নামাজ পড়ানোর
দায়িত্বের বাইরে বয়ান দেওয়ার ক্ষেত্রে ইমামদের সতর্ক হওয়ার উপর জোর দিয়েছে হাই কোর্ট।
আদালত বলেছে, “একজন ইমামের দায়িত্ব হল মুসল্লিদের নামাজ পড়ানো। ইসলাম সম্পর্কে সঠিক দিক-নির্দেশনা প্রদান করা। তিনি এমন কোনো বয়ান দেবেন না, যা দেশের প্রচলিত আইন বহির্ভূত।”
ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যামামলায় আপিলের রায়ের পর্যবেক্ষণে হাই কোর্টের এই বক্তব্য এসেছে; যে মামলাটিতে দণ্ডিত আসামিদের আরেক আসামির বয়ানে প্ররোচিত হওয়ার বিষয়টি উঠে আসে।
২০১৩ সালে গণজাগরণ আন্দোলনের কর্মী রাজীবকে কুপিয়ে হত্যার জন্য যারা দণ্ডিত নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির কয়েকজন ছাত্র আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের প্রধান মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানীর বয়ানে প্ররোচিত হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন।
বিচারিক আদালতের রায়ে নর্থ সাউথের দুই ছাত্র রেদোয়ানুল আজাদ রানা ও ফয়সাল বিন নাঈম দীপকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। নিষিদ্ধ সংগঠন আনসারুল্লাহর আমির রাহমানী ও অন্য ছয় ছাত্রকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড।
রোববার দেওয়া আপিলের রায়ে হাই কোর্ট ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দেওয়া ওই সাজাই বহাল রেখেছে। গণজাগরণ আন্দোলন শুরুর পর ব্লগারদের নাস্তিক আখ্যায়িত করে হেফাজতে ইসলাম মাঠে নামার মধ্যে খুন করা হয় স্থপতি রাজীবকে।
মুফতি রাহমানীর খুৎবায় আসামিরা প্ররোচিত হয় বলে বিচারিক আদালতের রায়ে বলা হয়। ধর্মীয় বয়ানে হত্যাকাণ্ডের উসকানি দেওয়ার আরও ঘটনাও দেশে এরপর ঘটে।
ব্লগার, লেখক, অধ্যাপক হত্যাকাণ্ডের কয়েকটি ঘটনায় আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিললে সংগঠনটি নিষিদ্ধ করে সরকার।
রায়ের পর্যবেক্ষণে হাই কোর্ট একই সঙ্গে বলেছে, “যদি কেউ ইসলাম এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.) অথবা যে কোনো ধর্ম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে তাহলে দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় আনার সুযোগ রয়েছে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। কোনো ব্যক্তির কারও ধর্ম সম্পর্কে কটাক্ষ করা উচিৎ নয়।”
মুফতি রাহমানীর সর্বোচ্চ সাজা না হওয়ায় নিহত রাজীবের বাবার পাশাপাশি গণজাগরণ আন্দোলনের কর্মীদের ক্ষোভ রয়েছে। তাকে ৫ বছর কারাদণ্ড দেওয়ার বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছিল, রাহমানী যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তাতে হত্যাকাণ্ডে তার নিজের বা অন্য আসামিদের কারও সম্পৃক্ততার কথা আসেনি।
আপিলের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, এ হত্যাকাণ্ড পূর্ব পরিকল্পিত। একটি গ্রুপ হত্যাকাণ্ডে সরসারি অংশগ্রহণ করেছে। অন্য গ্রুপটি তথ্য সংগ্রহ করেছে। ফলে বিচারিক আদালতের রায় পরিবর্তনের কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সাক্ষ্য, দলিলাদি ও আসামিপক্ষের যুক্তি থেকে দেখা যায়, মুফতি রাহমানী ছাড়া বাকি সাতজন আসামি মেধাবী ছাত্র। কিন্তু কেন তারা এই পথে গেলেন, এই মামলার মধ্যে আদালত তা খুঁজে পায়নি।
যে কোনো মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য পুলিশ প্রশাসনের প্রতি পরামর্শ রেখেছে আদালত।
আসামি এই শিক্ষার্থীদের বিপথে যাওয়ার জন্য অনেকে যে অভিভাবকদের দায়ী করেন, তার সঙ্গে সহমত পোষণ করেছে হাই কোর্ট।
“এ মামলার আসামিদের সকলের পিতা-মাতা উচ্চ শিক্ষিত। তাদের উচিৎ ছিল সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দেওয়া। কিন্তু তারা তা দিতে পারেনি। সেকারণে তারা গোল্লায় গেছে।”
শিশুদের মানসিক গঠনে অভিভাবকদের আরও আন্তরিক হওয়ার পরামর্শও এসেছে আদালত থেকে।
“সন্তানদের মানসিক অবস্থার কথা, তারা কী করতে চায়, কোন বিষয়ে পড়তে চায়, তা না জেনে তার (শিক্ষার্থী) মনের বিরুদ্ধে অনেক কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়। এতে তাদের সঠিকভাবে বাড়তে দেওয়া হয় না। ফলে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে। এ প্রবণতা বন্ধ হওয়া উচিৎ।”
সুস্থ রাজনীতি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, ধর্মীয় সম্প্রীতি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান, স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে সবার দায়িত্বের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে আদালত।