ধর্মীয় বিভক্তি থাকলে ভারত সফল হতে পারবে না বলে সতর্ক করে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিন দিনের সফরের শেষ দিনে গতকাল মঙ্গলবার নয়াদিলি্লর সিরি ফোর্ট প্রেক্ষাগৃহে তরুণ প্রজন্মের সামনে ভাষণে এ সতর্কবার্তা দেন তিনি। ওবামা বলেন, আমরা কেউ হিন্দু, কেউ মুসলিম, কেউ খ্রিস্টান, কেউ জৈন; কিন্তু কোনো ভয়-ভীতি ছাড়াই সবার নিজ নিজ ধর্ম পালন করার স্বাধীনতা থাকা উচিত। ওবামা ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ অংশীদারত্ব হবে বলেও জানান তিনি।
ওবামা বলেন, ‘ভারত তখনই সফল হবে, যখন দেশটি ধর্মের ভিত্তিতে খণ্ডিত চেতনা ধারণ করবে না। আমি যখন অ্যাথলেট মিলখা সিংয়ের শৌর্যে উৎসাহিত হই, কিংবা শাহরুখ খানের অভিনয়ে মুগ্ধ হই,সেটা ধর্মের কারণে হই না। আমাদের কত অস্ত্র আছে, সেটার ওপর আমাদের বিচার হবে না। বিচার হবে আমরা কতটা উদার। একে অন্যের ধর্মের প্রতি সহনশীল হতে না পারলে কখনও সামনে এগোনো যাবে না। উগ্র ধর্মান্ধতা মানুষকে নেহাত ছোট ও পশ্চাৎপদ করে ফেলে বলেও উল্লেখ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন অপরের ধর্মীয় বিশ্বাসকে সম্মান করাই প্রগতির প্রধান সোপান। ভারতের সংবিধানের কথা উল্লেখ করে ওবামা বলেন, সংবিধানের ২৫ ধারায় সেই স্বাধীনতা রয়েছে। এটা রক্ষা করা সরকার এবং নাগরিকদের সবার দায়িত্ব। মহাত্মা গান্ধীর উদ্ধৃতি দিয়ে ওবামা বলেন, এক একটি ধর্ম একই বৃক্ষের ভিন্ন ভিন্ন ফুল। এ সময় তিনি মার্টিন লুথার কিংয়ের আদর্শের কথা, মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতি ও স্বামী বিবেকানন্দের কথা উল্লেখ করেন।
সিরি ফোর্টে ওবামার দেওয়া এ ভাষণকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন কূটনীতিবিদরা। ভারতে সম্প্রতি ধর্মীয় প্রতিহিংসা ও গোঁড়ামি আগের চেয়ে ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। আগে সাম্প্রদায়িক হানাহানি এখন জোর করে সংখ্যালঘুদের ধর্মান্তরকরণ কর্মসূচিতে পরিণত করেছে উগ্রপন্থিরা। দিলি্লতে সম্প্রতি তিনটি গির্জা আক্রান্ত হয়েছে। ভেঙে দেওয়া হচ্ছে অন্য ধর্মের উপাসনালয়। এতে সরকারি দল বিজেপির নীরবতাকে অনেকেই রহস্যময় মনে করছেন। ওবামার ধর্ম নিয়ে এ বক্তব্যকে তাৎপর্যময় বলেই ভাবছে সচেতন মহল। তবে উগ্র ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তার এই সতর্কবার্তা ভারতের রাজনীতিতে নতুন করে বিতর্ক উসকে দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।কূটনৈতিক সম্পর্ক :কূটনৈতিক সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে ওবামা বলেন, ভারতের যোগ্য এবং সবচেয়ে ভালো সহযোগী হয়ে উঠতে পারে আমেরিকা। কারণ আমাদের দু’দেশের গণতন্ত্র পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো এবং বৃহৎ গণতন্ত্র। আমরা একসঙ্গে কাজ করলে গোটা বিশ্ব আরও নিরাপদ হয়ে উঠবে।এর পরেই তিনি নিরাপত্তা পরিষদে ভারতকে স্থায়ী সদস্য হিসেবে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন। তিনি দারিদ্র্য দূরীকরণে ভারতের প্রশংসা করে বলেন_ ‘যেভাবে কর্মসূচির মাধ্যমে ভারত দারিদ্র্য নির্মূলে কাজ করে যাচ্ছে, তা গোটা বিশ্বকে পথ দেখাতে পারে।’
নমস্তে… :দিলি্লর সিরি ফোর্ট অডিটোরিয়ামে হাজার দুয়েক দর্শক-শ্রোতাকে এভাবেই সম্ভাষণ করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। মঙ্গলবার সকালে অডিটোরিয়ামের মঞ্চে প্রায় দৌড়ে উঠে দর্শকদের দিকে ডান হাত তুলে সাদা স্ট্রাইপড শার্ট আর গাঢ় নীল রঙের সুট-টাই পরা ওবামা বললেন, ‘নমস্কার। অনেক ধন্যবাদ।’ প্রায় পঁয়ত্রিশ মিনিটের ভাষণ শেষ করে বললেন, ‘জয় হিন্দ।’স্বপ্ন দেখার কথা বললেন ওবামা :স্বপ্ন মানুষকে কোন স্তরে নিয়ে যেতে পারে ভাষণে সে কথাও বললেন ওবামা। বৈষম্যময় এই পৃথিবীতে একমাত্র স্বপ্নই মানুষকে উত্তরণের পথে নিয়ে যেতে পারে। বিষয়টির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ টানেন তিনি। বলেন, ‘ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে রাঁধুনির কাজ করতেন আমার দাদা। মিশেলের পরিবারও ছিল একসময় দাস।’ বললেন, ‘রাঁধুনির নাতি যদি প্রেসিডেন্ট হতে পারে, চা-ওয়ালা যদি প্রধানমন্ত্রী হন, তা হলে স্বপ্ন দেখতে দোষ কোথায়! প্রত্যেকেরই তা দেখার সুযোগ রয়েছে।’
আমেরিকা ভারতের বড় অংশীদার :যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সবচেয়ে বড় অংশীদার হয়ে উঠতে পারে। ভারতের গণতন্ত্র, সন্ত্রাসবিরোধী মনোভাব ও পদক্ষেপ, কারিগরি ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার সঙ্গে সুসম্পর্কের মেলবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রতিশ্রুতি জানিয়ে ওবামা এও বললেন, ভারতকে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে আরও কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা স্বাভাবিক অংশীদার নই, সবচেয়ে ভালো অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করতে পারি নিজেদের ও অন্যের কল্যাণের জন্য।’নারীশক্তির জয়ে মুগ্ধ ওবামা :ভারতে এসে নারীশক্তির জয় দেখে উচ্ছ্বসিত ওবামা। রাষ্ট্রপতি ভবনে তাকে গার্ড অব অনার দিয়েছিলেন ভারতের বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার পূজা ঠাকুর। এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমেরিকায় নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করতে এখনও কাজ চলছে। কিন্তু ভারতে মা এবং বউয়েরাই পরিবারকে বেঁধে রেখেছেন।’ভারতকে পাশে নিয়ে উন্নয়নের যে বার্তা ওবামা শুনিয়েছেন, তাতে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত দর্শক-শ্রোতারা। শেষ করার আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘ভারতবাসীর ওপর আমাদের অগাধ বিশ্বাস। ভারতের বন্ধু হিসেবে গর্ববোধ করি। সহযোগী হিসেবেও।’ এরপর ‘জয় হিন্দ’ বলে তার পঁয়ত্রিশ মিনিটের ভাষণ শেষ করেন।
শাহরুখের কথা বললেন ওবামা :ওবামা বক্তৃতায় বলিউড তারকা শাহরুখ খানের নাম বললেন। উদ্ধৃতি দিলেন তার ছবির সংলাপ থেকে। বললেন, ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ থেকে ‘সেনোরিটা…বড়ে বড়ে দেশঁ মেঁ অর্থাৎ তুমি জানো আমি কী বোঝাতে চেয়েছি’ এই সংলাপটিতে। এ সময় দর্শকের করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে অডিটোরিয়াম। দু’দেশের গুরুত্বপূর্ণর্ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নিজের দেশে শাহরুখ খান কতটা জনপ্রিয় সে কথাও তুলে ধরেন।ভারতে মেধাবীদের অভাব নেই উল্লেখ করে ওবামা বললেন, ‘ভারত মিলখা সিং, মেরি কম ও কৈলাশ সত্যার্থীর মতো প্রতিভাবানদের নিয়ে গর্ব করতে পারে।’সিরি ফোর্টে বক্তৃতা শেষে প্রেসিডেন্ট ওবামা মঙ্গলবার স্ত্রী মিশেলকে নিয়ে সৌদি আরবের উদেদশে দিলি্ল থেকে যাত্রা করেন।