মালয়েশিয়ার ব্যাংকে টাকা রেখে দ্বিতীয় নিবাস গড়ার প্রকল্প ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোমে’ বাংলাদেশির সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়েছে। মালয়েশিয়া সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত মোট চার হাজার ১৩৫ জন বাংলাদেশি ওই প্রকল্পে অংশ নিয়েছেন। প্রকল্পে অংশ নেওয়ার জন্য নির্বাচিত হওয়া ব্যক্তির বয়স ৫০ বছরের কম হলে তাদের মালয়েশিয়ায় পৌঁছার পর ব্যাংকে তিন লাখ মালয়েশীয় রিঙ্গিতের (প্রায় ৬০ লাখ টাকা) স্থায়ী আমানতের হিসাব খুলতে হয়। অন্যদিকে ৫০ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী আবেদনকারীদের ক্ষেত্রে ব্যাংকে খুলতে হয় দেড় লাখ মালয়েশীয় রিঙ্গিত (প্রায় ৩০ লাখ টাকা) স্থায়ী আমানতের হিসাব।
বাংলাদেশিদের মধ্যে যারা এই সুযোগ নিয়েছে তাদের পরিচয় ও বয়স সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোমে’ অংশ নেওয়া সবার বয়স যদি ৫০ বছরের কম হয় তাহলে মালয়েশিয়ার ব্যাংকে তাদের টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত দুই হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। আর তাদের সবার বয়সই যদি ৫০ বছরের বেশি হয় তবে মালয়েশিয়ার ব্যাংকে তাদের জমা টাকার পরিমাণ হবে অন্তত এক হাজার ২৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
প্রকল্পের জন্য নির্বাচিত হওয়ার আগেই পর্যাপ্ত সম্পদ দেখানো, ফাইল প্রসেসিং ও সম্পদের পরিমাণ মূল্যায়নসহ বিভিন্ন খাতে আবেদনপত্রপ্রতি আরো কয়েক লাখ টাকা খরচ হয় বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা যায়, মালয়েশিয়ার ওই প্রকল্পে অংশ নিতে সব মিলিয়ে এক থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। বাংলাদেশ থেকে এই প্রকল্পে সুবিধা নেওয়ার জন্য যেকোনো ব্যক্তিকে যে অর্থমূল্য দিতে হয় বা বিনিয়োগ করতে হয় তার জন্য বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদিত কোনো পদ্ধতি নেই। কাজেই এ বিষয়টি আইনের লঙ্ঘন, ক্ষমতার অপব্যবহার ও মানি লন্ডারিং করে হচ্ছে। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া—দুই দেশই সন্দেহজনক ও অবৈধ লেনদেন মোকাবেলায় এগমন্ট গ্রুপের সদস্য হলেও এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা মিলছে না।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ মিশনের সাবেক এক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিক গত বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি যখন মালয়েশিয়ায় ছিলেন তখনো সেকেন্ড হোম প্রকল্প ছিল, কিন্তু বাংলাদেশির সংখ্যা এত বেশি ছিল না। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময় এ বিষয়ে জানতে চেয়েছে। কারো কারো মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম প্রকল্পের সুযোগ নিয়ে সেখানে বাড়ি কেনার খবর আলোচনায় এসেছে। কিন্তু মালয়েশিয়া এ বিষয়ে কোনো তথ্য দেয় না। তখন মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে ঢাকায় বলা হয়েছিল, মালয়েশিয়া সরকার বা হাইকমিশনের কাছে তালিকা না চেয়ে বরং এ দেশের ইমিগ্রেশন বিভাগের মাধ্যমে ওই ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা সম্ভব। কারণ মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোমে যারা অংশ নিয়েছে তাদের ভিসা অন্যান্য ক্যাটাগরির ভিসার চেয়ে আলাদা। সেটি ১০ বছর মেয়াদি ভিসা এবং সেকেন্ড হোমের কথা লেখা থাকে।
সাবেক ওই কূটনীতিক বলেন, তাঁরা ধারণা করতেন এবং এখনো মনে করেন যে যারা মালয়েশিয়ার ব্যাংকে টাকা রেখে সেকেন্ড হোমের সুযোগ নিচ্ছে তারা সেই টাকা বৈধভাবে নেয়নি। কারণ বৈধভাবে অর্থ নিলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানত। তা ছাড়া বাংলাদেশের আইনে এখান থেকে বাইরে জমি বা বাড়ি কেনা কিংবা বিনিয়োগ করা আইনত নিষিদ্ধ। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় যখন বাংলাদেশিরা কাজের জন্য যাচ্ছে তখন এ দেশেরই কিছু লোক মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে বিনিয়োগ করছে। ওই অর্থ এ দেশে কাজে লাগালে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হতো।
জানা গেছে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংস্থাগুলো মালয়েশিয়ায় সন্দেহভাজন অর্থপাচারকারী হিসেবে বেশ কয়েকজনকে চিহ্নিত করেছে। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের সদস্য ও কয়েকজন ভিআইপিও আছেন। এ বিষয়ে কাজ চলছে। তবে এর পরও মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমে বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ অব্যাহত রয়েছে। ওই প্রকল্পে শীর্ষ অংশগ্রহণকারীদের তালিকায় চীন ও জাপানের পরই বাংলাদেশের অবস্থান থাকায় এজেন্ট ও সাব-এজেন্টরা বাংলাদেশ থেকে সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারীদের খুঁজছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, সাধারণত বাংলাদেশ থেকে বাইরে টাকা পাঠানোর নিয়ম নেই। বৈধভাবে পাঠাতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতির প্রয়োজন হয়। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমতি দিচ্ছে কি না সে বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য নেই। দিলেও হয়তো সংখ্যাটা এত বেশি হবে না। তিনি বলেন, ‘বিদেশে অনেক বাংলাদেশি থাকে। তাদের টাকাও বিদেশে আছে। সেটি যদি তারা মালয়েশিয়ায় নিয়ে যায় সেটি বৈধ। কিন্তু তার পরও সংখ্যাটা এত বেশি হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ থাকবেই। আমি সেই সন্দেহ পোষণ করি।’
তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, এ বিষয়টাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি। কারা কিভাবে সেখানে বিনিয়োগ করছে বা পাঠাচ্ছে সেটি সরকারের জানার উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এর বেশ কিছু মাত্রা আছে। এটি মোটামুটি ওপেন সিক্রেট ও ব্যাপকভাবে আলোচিত। মালয়েশিয়ার ওই প্রকল্পে বাংলাদেশের যে অবস্থান তা আমাদের জন্য বেশ বিব্রতকর।’ তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে অর্থপাচার বিভিন্ন মাধ্যমে হতে পারে। ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে যেতে পারে কেউ কেউ। হুন্ডির মাধ্যমে হতে পারে অথবা ‘মিস ইনভয়েসের’ মাধ্যমে হতে পারে। কাজেই পুরো বিষয়গুলো অবারিতভাবে হচ্ছে। সরকারের দিক থেকে কোনো ধরনের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ আমরা দেখিনি। যে কারণে এটি ঘটেই চলেছে এবং এই প্রকল্পের গ্রাহক হিসেবে র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ শীর্ষ স্থান অধিকার করে চলেছে। এর মূল কারণটিই হলো যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের কোনো ধরনের প্রতিকূলতা বা জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হয় না।”
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরো বলেন, ‘যারা এ সুবিধা নিচ্ছে তারা কিভাবে কোন প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচার করছে ও সুবিধা নিচ্ছে সেগুলো সরকারের মাধ্যমেই শুধু জানা সম্ভব। এ কারণে সরকারের মাধ্যমেই তথ্যগুলো নেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। এরপর আমাদের দেশীয় আইন অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে। এ ক্ষেত্রে অবৈধ অর্থের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইনি যে কাঠামো আছে তা কাজে লাগিয়েও এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব।’