তাসকিন-বিতর্কে আড়ালে ক্রিকেট

SHARE

34524e111889b69e6be7631499922503-24প্রথম ম্যাচে হেরেছে দুদলই। আজকের বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটাকে কি তাহলে ‘আহত বাঘ বনাম আহত ক্যাঙারু’ উপমা দিয়ে দেওয়া যায়!
প্রাণিকুলে এটা কোনো লড়াই-ই নয়। বাঘের সঙ্গে ক্যাঙারু! রীতিমতো হাস্যকর।
ক্রিকেটে যে তা নয়, তা তো আপনি জানেনই। ‘ক্যাঙারু’ এখানে তার দীর্ঘ লাফের মতোই পরাক্রমশালী।
আজকের ম্যাচে জয়-পরাজয় নিয়ে ভাবতে গেলে এর চেয়েও যেটি বড় হয়ে উঠছে, তা হলো ‘আহত বাঘ’ রক্তক্ষরণে বিপর্যস্ত।
যে রক্তক্ষরণের নাম তাসকিন আহমেদ!
মাশরাফি বিন মুর্তজা কাল সকালে চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে সংবাদ সম্মেলন শেষ করে যাওয়ার পথে ভেঙে পড়লেন। হোটেলে ফেরার পর বললেন, ‘প্রেস কনফারেন্সে নিজেকে কোনোমতে সামলে রেখেছিলাম। এরপর আর পারলাম না।’
অনুশীলন ছিল ঐচ্ছিক। একবার ভেবেছিলেন, আসবেন না। অনুশীলনের চেয়ে তাসকিনের পাশে থাকাটাই যে বেশি জরুরি বলে মনে হচ্ছিল। টিম বাস মাঠে চলে যাওয়ার পর মত বদলান। শুধু একটা কথা ভেবেই—এই দিনে সংবাদ সম্মেলনে তাঁর থাকা উচিত। উচিত কড়া কিছু কথা বলাও।
গুরুত্বপূর্ণ দুই বোলারকে হারিয়ে দল যে বিপর্যস্ত, সেটি গোপন করার কোনো চেষ্টাই করলেন না। অধিনায়ককে এসব সময়ে দলকে আবার জাগিয়ে তুলতে হয়। অতীতে তা অনেকবারই করেছেন মাশরাফি। সমস্যা হলো, এবার তিনি নিজেই বিপর্যস্ত।
গত পরশু দুপুর থেকে সন্ধ্যা পেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত মিটিংয়ে মিটিংয়েই কেটেছে বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্টের। খেলোয়াড়দের সঙ্গেও বসেছিলেন মাশরাফি। দলীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, আইসিসির এই ‘অন্যায়’-এর প্রতিবাদে মাশরাফি বিশ্বকাপ বয়কট করার কথাও নাকি তুলেছিলেন। বাকি খেলোয়াড়েরা জানিয়ে দেন, অধিনায়ক যা-ই করতে চান, তাতে তাদের সম্মতি আছে। পরে নাকি মাশরাফি বলেন, দলের তরুণ খেলোয়াড়দের ক্যারিয়ার সামনে পড়ে আছে। তাঁদের অনিশ্চয়তায় ফেলতে চান না। তিনি অনেক খেলেছেন। নিজে সরে দাঁড়াবেন। কাউকে না কাউকে এর প্রতিবাদ তো করতে হবে।
মাশরাফি এই সবকিছু স্বীকার-অস্বীকার কোনোটাই করলেন না। তবে আবেগতাড়িত ওই সিদ্ধান্ত যদি নিয়েও থাকেন, তা থেকে যে সরে এসেছেন, সেটি বোঝা গেল দলকে আবার জাগিয়ে তোলার চেষ্টা দেখে। দুই বোলারের নিষিদ্ধ হওয়াটাকে দুই চোখে দেখছে বাংলাদেশ দল। তাদের বদ্ধমূল ধারণা, তাসকিনের প্রতি চরম অন্যায় হয়েছে। তাঁর বোলিং অ্যাকশনে কোনো সমস্যা নেই। এর মধ্যে অন্য কোনো কিছু আছে।
আরাফাত সানির ক্ষেত্রে যে সংশয় নেই। সানির অ্যাকশন নিয়ে আগে থেকেই ফিসফাস ছিল। তাঁর নিষিদ্ধ হওয়াটা তাই মেনে নিয়েছে দলের সবাই। তাঁকে শোধরানোর প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। যে কারণে কাল অনুশীলনেও এসেছেন সানি। ভেঙে পড়া তাসকিন হোটেলেই বন্দী হয়ে থাকলেন। তামিম-সাকিব-মাহমুদউল্লাহর মতো অনেকেই বাইরে বেরিয়েছেন। সন্ধ্যার দিকে মাশরাফিও। কিন্তু এক হোটেলে থেকেও তাসকিনের দেখা মিলল না।
একটা প্রশ্ন অবশ্য তাসকিন-সানি দুজনের ক্ষেত্রেই উঠছে। এত দিন ধরে খেলে আসছেন, হঠাৎ বিশ্বকাপের মতো আসরে কেন একসঙ্গে দুজনকে ‘রিপোর্ট’ করলেন আম্পায়াররা, এই প্রশ্ন পুরোনো। নতুন প্রশ্ন হলো, দুজনের পরীক্ষার ফল এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের দুই দিন আগে কেন দেওয়া হলো? মাশরাফি গত ৭-৮টি ম্যাচে তাসকিনের পারফরম্যান্স মনে করিয়ে দিয়ে হাহাকার করলেন, ‘আমরা যে কয়টা ম্যাচ জিতেছি, সব কটিতেই ও একটা ভালো শুরু করে দিয়েছে। আমাদের পুরো পরিকল্পনাই এখন তো এলোমেলো হয়ে গেছে।’
তাসকিন ও সানির বদলি দুই খেলোয়াড় শুভাগত হোম চৌধুরী ও সাকলাইন সজীব কাল সকালে এসে বেঙ্গালুরু পৌঁছেছেন। একজন আগের দিন দুপুরে ময়মনসিংহ থেকে রওনা হয়েছেন। অন্যজন রাজশাহী থেকে। মধ্যরাতে কলকাতায়, বেঙ্গালুরুর ফ্লাইট ভোর ৬টা ৫ মিনিটে। জেনে আশ্চর্য হয়ে যেতে হলো, বিসিবি কলকাতায় হোটেলের কোনো ব্যবস্থাই করেনি। দুজনই রাত কাটিয়েছেন বিমানবন্দরে। এর পরও দুজনই হোটেলে ব্যাগ-ট্যাগ রেখেই অনুশীলনে চলে এলেন। উপায় কী, নইলে যে বাংলাদেশ ১৩ জনের দল হয়ে যায়!
তাসকিনের জন্য আইসিসির কাছে বিসিবি ‘ন্যায়বিচার’ চেয়েছে। তাতে কি কোনো কাজ হবে? আইসিসির মিডিয়া কর্মকর্তা সামিউল হাসান প্রশ্নটার উত্তর দেওয়ার জন্য সময় চাইলেন। মোবাইলে আইসিসি চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো বিসিবি সভাপতির মেইল দেখতে দেখতে বললেন, ‘মাত্রই মেইলটা দেখলাম। একটু সময় নিয়ে বলি।’ সেই ‘সময়’ যখন আর শেষ হলো না, বোঝা গেল স্পর্শকাতর বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাইছেন।
তাসকিন-বিতর্কে বাকি সবকিছুই আড়াল হয়ে গেছে। আলোচনায় ক্রিকেটটাই নেই। নইলে এটা নিশ্চয়ই বড় খবর হতো যে, সাবেক অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ এই ম্যাচে বাংলাদেশের ভালো সুযোগ দেখছেন। বর্তমান অধিনায়ক স্টিভ স্মিথও ম্যাচটাকে মানছেন ‘বড় চ্যালেঞ্জ’ বলে। আইপিএলে পুনে ওয়ারিয়র্সে তামিম ইকবালের টিমমেট ছিলেন স্মিথ। বাংলাদেশ দলের সঙ্গে তাঁর আরেকটি সম্পর্কও আছে। কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে নিউ সাউথ ওয়েলস দলে এই স্মিথ ছিলেন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ। হাথুরুসিংহের কাছে অনেক কিছু শিখেছেন বলে ঋণও স্বীকার করলেন।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে আইপিএলের মুখ সাকিব আল হাসান এই অস্ট্রেলিয়া দলের কারও সঙ্গেই এক দলে খেলেননি! তবে মাঠটা স্বাভাবিকভাবেই খুব পরিচিত। যদিও এখানে ভালো পারফরম্যান্সের কথা মনে করতে পারলেন না। ‘একবারই বোধ হয় ৩ উইকেট পেয়েছিলাম। ব্যাটিংয়েও সেভাবে রান পাইনি। তবে ২০১৪ ফাইনালে ৭ বলে ১২ করেছিলাম। সেটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল’—চিন্নাস্বামী স্টেডিয়াম নিয়ে সাকিবের স্মরণীয় কিছু বলতে এটুকুই।
পরিস্থিতি যা, বাংলাদেশের জন্যও আজ স্মরণীয় কিছু ঘটে যাওয়ার কথা ভাবতে সাহস লাগছে। তবে সত্যি সত্যিই যদি ব্যাপারটা ‘আহত বাঘ বনাম আহত ক্যাঙারু’ হয়ে যায়, তাহলে ভিন্ন কথা!