উ. কোরিয়াকে কী সামলাতে পারবে আমেরিকা?

SHARE
আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) হচ্ছে এমন এক ক্ষেপণাস্ত্র, যা অন্তত সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে পারে। গত ৪ জুলাই উত্তর কোরিয়া যে ক্ষেপণাস্ত্রটির পরীক্ষা চালিয়েছে, তা ৬ হাজার ৭০০ কিলোমিটার দূরে আঘাত করতে সক্ষম। সুতরাং আইসিবিএম প্রযুক্তি রয়েছে বলে দেশটি যে দাবি করেছে, তা সত্য। এই ঘটনাকে ধারণার চেয়েও ‘ভয়াবহ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে দ্য ইকোনমিস্ট।

আইসিবিএম পার্শ্ববর্তী জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকার আলাস্কা, অ্যাংকরেজ, গুনাম ঘাঁটিকেও উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আওতায় নিয়ে এসেছে। যদিও লস অ্যাঞ্জেলেস ও নিউইয়র্ক এখনো এর আওতার বাইরে। পাশাপাশি বায়ুমণ্ডলে পুনঃপ্রবেশযোগ্য কোনো ক্ষেপণাস্ত্রে নিউক্লিয়ার বোমা বহনের সক্ষমতা এখনো উত্তর কোরিয়া অর্জন করেনি। এ ছাড়া রয়েছে প্রযুক্তিগত আরও কিছু সীমাবদ্ধতাও। এসবই আমেরিকাকে কিছুটা স্বস্তি দিতে পারলেও এটা মনে রাখতে হবে যে, উত্তর কোরিয়া এসব প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে খুব দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। কারণ কয় বছর আগেও মার্কিন কোনো শহরে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ক্ষমতা দেশটির ছিল না। অথচ খুব অল্প সময়ের মধ্যে সে সক্ষমতা প্রমাণ দিয়ে দেশটি রীতিমতো ওয়াশিংটনকে চোখ রাঙাচ্ছে।
চলতি বছরের শুরুতে কিম জং উন যখন ঘোষণা দিলেন, উত্তর কোরিয়া আইসিবিএম উৎক্ষেপণের সক্ষমতা অর্জনের খুব কাছাকাছি, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইট করলেন, ‘এটা কখনোই ঘটবে না।’ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদধারী কোনো ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার যথাযথ পন্থা এটি নয়। উত্তর কোরিয়াকে অস্ত্র কর্মসূচি থেকে ফেরাতে আমেরিকা দেশটির প্রধান ব্যবসায়িক অংশীদার চীনকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। গত কয়েক মাস ধরে উত্তর কোরিয়ায় পণ্য সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার বিষয়ে চীনকে কিছুটা আওয়াজ তুলতে দেখা গেছে। কিন্তু ট্রাম্প ও শি জিন পিংয়ের ‘নয়া বন্ধুত্বে’র উত্তেজনা প্রশমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চীনের মৌখিক তৎপরতাও প্রশমিত হয়ে গেছে। বিষয়টি যে ট্রাম্প নিজেও বুঝতে পেরেছেন, তা চীন সম্পর্কে তার সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকেই সুস্পষ্ট। কিন্তু উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে আমেরিকা আর কী করতে পারে?
অনেক যুদ্ধংদেহী বক্তব্য ট্রাম্প এরই মধ্যে দিয়েছেন। এর মধ্যে যেমন রয়েছে সর্বাত্মক অবরোধের কথা তেমনি রয়েছে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণার মতো বক্তব্যও। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার ওপর সর্বাত্মক অবরোধের চিন্তাটা অত্যন্ত ভয়াবহ। কারণ এটি আক্ষরিক অর্থেই কোরীয় উপসাগরকে ঠেলে দেবে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দিকে। আর তুলনামূলক কম উত্তেজক সিদ্ধান্তটি হবে, উত্তর কোরিয়ার ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ভূপাতিত করার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকা। অর্থাৎ যখনই উত্তর কোরিয়া এ ধরনের কোনো পরীক্ষা চালাবে, তখনই তার ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র আকাশে থাকতেই ধ্বংস করা হবে। এতে দেশটি এ ধরনের খাতে ব্যয়ে কিছুটা হলেও নিরুৎসাহিত হতে পারে। কিন্তু সংকটটা হচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্র-বিধ্বংসী প্রয়োজনীয় প্রাযুক্তিক সক্ষমতা আমেরিকা এখনো অর্জন করেনি।
এর বাইরে রয়েছে আলোচনার পথ। ট্রাম্প একবার বলেছিলেন, হোয়াইট হাউসে বার্গার খেতে খেতেই কিম ও তিনি সব সমস্যার সমস্যা করতে পারেন। কিন্তু এরপরও এটি বিশ্বাস করা শক্ত যে, উত্তর কোরিয়া তার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি বাতিল করবে, যাকে দেশটি বিরুদ্ধ বিশ্বের সঙ্গে লড়াইয়ে একমাত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করে।
এদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে আমেরিকার যৌথ সামরিক মহড়ার অবসান চাচ্ছে উত্তর কোরিয়া। সমস্যা নিরসনে আলোচনা শুরুর পূর্বশর্ত হিসেবে দেশটি এ দাবি করছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যৌথ সামরিক মহড়া বৈধ হলেও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা নয়। উপরন্তু প্রতিশ্রুতি ভাঙার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে উত্তর কোরিয়ার। এ ছাড়া আমেরিকা যৌথ মহড়া বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলে তা আঞ্চলিক মিত্রদের আতঙ্কিত করবে। এ সমীকরণে রয়েছে চীনও। নিজেদের সীমান্তে মার্কিন উপস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই দেশটির পছন্দ নয়। ফলে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পথে থাকা উত্তর কোরিয়ার মতো একটি দেশের প্রতি তার সমর্থন অস্বাভাবিক নয়।
উত্তর কোরিয়ার ওপর বর্তমানে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞা দেশটির মানুষের জীবনযাত্রাকে অনেক কঠিন করে তুলেছে। কিন্তু এটি তাকে থামানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে একটি ভালো বিকল্প হতে পারে, দেশটিতে জ্বালানি তেল সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া, যা চীন এরই মধ্যে কিছুটা হলেও শুরু করেছে। চীনের এ পদক্ষেপকে আরও ত্বরান্বিত করতে দেশটির আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে আমেরিকা। কিন্তু সীমান্ত বাণিজ্যকে এর মাধ্যমে কতটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তা নিশ্চিত নয়।
আদতে উত্তর কোরিয়াকে একটি কার্যকর পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কর্মসূচি থেকে নিরস্ত করার অব্যর্থ কোনো উপায় ট্রাম্পের হাতে নেই। কারণ উত্তর কোরিয়া একই সঙ্গে শঙ্কা ও সংশয় উদ্রেককারী একটি দেশ। উত্তর কোরিয়া এরই মধ্যে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি অর্জন করেছে, এটা এখন প্রমাণিত। কিন্তু এও সত্য যে, দেশটি এখনো ওই দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রে নিউক্লিয়ার ওয়্যারহেড কার্যকরভাবে বহনের প্রযুক্তি অর্জন করেনি। আর এখানটাতেই এখন ট্রাম্প প্রশাসনের নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। দ্য ইকোনমিস্টকে তাঁরা বলেন, ট্রাম্পের উচিত তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা। উত্তর কোরিয়া যেন তার আইসিবিএম কর্মসূচি আর সম্প্রসারণ করতে না পারে, সে জন্য তার সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তবে সবার আগে উত্তর কোরিয়াসহ পুরো অঞ্চলটি সম্পর্কে বর্তমান প্রশাসনের একটি সুস্পষ্ট ধারণা প্রয়োজন। সঙ্গে চাই ধৈর্য। বিশেষত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে আরও সুস্থির হতে হবে। কারণ যেকোনো হঠকারী সিদ্ধান্তের মূল্য বহু মানুষকে প্রাণ দিয়ে পরিশোধ করতে হতে পারে।