জীবনটা লিখে দিলাম তোমার নামে

SHARE

২২ বছর আগে প্রেম করে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন সুজান। কিন্তু ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারেননি তাঁর স্বামী। স্পর্শিয়ার বয়স যখন এক বছর, সংসার-সন্তান-স্ত্রী ছেড়ে স্পর্শিয়ার বাবা পাড়ি জমালেন বিদেশে। স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন সুজান, সাড়া মেলেনি। পরে জানতে পারলেন, সেখানেই বিয়ে করে স্থায়ী হয়েছেন স্পর্শিয়ার বাবা। শুরু হলো মা-মেয়ের অস্তিত্বের লড়াই, টিকে থাকার লড়াই। একা একহাতে মেয়ের আজকের অবস্থান তৈরি করেছেন। অক্ষুণ্ন রেখেছেন নিজের সুনামও। তবু কিছু আক্ষেপ থেকেই যায়। ‘সমাজ একজন স্বামী চায়, সেটা পরতে পরতে বুঝতে হয়েছে। স্বামী মন্দ হলেও অসুবিধা নেই। এই সমাজে স্বামী থাকতেই হবে। স্বামী না থাকা মানেই মহিলার হয়তো কোনো ত্রুটি আছে। সমাজ আমাকে এটা ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে। অনেক কিছু ফেইস করেছি’—বললেন সুজান।

একটু থেমে উদাহরণসহ বুঝিয়ে বললেন, ‘একা মহিলাদের নিরাপত্তার অভাব আমাদের দেশে। সেটা বুঝেছি পদে পদে। কতবার যে বাসা বদলাতে হয়েছে! বাড়িওয়ালা প্রেম নিবেদন করে বসেন, কোথাও বাড়িওয়ালার ছেলে, এমনকি বাড়িওয়ালার ভাই। যখনই এমন পরিস্থিতিতে পড়েছি, বাড়ি ছেড়ে দিয়েছি। এভাবে করে করে খুব টায়ার্ড হয়ে গিয়েছিলাম। একা মেয়ের নিরাপত্তার অভাব কতটা সেটা আমি আর আমার মেয়েই জানি। স্কুলে ওর সহপাঠীদের অভিভাবক, টিচাররা মিলে এমন অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করেছিল! সবার প্রশ্ন, ওর বাবা নেই কেন? বাবা নেই মানে ও ভালো নয়। ওর সঙ্গে বাকি ছেলে-মেয়েদের মিশতে দেওয়া যাবে না। প্রতিবাদ জানিয়েছি তৎক্ষণাৎ। মিডিয়ায় নিউজ করার কথা বলায় পরে ওরা চুপসে যায়।’

মায়ের কথা মন দিয়ে শুনছিলেন স্পর্শিয়া। এবার নিজেই যোগ দিলেন, ‘আমাদের সমাজ তো পুরুষতান্ত্রিক। একজন সিঙ্গল ওম্যানকে খুব খারাপ চোখে দেখা হয়। স্বামী ছেড়ে গেছে, নিশ্চয়ই বউয়ের দোষ। শুধু যে অর্থনৈতিক স্ট্রাগল তা নয়, মানসিক স্ট্রাগলও ছিল। নিজের খাওয়া-পরা-থাকার সঙ্গে এই শহরে আরেকটা মেয়েকে বড় করা, এটা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়।’

মা-মেয়ের সম্পর্ক বন্ধুর মতো। সুজান হকের মতে, সব মা-বাবারই আগে সন্তানের বন্ধু হতে হবে। তাহলে সন্তানের কষ্ট বা দুঃখটা জানা যায়। সুখ তো এমনিতেই চোখে পড়ে। এতে সন্তান নিরাপদ বোধ করে।

‘আমার মায়ের জীবন নিয়ে মুভি হওয়া উচিত। তার স্ট্রাগল নানামাত্রিক। বলে শেষ করা যাবে না। বাড়িওয়ালা, পাড়া-প্রতিবেশীর কথা তো মা বললই। কতবার যে চাকরি বদলাতে হয়েছে! বসরা ডিস্টার্ব করত। একটা সিঙ্গল মেয়েকে পাবলিক প্রপার্টি হিসেবে দেখা হয় এখানে’—হেসে হেসেই বললেন স্পর্শিয়া। তবে মনের কষ্টটা তাঁর চোখে-মুখে স্পষ্ট। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘মা চাইলে আবারও বিয়ে করতে পারত। সেটা না করে আমাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। একটা মানুষ সন্তানের প্রতি এতটা ডেডিকেটেড হতে পারে, আমাকে অবাকই করে। কারণ আমি আরো অনেক মা-বাবা দেখেছি। পুরো জীবনটাই লিখে দিল আমাকে। এমনকি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবও তেমন নেই। আমাকে নিয়েই তার জীবন। এটা নিয়ে প্রায়ই আমাদের ঝগড়া হয়। আমি এখনো বলি, একটা প্রেম করো, বিয়ে করো। করবে না সে। আমার সঙ্গে বয়সেরও খুব বেশি পার্থক্য নেই তার।’

সুজান হক শিক্ষকতা করেছেন। করেছেন সাংবাদিকতাও। দেশের প্রথম সারির একটি দৈনিকে দীর্ঘদিন লিখেছেন। এখন লেখালেখি নিয়েই বেশি ব্যস্ত। এবার বইমেলায়ও তাঁর একটি বই আসার কথা ছিল—‘হেলেনের অহংকারী ফুল’। তিনটি গল্প নিয়ে ছোটদের এ বই। সামনেই প্রকাশ করবেন। আগেও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু বই। কবিতার বই ‘তুমি সেই ভ্যালেন্টাইন’, বিভিন্ন ক্ষেত্রের তারকাদের যেসব সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, ফিচার লিখেছিলেন, তার সংকলন নিয়েও বই প্রকাশ করেছেন। মাইকেল জ্যাকসনের মৃত্যুর পর লিখেছেন ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি মাইকেল জ্যাকসন’।

আছে বুটিকস হ্যান্ডিক্রাফটের হাউস। বাগান আছে, আছে পোষা প্রাণী। ফটোগ্রাফিও করেন। মেয়ের কাছে যত নাটক-সিনেমার পাণ্ডুলিপি আসে, সেগুলো মেয়ের আগেই পড়ে ফেলেন।

মডেল-অভিনেত্রী স্পর্শিয়ার আজকের অবস্থানের পেছনে পুরোটাই তাঁর মায়ের অবদান। ‘ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, এমন কোনো চাহিদা ছিল না মায়ের। ছবি আঁকতাম, সেটাতেও তার সায় ছিল। লেখালেখি করতাম, উৎসাহ দিত যেন আমি লেখক হই। যখনই যেটা করতে চেয়েছি, মা চেয়েছে যেন সেটাই মন দিয়ে করি। মা যেহেতু বহু বছর সাংবাদিকতায় ছিল, ছোটবেলা থেকেই শোবিজের মানুষজন দেখে বড় হয়েছি। কিন্তু মা কখনো চাপিয়ে দেয়নি, আমাকে অভিনেত্রী হতে হবে। এমনকি কখনো তার পরিচিত কাউকে বলেওনি, আমার মেয়েকে কাজ দাও। কিন্তু যখন নিজে শুরু করেছি, তখন তাকে পাশে পেয়েছি।’

খাওয়াদাওয়া নিয়ে মা-মেয়ের খুব ঝগড়া হয়। এক বেলার খাবার আরেক বেলা খান স্পর্শিয়া। এ নিয়ে মায়ের অনেক কথা শুনতে হয়। মেয়েকে বকাঝকা করার আরো কিছু কারণ আছে, ‘ও খুব সরল টাইপের। যে যা চায়, সব দিয়ে দেয়। তখন রাগ হয়। আমার কোনো একটা শখের জিনিস কেউ চাইল, অমনি সে দিয়ে দেয়। আমার লাইব্রেরির অর্ধেক বই দিয়ে দিয়েছে মানুষকে। বাসায় না থাকলে এই কাজটা করে, বাসায় ফেরার পর বলেও না। পরিচিত বা চেনা মুখের অনেক পরিচালকের আবদার রাখতে গিয়ে মানহীন নাটক হাতে নেয়। তখন রাগারাগি করি’—বললেন সুজান হক।

মাকে আইডল মানেন স্পর্শিয়া, এটা খুবই স্বাভাবিক। শুধু তা-ই নয়, স্পর্শিয়া মনে করেন, এই সময়ের প্রত্যেক নারীর জন্য তাঁর মা উদাহরণ। প্রত্যেক নারীরই একবার তাঁর মায়ের সঙ্গে কথা বলা উচিত। ‘বিভিন্ন সময়ে হতাশাগ্রস্ত মেয়েদের সঙ্গে কথা হলে তাদের বলি আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করে কথা বলতে। উত্তরণের পথ অন্তত খুঁজে পাবে। আমি যখন অনেক আপসেট হয়ে যাই, মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি, তখন চোখের সামনে মা চলে আসে। তার কথা চিন্তা করি। ভাবি এই মানুষটা কিভাবে আসলে এত স্ট্রাগল করেছে! এত বড় করেছে আমাকে! জীবনে মা না থাকলে আমি তো কিছুই না!’—বলেন স্পর্শিয়া।

স্পর্শিয়ার জীবনেও ঘটেছে বিয়েবিচ্ছেদের মতো ঘটনা। বিয়ের সিদ্ধান্তটা স্পর্শিয়া নিজেই নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে সুজানের কথা হলো, ‘এত অল্প বয়সে ওর বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ও আবেগে পড়ে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, এটা তোমার সঙ্গে যায় না। তোমার বয়স এখনো অনেক পড়ে আছে। আমি পাশে আছি। এখন আর আবেগেকে প্রশ্রয় দেবে না হয়তো। একবার শিক্ষা তো হলোই।’

স্পর্শিয়াও হাসিমুখে তাঁর মায়ের কথা মেনে নিলেন, ‘যখন ভুল করেছি, মা বলেছে এটা কোরো না। মা আমার চেয়ে অবশ্যই ম্যাচিউরড। তার যে কথা শুনেছি, ভালো করেছি। যেটা শুনিনি ধরা খেয়েছি, এই আর কি।’