সুদানের এল-ফাশার শহর দখলের কয়েকদিন পর র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস যোদ্ধরা শত শত বেসামরিক লোককে হত্যা করেছে বলে জানা গেছে। জাতিসংঘের স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান এই খবর বলেছেন।
এর আগে আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, সুদানের রাজধানী দারফুরের পশ্চিমাঞ্চলের এল-ফাশার শহরের দখল নিতে দেশটির আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ) মাত্র ৩ দিনে অন্তত দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। এ ছাড়া জাতিসংঘ প্রধান টেড্রোস আধানম ঘেব্রেয়েসাস জনান, শহরের একটি হাসপাতালে ৪৬০ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে এই বাহিনী।
এই পরিস্থিতি সুদান ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখে পড়েছে, যেদিকে বিশ্ববাসীর চোখ এখনো পড়েনি। উত্তর দারফুরের এল ফাশার শহরে হত্যাকাণ্ডের মাত্রা এতোটাই বেশি যে, মানুষের রক্ত এবং মৃতদেহের স্তূপ মহাকাশ থেকে তোলা ছবিতেও ধরা পড়েছে। সেখানে যা ঘটছে তা, বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটের অংশ।
আলজাজিরার একটি ভিডিও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুদান শহরে ঘটে যাওয়া নৃশংসতা মহাকাশ থেকেও দেখা যাচ্ছে।
 ভিডিওতে বলা হয়েছে, স্যাটেলাইট ছবিগুলো এল ফাশার শহরের গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেছে। 
ইয়েল স্কুল অফ পাবলিক হেলথের হিউম্যানিটেরিয়ান রিসার্চ ল্যাব (এইচআরএল)-এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ‘বিশ্লেষকরা বলছেন, ছবিতে রক্ত এবং মৃতদেহের স্তূপ দেখা যাচ্ছে। মাটিতে লালচে দাগ রক্ত বলে মনে করা হচ্ছে এবং মানবদেহের মতো বস্তুগুলো মহাকাশ থেকে দৃশ্যমান।’
গত ২৭ অক্টোবর অ্যারোনটিক কম্পানি এয়ারবাস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেস ছবিগুলো তুলেছে।
স্যাটেলাইট চিত্রগুলো শহরটির ভেতরের ভিডিওর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এতে উত্তর দারফুরের সুদানের সেনাবাহিনীর (এসএএফ) শেষ ঘাঁটি এল ফাশার শহর দখলের পর আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ)-এর চালানো গণহত্যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। 
কিছু ভিডিওতে দেখা যায়, আরএসএফ সদস্যরা নিরস্ত্র মানুষদের গুলি করে হত্যা করছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বেঁচে ফেরা কিছু মানুষ অন্য তাওয়িলা শহরে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে, তবে তাদের সেখানে পৌঁছাতে ৬০ তাদের কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।
ইউসুফ নামে একজন বাসিন্দা জানান, ‘আমরা হত্যা দেখছি।
পুরুষ, নারী সবাইকে হত্যা করা হচ্ছে।’
মিনাল নামে আরো একজন বলেন, ‘আমরা এখানে পালিয়ে আসার সময় আমাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। আরএসএফ যোদ্ধাদের আপনাকে দেখে সন্দেহ হলে সঙ্গে সঙ্গেই গুলি করে হত্যা করছে। সন্দেহ হলে, নির্যাতন করা হচ্ছে। মানুষদের ধরে ধরে লাইনে দাঁড় করানো হচ্ছে, কিন্তু কোনোভাবেই নড়াচড়া করা যাবে না। নড়লে সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
সাহায্য সংস্থাগুলো বলছে, তারা খুব কম প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকেই নিরাপদে শহর ছেড়ে বের হতে দেখেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, পুরুষরা তাদের পরিবারের সঙ্গে পালানোর সময় আরএসএফ যোদ্ধারা বেছে বেছে সুস্থ-সবল পুরুষদের আলাদা করছে।
ইকরাম নামে এক নারী বলেন, ‘যোদ্ধারা তাদের ধরে লাইনে দাঁড় করেছে এবং আমাদের সামনেই গুলি করে হত্যা করে সড়কে ফেলে রেখেছে। নারীরা এগুলো দেখে চিৎকার করছিল, তখন তাদেরও লাইনে দাঁড়াতে বলে এবং আমাদের চলে যেতে বলা হয়। আমরা শুধু পিছন থেকে গুলির শব্দ আর মারধরের শব্দ শুনছিলাম। তাদের আমরা আর কোনোদিন দেখতে পাইনি ‘
ইয়েল স্কুল অফ পাবলিক হেলথের হিউম্যানিটেরিয়ান রিসার্চ ল্যাববের বিশ্লেষকরা বলছেন, আরএসএফ এল-ফাশেরে অনারব জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নিধন চালাচ্ছে।
সুদানে গৃহযুদ্ধ কীভাবে শুরু হলো?
২৭ অক্টোবর এল-ফাশার পতন সুদানের গৃহযুদ্ধে এক ভয়াবহ নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। তবে এই সংঘাত প্রথম শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে। সুদানের সশস্ত্র বাহিনীর (এসএএফ) প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-এর কমান্ডার মোহাম্মদ হামদান দাগালোর মধ্যে শুরু হয় ক্ষমতা দখলের লড়াই।
২৭ আক্টোবর সুদানের পশ্চিম দারফুরের সর্বশেষ প্রধান শহুরে কেন্দ্র এল-ফাশের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের দাবি করে দেশটির আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)। গত বছরের মে মাস থেকে শহরটি সেনাবাহিনীর(এসএএফ) দখলে ছিল।
এল-ফাশারের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনাগুলো, যার মধ্যে ছিল এসএএফ-এর ষষ্ঠ ডিভিশনের সদরদপ্তর এবং ১৫৭তম আর্টিলারি ব্রিগেড — এগুলো আরএসএফ দখল করেছে বলে নিশ্চিত করেছে ইয়েল হিউম্যানিটারিয়ান রিসার্চ ল্যাব-এর স্যাটেলাইট চিত্র।
ছবিগুলোতে দেখা গেছে, ২৭ অক্টোবর আরএসএফ-এর যানবাহন ও টি-৫৫ ট্যাংক, যা শহরে মোতায়েন ছিল।
স্যাটেলাইট ছবিতে গোলাবারুদের আঘাতে ভবন ধ্বংস এবং আগুনে পোড়া চিহ্ন স্পষ্ট দেখা গেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং স্থানীয় সূত্রগুলো বরছে, বিপুলসংখ্যক বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে, শহর থেকে পালানোর সময় তাদের গুলি করে মারা হয়। জাতিসংঘ উভয় পক্ষকেই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে, তবে দারফুরে আরএসএফ-এর কর্মকাণ্ড বিশেষভাবে নজর কাড়ছে।
জাতিসংঘ কর্মকর্তারাদের সতর্ক বার্তা
বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেছেন, সুদানের কোর্দোফান অঞ্চলে আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ)-এর অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে বৃহৎ পরিসরের নৃশংসতা চলছে। অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দারফুর অঞ্চলের এল-ফাশির শহরে বাসিন্দারা ভয়াবহ ‘গণ-নিপীড়নের’ শিকার হচ্ছেন।
জাতিসংঘের মানবিক প্রধান টম ফ্লেচার বলেন, ‘দারফুরের শেষ প্রধান শহর এল-ফাশার এখন র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-এর নিয়ন্ত্রণে। ইতিমধ্যেই এলাকাটি এক বিপর্যস্ত মানবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি ছিল, এখন তা অন্ধকার নরকে পরিণত হয়েছে।’
১৮ মাসেরও বেশি সময় ধরে অবরোধের পর এল-ফাশারের পতন দারফুরে ২০ বছর আগের জাতিগত গণহত্যার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা তৈরি করেছে। ফ্লেচার জানান, শহরে আরএসএফ যোদ্ধাদের প্রবেশের পর ‘বিস্তৃত গণহত্যা ও নির্বিচারে হত্যার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন’ পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা হয়তো তাদের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছি না, কিন্তু আজও সেই ভয়াবহতা চলছে — নারী ও কিশোরীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, মানুষকে বিকৃতভাবে হত্যা করা হচ্ছে।’
ফ্লেচার আরো সতর্ক করেন, সহিংসতা কেবল দারফুরেই সীমাবদ্ধ নয়। কোর্দোফান প্রদেশেও রক্তপাত চলছে। তিনি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে জানান, ‘উত্তর কোর্দোফান প্রদেশে ভয়াবহ যুদ্ধ নতুন করে বাস্তুচ্যুতির ঢেউ সৃষ্টি করছে। মানবিক সহায়তা কার্যক্রমকেও ঝুঁকির মুখে ফেলছে, বিশেষ করে প্রাদেশিক রাজধানী এল ওবেইদ শহরজুড়ে।’
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে আরএসএফের এল-ফাশিরে হামলা নিন্দা করেছে এবং বৃহৎ পরিসরের গণহত্যা, বিশেষত জাতিগত প্রণোদিত সহিংসতা বৃদ্ধির আশঙ্কা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
জাতিসংঘের আফ্রিকা বিষয়ক সহকারী মহাসচিব মার্থা পোবি পরিষদে জানান, ‘উত্তর কোর্দোফানের বারা শহর দখলের পর সেখানেও র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের হাতে ব্যাপক নৃশংসতার খবর পাওয়া গেছে।’
পোবি জানান, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে শুধু বারা শহরেই অন্তত ৫০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন, এর মধ্যে পাঁচজন রেড ক্রিসেন্ট স্বেচ্ছাসেবকও ছিলেন। তিনি সতর্ক করেন, ‘কোর্দোফান এখন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া পক্ষগুলোর পরবর্তী সামরিক লক্ষ্য হতে পারে।’
পোবি আরো জানান, ‘দুই পক্ষই ড্রোন হামলা চালাচ্ছে, যা নতুন অঞ্চল ও নতুন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানছে।’ তিনি বলেন, ‘এল-ফাশিরে ঠিক কতজন নিহত হয়েছেন তা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়, কারণ পুরো পরিস্থিতি বিশৃঙ্খল ও অনিয়ন্ত্রিত।’
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, সুদানের চলমান যুদ্ধ ইতোমধ্যেই দশ-দশ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়েছে, লাখ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে এবং এটি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটের রূপ নিয়েছে।
 
            
 
	


