সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের দেওয়া সূত্রবিহীন খবর যাচাই না করে প্রকাশের জন্য সাংবাদিকতার ‘ভুল স্বীকার’ করেছেন ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম। তিনি বলেছেন,“এটা আমার সাংবাদিকতার জীবনে, সম্পাদক হিসেবে ভুল, এটা একটা বিরাট ভুল। সেটা আমি স্বীকার করে নিচ্ছি।” (সূত্র: বিডিনিউজ)। ডেইলি স্টার এর ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে এটিএন নিউজের এক আলোচনায় তিনি এই স্বীকারোক্তি করেন বলেন বিডিনিউজের খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। খবরটি আমাকে যতোটা না চমকিত করেছে, তার চেয়েও বেশি উৎসাহী করেছে। উৎসাহী হওয়ার কারণ- বাংলাদেশে গণমাধ্যম তথা কোনো মিডিয়ার ভুল স্বীকারের ঘটনা বিরল, নাই বললেই চলে। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে এটি একটি নতুন দৃষ্টান্তও বটে।
মুন্নী সাহার সঞ্চালনায় এটিএন নিউজের অনুষ্ঠানটি দেখার সুযোগ হয়নি। ফলে ডেইলি স্টার এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম আসলে কি বলেছেন, তা সরাসরি শোনার সুযোগ হয়নি। তবে বিডিনিউজে প্রকাশিত খবরটুকু পড়ে ধারণা পাওয়া যায়, অনুষ্ঠানে মাহফুজ আনামকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর একটা চেষ্টা ওই অনুষ্ঠানে ছিলো। অনুষ্ঠানের আলোচক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ‘হেড অফ কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ও এডিটোরিয়াল পলিসি কো-অর্ডিনেটর’ গাজী নাসিরউদ্দিন আহমেদও ডেইলি স্টার নিয়ে নানা অভিযোগ তুলেছেন ওই আলোচনায়। অর্থ্যাৎ, ডেইলি স্টার সম্পাদককে জবাবদিহির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে আরেকটি মিডিয়া এবং সেখানে মিডিয়ার লোকজনই পত্রিকাটির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন, কোনো রাজনীতিক বা অন্যকোনো পেশার লোকজন নয়।
২০০৭ সালের সেনানিয়ন্ত্রিত সরকারের প্রতি সমর্থন দেওয়ার কারণে ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলো বরাবরই সমালোচিত হয়ে আসছে। সরকারের নীতি নির্ধারকদের অনেকেও এ নিয়ে প্রকাশ্যে পত্রিকা দুটির সমালোচনা করেছেন। ডেইলি স্টার-প্রথম আলোর বাইরে অনেক রাজনীতিক- পেশাজীবীরাও সেই সময়ে সেনানিয়ন্ত্রিত তত্বাবধায়ক সরকারকে সমর্থন দিয়েছিলো। সেটি অবশ্য ভিন্ন আলোচনা।
ডেইলি স্টার, প্রথম আলোকে নিয়ে সমালোচনা হলেও মঈন-ফখরুদ্দিনদের শাসনামলে সামগ্রিকভাবে ঢাকার মিডিয়ার ভূমিকা কি রকম ছিলো- তা নিয়ে কখনোই কোনো ফোরামে বিশদ আলোচনা হয়নি। যেই প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য আজকে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ‘সম্পাদক, সাংবাদিকতা জীবনের বড় ভুল’ হিসেবে স্বীকার করছেন, সেই প্রতিবেদনগুলো সেই সময়ে ঢাকার প্রায় সবকটি মিডিয়াই হুবহু প্রকাশ করেছে। সেই সব প্রতিবেদনগুলো যে ডিজিএফআই কর্তৃক সরবরাহকৃত ছিলো- তা নিয়ে গুঞ্জন থাকলেও আনুষ্ঠানিকভাবে কেউই স্বীকার করেছেন বলে আমি শুনিনি। সেই হিসেবে মাহফুজ আনামই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করলেন এবং জানালেন যে, সেই খবরগুলো সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই কর্তৃক সরবরাহকৃত ছিলো।
ডিজিএফআইর লিখে দেওয়া প্রতিবেদন কোনো ধরনের যাচাই বাছাই না করেই মঈন-ফখরুদ্দিনদের শাসনামলে ঢাকার প্রায় সবকটি মিডিয়াই দিনের পর দিন প্রকাশ করেছে । সেই খবরগুলোতে রাজনীতিকদের চরিত্র হনন ছিলো, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীদেরও চরিত্র হনন ছিলো। ‘যাচাই বাছাই না করে প্রকাশ করা’র মানে হচ্ছে- ডিজিএফআইর পাঠানো প্রতিবেদনগুলোর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়েই সেগুলো প্রকাশ করা। অথচ সাংবাদিকতার নৈতিকতার প্রধান শর্তই হচ্ছে কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ যথেষ্ট পরিমানে নিশ্চিত না হয়ে কোনো মিডিয়া প্রকাশ করবে না। কিন্তু ঢাকার মিডিয়া দিনের পর দিন সেই নৈতিকতাকে পদদলিত করে মহল বিশেষের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবর তারা প্রকাশ করে গেছেন। সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারের বিদায় হলেও মিডিয়ার এই ভূমিকা নিয়ে কখনো প্রশ্ন বা আলোচনা ওঠেনি। মিডিওয়ালারাও এ নিয়ে কোনো ধরনের আত্মগ্লানির কথা আমাদের জানাননি। আজ যখন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম- সেই সময়কার ভূমিকাকে ‘ভুল’ হিসেবে অভিহিত করছেন, তখন অন্যান্য মিডিয়া তথা সম্পাদকদের অনুভূতি জানার আগ্রহ এবং কৌতূহল দুটোই তীব্র হয়ে ওঠে।
আমার তো মনে হয়, মাহফুজ আনামের ভুল স্বীকার সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলের মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে খোলামেলা আলোচনার একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এটিএন নিউজও এই প্রশ্নে অন্যান্য সম্পাদকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের মতামত এবং যুক্তি আমাদের শোনাতে পারেন। পশ্চিমাদেশের বড় ধরনের কোনো ইস্যু মিডিয়ার অবস্থান বা ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বিশেষ সম্পাদকীয় লিখে তারা নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। অবস্থানটি ভুল হলে সেটিও তারা স্বীকার করে নেন। বাংলাদেশের মিডিয়া কেন- কোনো ক্ষেত্রেই এই ধরনের চর্চা নেই। মিডিয়াগুলো নিজের থেকে সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে তাদের ভূমিকা বিশেষ করে ডিজিএফআইর সরবরাহ করা প্রতিবেদন যাচাই বাছাই না করেই প্রকাশ করা নিয়ে তাদের মনোভাব এবং অবস্থানের ব্যাখ্যা দিতে পারেন। আর না হউক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতেও তো এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়, আলোচনা করা যায়।
শুরুতেই বলেছিলাম, মাহফুজ আনামের ভুল স্বীকার আমাকে উৎসাহী করেছে। আমরা রাষ্ট্রের জবাবদিহি চাই, রাজনীতিকদের জবাবদিহি চাই, রাজনীতিকদের অতীত কর্মকাণ্ডেরও চুলচেরা বিশ্লেষণ করি। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত মিডিয়ার ভূমিকা তা থেকে বাদ যাবে কেন। মাহফুজ আনামের মতো আর কতো জন সম্পাদক সেনানিয়ন্ত্রিত সরকারের শাসনামলের নিজেদের ‘ভুল’টাকে স্বীকার করার নৈতিকতা এবং সাহস রাখেন, সেটিও আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে যাক।