ অব্দি পাননি। বল বারের উপর দিয়ে মেরেছেন তিনি।

মাঠের পাশে রাখা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপাটি তখন জ্বল জ্বল করছে তাকে জিতে নেওয়ার প্রলোভন সাজিয়ে। সেই প্রলোভনেই হয়তোবা ম্যাচের ৮৯ মিনিটে আশা বাঁচিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেছেন জুভেন্টাসের মার্চিসিও। কিন্তু বার্সার জার্মান গোলরক্ষক টার স্টেগানকে তাকে উপহার দিয়েছেন হতাশা।

ম্যাচে ৭ মিনিট অতিরিক্ত সময় যোগ করা হয়েছে। সেই সুযোগে ৯২তম মিনিটে জুভেন্টাসের আর্জেন্টাইন তারকা কার্লোস তেভেজও বার্সার জাল লক্ষ্য করে শট নিয়েছেন নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে। কিন্তু এবারও টার স্টেগানের বিশ্বস্ত হাত বাঁচিয়ে দিয়েছে স্প্যানিশ চ্যাম্পিয়নদের। তবে হাল ছাড়ে নি জুভেন্টাস।

ম্যাচে ফেরার প্রাণপণ লড়াই চালিয়েছে আলেগ্রির শিষ্যরা। কিন্তু ৯৭তম মিনিটে ম্যাচের ব্যালন্স শিটে ডেবিট-ক্রেডিটের হিসেব মিলিয়ে দিয়েছেন নেইমার; দুরন্ত এক গোলে। আর তাতেই বেজেছে শেষ বাঁশি; বার্সা করেছে ট্রেবল জয়ের উৎসব।

স্প্যানিশ লিগ আর কোপা দেল রে ফুটবলের শিরোপা জেতার পর চলতি মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জিতে বার্সা বনে গেছে ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন।