রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সাবেক ছাত্রী সৈয়দা সাবেকুন নাহার নিগার (৩৫) হত্যার ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শুক্রবার পটুয়াখালীর বাউফল থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তারা হলো- সাজিদুল ইসলাম সজল, সোহাগ শরীফ, শাহ ইমাম হোসেন রনি ও সাকিব হাসান সিজার। মেধাবী ছাত্রের আড়ালে তারা আসলে ছদ্মবেশী ডাকাত। হত্যাকাণ্ডের পর স্বর্ণালঙ্কার লুট করার কথা স্বীকার করে সজল ও সোহাগ গতকাল আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে দিয়েছে হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা। নিগারকে হত্যা করে স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা লুটের ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী রনি ও সিজার। কিলিং মিশনে আটজন উপস্থিত ছিল। রনি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে আইনে স্নাতকোত্তর ও সিজার ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি থেকে টেক্সটাইলে পড়াশোনা করে।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানা গেছে, দুই বছর ধরে রনি ও সজলের নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধ অপহরণকারী চক্র গড়ে ওঠে। ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অপহরণের পর টাকা আদায়ের ঘটনায় তারা একাধিক সময় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে ছিল। জামিনে বেরিয়ে আবার তারা যাত্রাবাড়ীতে ভাড়াটিয়া সেজে গৃহকর্তার মেয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রীকে হত্যার পর স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা লুট করে।
গত ২২ মে উত্তর যাত্রাবাড়ীর রজনীগন্ধা সড়কের ৭৬/১/এল/১৩ নম্বর বাসার দোতলায় ডাকাতির ওই ঘটনা ঘটে। ডাকাতরা অস্ত্রের মুখে বাসিন্দাদের জিম্মি করে ওই বাসা থেকে ৮৫ হাজার টাকা, ৮ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, দুটি ল্যাপটপ কম্পিউটার, একটি আইপ্যাড, চারটি মোবাইল ফোনসহ দামি জিনিসপত্র নিয়ে যায়। চিৎকার করলে গৃহকর্তার অসুস্থ মেয়ে নিগারকে গলায় ওড়না ও টাই দিয়ে ফাঁস দেয়। এরপর তার শরীর কম্বলের নিচে চাপা দিয়ে রাখা হয়।
যাত্রাবাড়ী থানার ওসি অবণী শংকর কর বলেন, নিগারকে হত্যার পর স্বর্ণালঙ্কার লুটের ঘটনায় জড়িত চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের সহযোগী আরও চারজনকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। জামিনে বেরিয়ে রনি ও সিজার তাদের সহযোগীদের নিয়ে যাত্রাবাড়ীতে ভাড়াটিয়া সেজে একজনকে হত্যা করে মালপত্র লুট করে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা আরও কয়েকটি অপহরণ ও লুটপাটের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। রনি ও সিজার মেধাবী, এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যদের কথা জানলে অনেকের বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে- এই ধরনের অপরাধের সঙ্গে তারা জড়াতে পারে।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, রনি ও সিজারের নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধ চক্র রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভাড়াটিয়া সেজে ডাকাতি করে আসছে। মাস তিনেক আগে বরিশালের গৌরনদীতে এক কলেজ ছাত্রকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে একই চক্র। এ ছাড়া বছর খানেক আগে হাজারীবাগে অপহরণের পর রনি ও সিজার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে কিছুদিন কারাভোগ করে। কারাগার থেকে বেরিয়ে একজন চিকিৎসককে অপহরণ করে একই চক্রের সদস্যরা দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ নেয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিমল চন্দ্র দাস বলেন, এই চক্রটি এক এলাকায় বেশি দিন থাকে না। কয়েকটি ঘটনা ঘটানোর পর তারা বাসা পরিবর্তন করত। বেশিরভাগ সময় ভাড়া করা বাসায় অপহৃতদের অজ্ঞান করে তারা আটক রাখত।
পুলিশ জানায়, টার্গেট করে উত্তর যাত্রাবাড়ীর রজনীগন্ধা সড়কের ৭৬/১/এল/১৩ নম্বর বাসা ভাড়া করতে যায় সজল, সিজার ও রনির লোকজন। ১ জুন থেকে তারা ওই বাসার নিচতলা ভাড়া নেওয়ার কথা চূড়ান্ত করে। তারা তিন হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে যায়। ওই বাসার নিচতলা খালি থাকায় তারা ২২ মে থেকে সেখানে থাকার অনুমতি চায়। বাসার মালিক তাতে সাড়া দিলে ভাড়াটের আড়ালে ডাকাত চক্রের সদস্যরা বাসায় উঠে ডাকাতি করে। ঘটনার রাতে দোতলায় বাড়িওয়ালার ফ্ল্যাটে কৌশলে প্রবেশ করে তিনজন। বাইরে থেকে পাঁচজন পাহারা দিচ্ছিল। বাসার বাসিন্দাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তারা স্বর্ণালঙ্কার, টাকা ও অন্যান্য জিনিসপত্র লুট করে। এ সময় বাসায় ছিলেন গৃহকর্তা এস এম কামরুজ্জামান, তার স্ত্রী তহুরা খাতুন ও তাদের মেয়ে নিগার। ডাকাত চক্রের সদস্যরা নিগারকেও পাশের একটি ঘরে নিয়ে হাত-পা বেঁধে মুখে স্কচটেপ আটকে দেয়। নিগার ভয়ে চিৎকার করলে ডাকাতরা তার গলায় ওড়না ও টাই দিয়ে ফাঁস দিয়ে তার শরীর কম্বলে ঢেকে রাখে। পরে নিগারকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।