অনেকের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হওয়া কঠিন যে খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনে একেবারে নতুন কিছুই নেই। অন্তত তিনটি বিষয়ে কিছুটা নমনীয়তার ইঙ্গিত রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। তবে, তাঁর বক্তব্যে কিছুটা অস্পষ্টতার কারণে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা কিছুটা সংশয় প্রকাশ করেছেন।
প্রথমত, তিনি নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে নির্দিষ্টভাবে ‘সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সরকারের’ ওপর জোর দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত দশম সংসদকে অবৈধ বলেননি, বরং প্রথমবারের মতো মেনে নিয়েছেন। এমনকি ১৯৯৬ সালের মতো একটি সংবিধান সংশোধন বিল পাস দেখতে চাইছেন। কিন্তু তাই বলে বিলুপ্ত হওয়া ত্রয়োদশ সংশোধনীর পুনরুজ্জীবন তিনি চাননি। তৃতীয়ত, চলমান অবরোধ কর্মসূচি তিনি অনির্দিষ্টকাল ধরে না চালানোরও একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। অনেকের মতে, সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না করলেও তিনি ২৬ মার্চের মধ্যে সুরাহা চান। তিনি ‘ঐক্যবদ্ধভাবে ৪৫তম স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের’ কথা বলেছেন।
প্রবীণ আইনজীবী রফিক-উল হক অবশ্য মনে করেন, ‘সুর দেখে মনে হয় নরম, কিন্তু তাতে পুলকিত হলে চলে না, কারণ, পরক্ষণেই তা উল্টে যেতে পারে।’ তাঁর কথায়, ‘আমরা ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাই।’
বেগম জিয়া তাঁর চার পৃষ্ঠার লিখিত বক্তৃতায় ‘বিরাজমান সমস্যা সমাধানে’ নির্দিষ্টভাবে তিনটি দফা দিয়েছেন। এতে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলা নেই। যদিও ওই লিখিত বক্তব্যের শেষাংশে উল্লেখ আছে, ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সকলের অংশগ্রহণে দ্রুত একটি নির্বাচনের আয়োজন করলেই কেবল চলমান সংকটের সুরাহা হবে।’ কিন্তু এটা তাঁর চাপিয়ে দেওয়া বা তাঁর একতরফা কোনো অনমনীয় অবস্থান বলা যায় না। কারণ, ওই বক্তব্যের শর্তাংশে বলা আছে, ‘এ নিয়ে ক্ষমতাসীনেরা যদি কোনো আলোচনা করতে না চায়, তাহলে সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব এককভাবে তাদের ওপরেই বর্তাবে।’
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার কথাটি এড়িয়ে চলতে বিএনপির ধারাবাহিক অবস্থান লক্ষ করা যায়। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ‘ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে’ নির্বাচনের কথা বারবার উল্লেখ করেছেন। বিএনপি এর বিরোধিতা করেনি। বিষয়টিতে কিছুটা অস্পষ্টতা থাকলেও বিএনপির আগের অবস্থান থেকে তা সরে আসার ইঙ্গিত দেয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেন, উভয় পক্ষকে ছাড় দিতে হবে। খালেদা জিয়ার কিছুটা নমনীয়তা, বিশেষ করে অবৈধ সংসদ না বলার মধ্যে, দেখা গেছে। এখন প্রধানমন্ত্রীর তরফে ছাড় দেওয়ার কথা জাতি শুনতে চায়।
১৩ মার্চের সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির নেত্রী তাঁর তিনটি দফা ক, খ ও গ দিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু সর্বশেষ দফায় রেখেছেন নির্বাচনের কথা। ক দফায় নেতা-কর্মীদের মুক্তি, গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ, তার তদন্ত ও দোষীদের শাস্তিদান এবং মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, খ দফায় সভা-সমাবেশ-মিছিলসহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর আরোপিত সকল প্রকার বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর গ দফায় বলা হয়েছে, ‘সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে সকলের অংশগ্রহণে অনতিবিলম্বে জাতীয় সংসদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে সংলাপের আয়োজন করতে হবে।’
রাজনীতিতে যুক্তিসংগত ফর্মুলার আকাল কখনো পড়েনি। তদুপরি নির্বাচন প্রশ্নে খালেদা জিয়ার সর্বশেষ বক্তব্যকে একটি অগ্রগতি হিসেবে দেখা চলে। তিনি ‘অনতিবিলম্বে’ নির্বাচন চেয়েছেন। কোনো আলটিমেটাম দেননি। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নয়, তিনি ‘সুনির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে সংলাপ’ চেয়েছেন। এমনকি যে বাক্যে তিনি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দ্রুত নির্বাচন চেয়েছেন, সেখানেও তিনি ‘সকলের অংশগ্রহণ’ কথাটি উল্লেখ করতে ভোলেননি। কারণ, তাঁকে এই বাস্তবতা স্বীকার করতে হয় যে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না।
সাবেক আইনমন্ত্রী ও সরকারদলীয় সাংসদ আবদুল মতিন খসরু বলেন, বিএনপির নেত্রী আইনের চোখে ফেরার। তাঁর মুখে এখন আরও আন্দোলন চালানোর আহ্বান হৃদয়বিদারক, অমানবিক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। এত মৃত্যু ও ধ্বংসের পরেও তিনি অনমনীয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, বিএনপির নেত্রীর প্রস্তাবে নমনীয়তার আভাস স্পষ্ট। শুধু তত্ত্বাবধায়কের অধীনেই নির্বাচন করতে হবে তা বলা নেই। তৃতীয় কোনো ফর্মুলার দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত আছে। নতুন একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। এখন সরকার কীভাবে অগ্রসর হয়, সেটা দেখার বিষয়।