সভ্যতার জিজ্ঞাসা : সারা দুনিয়ায় আগুন জ্বেলে মানুষ তুমি যাচ্ছো কই?

SHARE

আবারো নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে ফিরে না গিয়ে উপায় নেই। ১৫ মার্চ শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থী ব্রেন্টন ট্যারেন্ট দু’টি মসজিদে হামলা চালায়, ঝরে যায় ৫০ তাজা প্রাণ। উপাসনালয় রক্তাক্ত হওয়ায় ঘটনা অবশ্য এটাই প্রথম নয়, এর আগে বহুবার রক্তাক্ত হয়েছে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও সিনাগগ।

ক্রাইস্টচার্চের মসজিদের রক্তের দাগ না শুকাতেই ৩৫ দিনের মাথায় রক্তাক্ত হয় শ্রীলঙ্কার কলম্বো, নেগম্বোসহ বেশ কয়েকটি এলাকা। প্রথম ধাপে ছয়টি ধারাবাহিক বিস্ফোরণে ঝলসে যায় তিনটি গির্জা আর তিন অভিজাত হোটেল। এরপর থেমে থেমে আরো কয়েকটি বিস্ফোরণ। সবমিলিয়ে নিহতের সংখ্যা কমবেশি ২৫৩ জন। নিহতদের অধিকাংশ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। তবে মুসলিম, হিন্দু ও বৌদ্ধ সবাই আছেন নিহতের তালিকায়।

২১ এপ্রিলের শ্রীলঙ্কা হামলার রেশ না কাটতেই বাংলাদেশ সময় ২৮ এপ্রিল রবিবার, হামলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার একটি সিনাগগে। একজন নিহত, আহত আরো কয়েকজন। হামলকারী তরুণ, বয়স ২০ এর কম। স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, ইহুদি বিদ্বেষ থেকেই এই হামলা চালানো হয়েছে। এর মাত্র ছয় মাস আগে হামলা হয়েছিল একই দেশের পেনসিলভানিয়া রাজ্যের পিটার্সবুর্গ শহরের একটি সিনাগগে। ঝরেছিল ১১ তাজা প্রাণ। সেই হামলার পেছনেও কারণ একটাই, ঘৃণা। ২৮ এপ্রিলের হামলার রেশ না কাটতেই ২৯ এপ্রিল খবর এল, যুক্তরাষ্ট্রে সিনাগগের পর এবার গির্জা আক্রান্ত। মেরিল্যান্ড রাজ্যের বাল্টিমোর শহরের একটি গির্জায় গোলাগুলি, বেশ কয়েকজন হতাহত।

সবগুলো ঘটনা বুকে মোচড় দিয়ে ওঠার মতো। এক সময় হামলা থেকে বাঁচতে মানুষ উপাসনালয়ে আশ্রয় নিত। যত শত্রুই হোক উপাসনালয়ে আশ্রয় নেয়া মানুষের গায়ে কেউ হাত তুলতো না। যে সময়কে আমরা খুব সহজেই অসভ্য সময় বলে চালিয়ে দেই।

এখনো মানুষ উপাসনালয়ে যায় শান্তির খোঁজে, স্রষ্টার সন্ধানে; ইহকাল-পরকাল দুই কালেই অবারিত শান্তি পাবার আশায়। উপাসনালয় মানুষের অন্যতম মানসিক আশ্রয়ের জায়গা। নানা কারণে হতাশ মানুষ, উপরওয়ালার কাছে হাত পেতে সাহায্য চায়। সেই খানেও এই সভ্য সময়ে মানুষ নিরাপদ নয়! সভ্যতার ধারক বাহকেরা কারণে অকারণে নানা ছলছুতোয় হামলে পড়ে উপাসনালয়গুলোর ওপর। কখনো গুলি, কখনো বোমা। পুড়ে যায়, ঝলসে যায় প্রার্থণারত সাধারণ মানুষ।

আবার অনেকে তো এই উপাসনালয়গুলোকেই লাগায় ঘৃণা ছড়ানোর কাজে। উপাসনালয়ে হামলা কিংবা উপাসনালয় থেকে হামলা, সবগুলোর জন্যই সমহারে দায়ী ঘৃণা। আর এই ঘৃণা ছড়ায় কারা? ঘৃণা ছড়ায় রাষ্ট্র, ঘৃণার কলকাঠি ক্ষমতাবানদের হাতে। অপরায়ণ তত্ত্বের মাধ্যমে তারা বুনে দেয় এই ঘৃণার বীজ। ক্রাইস্টচার্চের হামলাকারীকে শেখানো হয়েছে, তুমি শ্বেতাঙ্গ, তুমি খ্রিস্টান, তুমি স্থানীয়। ব্যস এই কয়টা বাণী শোনার পর, বিপরীতে দাঁড়িয়ে গেছে কয়েকটা বিষয়। প্রথমত শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গ এক নয় বরং একে অপরের শত্রু, প্রতিপক্ষ। বাটে পেলে এদের খুনও করা যায়। দ্বিতীয়ত খ্রিস্টান মানেই বর্তমান বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামোয় প্রধান এনিমির নাম মুসলিম। আর স্থানীয় হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া মানে অভিবাসীরা তোমার কেউ নয়, ওরা নিকৃষ্ট; সব ঝামেলার মূল।

অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা হামলার সন্দেহভাজন মূল হোতা জাহরান হাশিমকেও হয়তো বোঝানো হয়েছে তুমি মুসলিম। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব ঠিকই কিন্তু … কিন্তুটা কী? কিন্তুটা হলো মানুষের মধ্যে সেরা হলো মুসলিম। ব্যস হয়ে গেল! জাহরানের সামনেও একটা বাইনারি অপজিশন দাঁড়িয়ে গেল। মুসলিম বাদ দিয়ে সবাইকে তার শত্রু মনে হতে লাগল। বড় হতে হতে জাহরান আরো জেনে গেল, সব মুসলিমরাই আবার শ্রেষ্ঠ নয়! শ্রেষ্ঠ কেবল সুন্নিরা। তাই তো জাহরান ঘোষণা করলে, সুফিপন্থী মুসলিমরা মুসলিম তো নয়ই স্রেফ কাফের! এদেরকে কতল করা জায়েজ এবং কতল করা-ই উচিৎ। ঘোষণা দিয়েই থামল না, তার মদদে প্রথম যে হামলাটা হলো, তার শিকার হলো সুফিবাদে বিশ্বাসী উদারপন্থী মুসলিমরা। এর পরের ধাক্কাটা লাগল বৌদ্ধদের গায়ে। বেশ কিছু বৌদ্ধ মূর্তি ভাঙায় জড়িত থাকার অভিযোগ আছে জাহরানের বিরুদ্ধে।

এরকম ছোটো ছোটো কাজের মধ্য দিয়ে পিঁপড়ে থেকে কেউটে হয়ে ওঠে হাফেজে কোরআন জাহরান। নজর কাড়ে অনেকের। যার চূড়ান্ত ফল ইস্টার সানডেতে ঝলসে যাওয়া আড়াইশ তাজা প্রাণ। ২৮ এপ্রিল ক্যালিফোর্নিয়ার সিনাগগে হামলা চালানো তরুণ আর্নেস্টের গল্পটাও হয়তো এমন। তাকেও হয়তো কেউ বুঝিয়েছে ইহুদিরা খুব খারাপ। এদের বাঁচার কোনো অধিকারই নেই। এরা জেরুজালেমে খ্রিস্টানদের পবিত্র ভূমি বায়তুল মোকাদ্দাস দখল করছে, অত্যাচার করছে খ্রিস্টানদের। আবার ইহুদি সন্তানরাও বেড়ে উঠছে এক বিদ্বেষ নিয়ে। তাদের কাছে মুসলিম মানে গ্রেট এনিমি, আর খ্রিস্টান মানেও এনিমি। তবে প্রয়োজনে কখনো সখনো বন্ধু হলে হতেও পারে খ্রিস্টানরা। কিন্তু মুসলিমরা? কখনোই বন্ধু হতে পারে না! মুসলিমের কাছেও ইহুদি মানে তাই!

এই ঘৃণার বীজ বুনে ট্যারেন্ট, জাহরান আর আর্নেস্টদের ব্যবহার করে ফায়দা লোটে রাষ্ট্র, ক্ষমতা আর পুঁজিবাদ। এক জনকে আরেক জনের পেছনে লাগাতে পারলেই লাভ। যতো বিভাজন ততো ছড়ি ঘোড়ানোর সুযোগ। নিরাপত্তার নামে গলা টিপে ধরার চান্সটাও বেশি। আতঙ্ক না থাকলে টহলদারকে ডাকবে কে? কে চাইতো বুকের ওপর বসাতে তল্লাশি চৌকি?

তবে এই ঘৃণার বিপরীতে ভালোবাসায় বুক জড়িয়ে সোজা মেরুদণ্ডে ঘুরে দাঁড়ানো এক দল মানুষও আছেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরের পুলওয়ামা হামলার পর গোটা ভারতে যখন যুদ্ধের দামামা, তখন পশ্চিমবঙ্গে থেকে শোনা গেল একটা দৃঢ় কণ্ঠস্বর। নিহত সিআরপিএফ জওয়ান বাবলু সাঁতরার স্ত্রী মিতা সাঁতরা বলে উঠলেন, ‘আমি প্রতিশোধ চাই না। ওপার-এপারড় কোনো পারেই যেন আর কোনো মায়ের বুক খালি না হয়।’ যদিও মিতার কথা কেউ শোনেনি। এই অমীয় শান্তির বাণী উপেক্ষা করে, পুলওয়ামার জেরে ভারত-পাকিস্তান কয়েক দফা লড়াই করে ফেলেছে। প্রাণও গেছে অনেকের।

ক্রাইস্টচার্চ হামলার পরও দেখা গেল ভালোবাসার অনন্য নজির। স্ত্রীর লাশ কাঁধে নিয়ে গোরস্থানের পথ ধরা স্বামী বললেন, ‘কোনো অভিযোগ নেই, আমি খুনিকে ক্ষমা করে দিলাম।’ কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে ঘৃণার বিপরীতে ভালোবাসা হাতে রাস্তায় মাঠে ঘাটে দাঁড়িয়ে গেলো হাজারো মানুষ। শ্রীলঙ্কা হামলার পরও শোনা গেল এমন ভালোবাসাধ্বনি। খ্রিস্টান কফিন কাঁধে চেপে গোরে ছুটলো মুসলমান। নিল শেষকৃত্যের ভার। সিনাগগে হামলার পর ফুল হাতে পাশে এসে দাঁড়াল খ্রিস্টানরাই।

এসবের মধ্যে আছে আরেক আঁতকে ওঠা খবর, শ্রীলঙ্কা হামলার দায় নেয়া আইএস নাকি এবার বাংলায় আসছে! অনেকগুলো বাংলাদেশি গণমাধ্যম ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার বরাতে জানিয়েছে, আইএস নাকি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে। আর এই হুমকি দিয়েছে তাদের টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্টে বাংলায় লেখা পোস্টার ছেড়ে। যাতে লেখা আছে ‘শিগ্রই আসছি।’ তবে টাইমস অব ইন্ডিয়ার নিউজ পড়ে, বার বার উল্টে পাল্টে দেখে মনে হয়েছে, আইএস কেবল পোস্টারটাই ছেড়েছে। হামলার ব্যাপারে আদৌ কিছু বলেনি। টাইমস অব ইন্ডিয়াও সরাসরি হামলার বিষয়টি বলেনি, বলেছে ইঙ্গিতে।

তাদের বিশ্লেষণ এই যে, এটা হামলা চালানোর পূর্বাভাস হলেও হতে পারে। অনেক বিশ্লেষক আবার এর ব্যাখায় বলেছেন, আইএস তাদের ভাষা তালিকায় বাংলাকেও যোগ করেছে, এই পোস্টার তারই ইঙ্গিত। কিন্তু সে নিয়ে দেশীয় মিডিয়ার মাতামাতি অবাক করা। পারলে সবাই আইএসকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেয়ার জন্য বিমানবন্দরের মূল ফটকে দাঁড়িয়ে যায়। এই কাণ্ড দেখে মন আপনি বলে ওঠে, মানুষ তোমরা এতো সহিংস কেন? কেন এতো যুদ্ধ চাও? সব দুয়ারে আগুন জ্বেলে দিয়াশলাই হাতে ফের কোথায় যাও?