হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের চাপা আতঙ্কে সিরাজ-রাজেনরা

SHARE

ভারতের লোকসভা নির্বাচন পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির আগ্রাসনে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে মুসলিমদের অনেকেই আতঙ্কে ভূগছেন। এই পরিস্থিতিতে তারা আবারও ভরসা রাখছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরেই। বহু রাজ্যে নরেন্দ্র মোদির ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ মডেল যে ভাবে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে কাজ করেছে, তা অন্তত পশ্চিমবঙ্গের শহুরে মুসলিমদের মনে দাগ কাটতে পারেনি। বরং ভরসার স্থল তৃণমূলের নানা ভুলত্রুটিও তারা ক্ষমা করতে ইচ্ছুক।

রাজাবাজারের বাসিন্দা ৩০ বছর বয়সী সাব্বির আহমেদ উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুরের বিখ্যাত কওমি মাদ্রাসা দারউল উলুম দেওবন্দে আরবি ভাষা নিয়ে গবেষণা করছেন। বাংলার সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে গেরুয়া উত্থানের ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। তবে তিনি মনে করেন, বিজেপির পথ সুগম করেছে তৃণমূলের রাজ্যকে বিরোধীশূন্য করার প্রবণতাই। কারণ, বিরোধীরা থাকাটা গণতন্ত্রে ‘সেফটি ভালভ’।

তার কথায়, ‘বাঙালির ইতিহাস নিয়ে আমার যতটুকু চর্চা, তাতে বাংলা ও বাঙালির মেধা-সংস্কৃতি বা বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের ইতিহাস উত্তর-মধ্য বা পশ্চিম ভারত থেকে খানিক আলাদা। আমরা সহজিয়া চিন্তার জমির মানুষ। ফলে ভোটব্যাঙ্কে ধর্মীয় মেরুকরণে গোঁড়া হিন্দুত্ব যদি এই মাটিতে শিকড় গাড়ে, তা শুধু ইতিহাসের ধারার পরিপন্থী নয়, তা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ঘটনা। মুসলিম হিসাবে বলব, এই মুহূর্তে আমাদের রক্ষাকবচ মমতা।’

পার্ক সার্কাসের বাসিন্দা সুফিয়ান আহমেদের মতে, রেড রোডে নামাজ, ইমামভাতা ইত্যাদি নিয়ে হিন্দুদের মধ্যে এমন একটা ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে মুসলিমদের খুব তোষণ করছেন মমতা। কিন্তু মুসলিমদের উন্নয়ন কি সত্যি কিছু হয়েছে? কয়জন মুসলিম ছেলে-মেয়ে চাকরি পেয়েছে? পিএসসির মতো জায়গায় দুর্নীতি হচ্ছে। মমতা এ সব দিকে নজর দিন।’ বিজেপির এই উত্থানের জন্য তিনি দোষ দিচ্ছে বামপন্থী দল সিপিএমকেও। তার প্রশ্ন, ‘তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ এত বড় দলটা গেল কোথায়?’

আমির আলি, ইমায়েত রহমান, মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন, মোহাম্মদ মায়েরুদ্দিন, সুজাস গুপ্তর বি কম পড়ছেন। কেউ পড়েন উমেশচন্দ্রে, কেউ বা ভবানীপুর এডুকেশন্যাল সোসাইটিতে। তাদের মতে, যুবাদের চিন্তা একটা ভদ্রস্থ চাকরি জোটানো। তাদের সেই স্বপ্ন যাতে সফল হয়, সেদিকেই সচেষ্ট হোক কেন্দ্র বা রাজ্যের সরকার। তারাও চিন্তিত হিন্দু বনাম মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের বিভাজনে। তারা তাদের বাপ-দাদাদের কাছেও শুনছেন, এমন ধারার ভোট পশ্চিমবঙ্গে কখনও হয়নি। তবে মমতা আবার ঘুরে দাঁড়াবেন, এমন বিশ্বাস তারা রাখেন। কারণ, মমতা তো অনেক ‘ভালো’ কাজ করেছেন। যেমন, স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে। তবে যুবকদের কর্মসংস্থানে আরও নজর দেওয়া দরকার।

সাবির মনে করেন, মা-মাটি-মানুষের জমিতে বিজেপির থাবা বসানোটা রাজ্যের মুসলিমদের মধ্যে এক বিপন্নতাবোধের সৃষ্টি করছে। রাজাবাজারে ফলের রস বিক্রেতা মুজফফ্‌র, বস্ত্র বিক্রেতা মহম্মদ ওয়াকিলেরও একই ধারণা। তারা রাজনীতির অত খুঁটিনাটি বোঝেন না। কিন্তু অস্তিত্বের সঙ্কট যে তারা বোধ করছেন, তা জানাতে দ্বিধা করেননি। তারা মনে করেন, মোদির রাজনীতি বিভাজনের অঙ্ক কষেই। বাংলার রাজনীতিতে ‘মমতার’ ছোঁয়াতেই স্বস্তি।

নাখোদা মসজিদের ইমাম সফিক কাজমি আবার মনে করেন, ইভিএমেই সব গণ্ডগোলের সৃষ্টি। গেরুয়া শিবিরের এই ‘যান্ত্রিক’ কারসাজিতে রাজ্যে মমতার আসন কমেছে। পার্ক সার্কাসের ফৈয়াজ আহমেদ অবশ্য এখনই আতঙ্কিত হওয়ার পক্ষপাতী নন। তার যুক্তি, ‘কোনো একটি দল কয়েকটি বেশি আসন পেলে মুসলিমদের সর্বনাশ হয়ে যাবে মনে করি না। নিজেদের ঘর নিজেরা সামলাও। মনে রাখবেন, গরিব হিন্দু-মুসলমান দুই দলকেই খেটে খেতে হবে।’

আলাপচারিতার এই পর্যায়ে প্রতিবেশী রাজেন গুপ্তকে ফৈয়াজ প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার কি মনে হয়, আমরা এ বার ঝগড়া শুরু করব?’ রাজেনের জবাব, ‘১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরের দাঙ্গায় আমার দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। এরাই হাতে হাত লাগিয়ে আবার দোকান চালু করে দিয়েছে। আমি ওকে বলি সালাম আলেকুম। ও বলে জয় শ্রীরাম।’