‘জীবন’ পেতে সীমান্ত পেরোল কিশোর, অতঃপর ওপারে…

SHARE

এই তো এপ্রিলেই মাকে ছেলেটা বলছিল যে, বৃষ্টির কোনো লক্ষণই নেই। বলছিলেন মা ট্রান্সিতো গুটেরেজ। ছেলে জুয়ান ডি লিওন গুটেরেজের বয়স সবে ১৬। গুয়েতেমালার একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট একটা গ্রামে বাস তাদের। বাতাসে ধুলো ওড়া রাস্তা ওখানে পৌঁছানোর একমাত্র উপায়। জুয়ান ভুল বলেনি, ভাবলেন মা। গত দুই বছরে অনাকাঙ্ক্ষিত খরায় সব ফসল নষ্ট হয়। এ বছরও তেমনটাই যাবে বলে মনে হচ্ছে। কাজেই আরেকটা বাজে বছরের শঙ্কার ছাপ পরিবারের সবার চোখে-মুখে। জুয়ানের কৈশোর মনটা স্পষ্ট দেখতে পেলো, এই পরিবার কেবল কৃষির ওপর ভর করে আর বেঁচে থাকতে পারবে না।

টাইমের কাছে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন মা ট্রান্সিতো গুটেরেজ। বলছিলেন, ছেলেটা বলেছিল যে সে এই এলাকা থেকে চলে যেতে চায়। তার ছোট সন্তানটা শিশুসুলভ বিস্ময় নিয়ে বাড়ির ভেতরে আর বাইরে যাওয়া আসা করে। বাড়িটাও একেবারে ছোট। চার দেয়ালের ওপর টিনের চাল। হন্ডুরাসের এই শুকনো অংশের শিশুরা পুষ্টিহীনতায় ভোগে। তাদের এই সমাজটা মূলত আদিবাসী মায়ান চোর্তিদের নিয়ে গড়ে উঠেছে। তাদের বিস্তৃতি হন্ডুরাস, এল সালভাদোর এবং নিকারাগুয়ার উষ্ণ এলাকায় বেঁচে আছে দেড় কোটির মতো মানুষ।

জুয়ান তার বাসার সাথে ক্ষেতেই বেশি সময়টা কাটাতো। ক্ষেতের যে অংশটা সবচেয়ে কম শুকনো সেখানে ফলানো হতো ভুট্টা, মরটশুঁটি এবং কফি। বছর শেষে পড়াশোনাটা নিয়মিত রাখতে নতুন শ্রেণীতে ভর্তি জন্যে বাবা-মায়ের কাছে ১৩০ ডলারের বায়না করতো সে। যদিও গেলো বসন্তে জুয়ানের মনে নতুন ইচ্ছে জাগে। সে আমেরিকার মিয়ামিতে বসবাসরত তার বড় ভাইয়ের কাছে চলে যেতে চাইতো। বড় ভাই ২০১১ সাল থেকে ওখানে কাজ করেন এবং থাকেন। জুয়ানের ইচ্ছাটা ক্রমেই তীব্র হলো। মা বোঝাতে চাইতেন। কিন্তু শুনলো না জুয়ান। এপ্রিলের ৪ তারিখে এক বন্ধুকে নিয়ে ঘর ছাড়লো জুয়ান। তাদের সঙ্গী হলো একা কয়োটি, রাস্তা চেনানোর জন্যে।

১৫ দিন পর, আমেরিকা-মেক্সিকোর সীমান্ত পার হওয়ার পর এই কিশোরকে মার্কিন বর্ডার প্যাট্রল ধরে এল পাসোর কাছে। এ তথ্য জনায় গুয়াতেমালার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাকে রাখা হয় একটি সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়ে জুয়ান। পরে ওই আশ্রয়কেন্দ্রে কর্মরত চিকিৎসক তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে পাঠান। এপি জানায়, তাকে একদিন পর ছেড়ে দেয়া হলেও আবারো একদিন বাদেই ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসকরা তার মস্তিষ্কে পটির পাফি টিউমার চিহ্নিত করেন। চিকিৎসা নেয়া হয়নি এমন সাইনাস সংক্রমণ কিংবা মস্তিষ্কে ট্রমার থেকে ক্রমেই এমনটা হতে পারে। তবে জুয়ানের এমন সংক্রমণ কীভাবে হয়েছিল তা জানতে পারেননি ডাক্তাররা। চেষ্টা চালিয়েছেন তারা। কিন্তু ৩০ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করে জুয়ান।

বাবা তানেরজো ডি লিওন বলেন, ‘সে জীবন খুঁজতে গিয়েছিল, কিন্তু পেলো মৃত্যু’।

জুয়ান গুয়েতেমালার সংখ্যালঘুদের মধ্যে তৃতীয়জন যে কিনা গত ছয় মাসের মধ্যে আমেরিকার হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারা গেলো। গত ডিসেম্বরে ৭ বছর বয়সী জ্যাকেলিক কাল মাকুইন সীমান্ত পার হওয়ার সময় নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণে মারা যায়। দুই সপ্তাহ বাদেই ফ্লুতে মারা যায় ৮ বছরের ফেলিপ গোমেজ আলোঞ্জো। তাকে আটক করে একটি বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়েছিল। এদের মৃত্যু আমেরিকার হেফাজতে থাকা মানুষদের চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাছাড়া যেখানে তাদের রাখা হয় সেখানকার পরিবেশ নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে। কাল মাকুইন এবং গোমেজ আলোঞ্জোর মৃত্যুর পর আমেরিকার কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশন অবৈধভাবে সীমান্ত পার হয়ে আসা মানুষদের স্বাস্থ্যপরীক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে। তবে ট্রাম্প প্রশাসন ক্রমাগতভাবে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্টকে (আইসিই) আরো কঠোর করে তুলছে।

এসব মৃত্যু গুয়েতেমালানদের দেশ ত্যাগের কারণ এবং কীভাবে তাদের নিজ দেশেই থাকার উৎসাহ দেয়া যায় সে প্রশ্নও তুলেছে। ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিলের মধ্যে আমেরিকার দক্ষিণের সীমান্ত থেকে এক লাখ ৬৫ হাজার গুয়েতেমালানকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ সংখ্যা অকল্পনীয় এবং তা দেশের মোট জনসংখ্যা এক শতাংশের সমান। আমেরিকায় অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে যারা ধরা খাচ্ছেন, তাদের মধ্যে সবার থেকে এগিয়ে গুয়েতেমালানরা। এদের সংখ্যা ম্যাক্সিকানদেরও ছাড়িয়ে গেছে। অথচ মেক্সিকোর জনসংখ্যা গুয়েতেমালার চেয়ে ৭ গুন বেশি।

জুয়ানের মতো কিশোর কিংবা বাচ্চাসহ বড়দের দেশ ছাড়ার পেছনে অনেক কারণ আছে। দারিদ্রতা, দুর্নীতি, সহিংসতা, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং অর্থনৈতিক দুরাবস্থা সবকিছুই এর পেছনে দায়ী।

ড্রাই করিডরে জলবায়ুর পরিবর্তনও মানুষকে অন্য কোথাও চলে যেতে বাধ্য করবে। বিশ্ব ব্যাংক জানায়, ২০৫০ সালের মধ্যে কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ল্যাটিন আমেরিকা, সাব-সাহারিয়ান আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ১৪০ মিলিয়ন মানুষ বাঁচার জন্যে অন্যত্র ছুটবে। তখন জুয়ানের ভাগ্য যা ঘটেছিল তা অনেকের কপালেই জুটবে। তখন হাজারো জুয়ানের কাহিনিতে হারিয়ে ডি লিওন জুয়ানের গল্পটা, যে জীবন খুঁজতে গিয়ে পেলো মৃত্যু।

জুয়ানের মৃত্যুর খবর ছড়ালে কম বয়সীদের মনে কিছুটা ভয় ঢুকেছে। তারা ভাবছে এভাবে অবৈধ উপায়ে মাইগ্রেশন না করাই ভালো। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব শুকনো অঞ্চলের মানুষকে অন্যত্র চলে যেতেই হবে।

গুতেরেজের মতে, আমাদের স্থানান্তরিত হওয়া জরুরি। তিনি মাইগ্রশনকে আম গাছের সাথে তুলনা করেন। বলেন, একটা আম পড়ে গেলে বাকিগুলোও পড়তে থাকে। কম বয়সী কেউ একবার চলে গেলে অন্যরাও তাকে অনুসরণ করতে চায়। আমি প্রার্থনা করি, আমার ছেলের কপালে যা ঘটেছে তা যেন অন্য জীবনে না ঘটে।
সূত্র: টাইম