পানির দামে দুধ বিক্রি, হুমকির মুখে দুগ্ধ শিল্প

SHARE

করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাপক ক্ষতির মধ্যে পড়েছে দেশের দুগ্ধ খামারিরা। বর্তমানে দেশের সকল মিষ্টিজাতীয় দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা দুধ বিক্রিতে বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। বাধ্য হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার খামারিদের পানির দামে দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে ১৫-২০ টাকা লিটার। আবার অনেক খামারি দুধ বিক্রিও করতে পারছেন না।

বর্তমানে দেশে প্রায় সাড়ে তিন লাখ দুগ্ধ খামার রয়েছে, যেখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ যাদের জীবন জীবিকা এই দুগ্ধ শিল্পের উপর নির্ভর করে। বর্তমানে দেশে বার্ষিক প্রায় ৯৯ লাখ মেট্রিক টন দুধ উৎপাদন হচ্ছে, যা মোট চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ। দেশের এ পরিস্থিতিতে প্রতিদিন ১৫০ লাখ লিটার দুধ অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। এতে খামারিদের দিনে প্রায় ৫৭ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। সরকার ও দেশের দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতের কম্পানিগুলোর সহযোগিতা না পেলে অচিরেই প্রায় ৫০ শতাংশ খামার বন্ধ হয়ে যাতে পারে।

কুষ্টিয়া জেলা ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও লিয়াকত আলী ডেইরি ফার্মের মালিক মো. জাকিরুল ইসলাম জানান, আমার ফার্মে বর্তমানে ৫০টি গাভী রয়েছে। দৈনিক সাড়ে ৩ শত লিটার দুধ উৎপাদন হয়। আগে পাইকারিভাবে মিষ্টির দোকানে ৫০-৬০ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি হতো। গত কয়েকদিন ধরে সারা দেশের মিষ্টির দোকানগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় আমরা মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে রয়েছি।

এদিকে আবার গো-খাদ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েই চলছে। এক সপ্তাহ আগেও পাইকারি হিসেবে প্রতি লিটার দুধ ৪৫ থেকে ৫০ টাকা বিক্রি হলেও এখন খুচরা বাজারে ২০ থেকে ৩০ টাকা লিটার দরে বিক্রি করছি, তাও মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে জোর করে দিতে হচ্ছে। এরপরও আমাদের বিপুল পরিমাণ দুধ অবিক্রীত রয়ে যাচ্ছে। প্রতি মাসে আমার ফার্মে প্রায় ৪ লাখ টাকার গো-খাদ্য লাগে। ৪ জন কর্মচারী রয়েছে তাদের বেতনও দিতে হবে। এ সংকট দ্রুত নিরসন না হলে আমাদের মতো খামারিদের গরু বেচে দিয়ে পথে বসতে হবে।

ফরিদপুর জেলা ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও মার্শ এগ্রোর মালিক মীর কাশেম আলী জানান, ফরিদপুরে ছোট-বড় ১ হাজারের ওপরে দুগ্ধ খামার রয়েছে। আমার খামারে বর্তমানে ২০টি গাভী রয়েছে, দৈনিক দুধ উৎপাদন হয় ১২০ লিটার। এ এলাকায় আরও বড় বড় খামার রয়েছে যারা দৈনিক ৫০০-৬০০ লিটার পর্যন্ত দুধ উৎপাদন করে। কোনো উপায় না পেয়ে তাদেরকেও এখন দুধ নিয়ে লোকাল বাজারে বাজারে খুচরাভাবে ১৫-২০ টাকা লিটার দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। তাও অর্ধেক দুধ বিক্রি করতে পারছে না খামারিরা। এখন সারা দেশের সব খামারিরই একই অবস্থা বলে জানান তিনি। এভাবে যদি আগামী ৭ দিন চলে তাহলে আমাদের খামারগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। এ খামারগুলো যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে আগামী ২০ বছরেও নতুন করে আর খামার গড়া সম্ভব হবে না। তাই আমি সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি আমাদেরকে প্রণোদণার প্যাকেজ ঘোষণা করে আমাদের দেশের খামারিদের বাঁচান।

বরিশাল বিভাগীয় ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মানিক ডেইরি ফার্মের মালিক কামরুল হাসান খোকন জানান, বরিশাল বিভাগে বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে ৩ হাজার ২০০ দুগ্ধ খামার রয়েছে। দৈনিক দুধ উৎপাদন হয় ২ হাজার ১৪৮ মেট্রিক টন। এ খামারিদের উৎপাদিত দুধগুলোর বেশি অংশই বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে নেওয়া হতো। আর কিছু অংশ দেশের দুগ্ধ প্রসেসর কম্পানিগুলো ও বাসা বাড়িতে নিতেন। এখন খামিরা দুধ বিক্রি করার জন্য মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ২০-২৫ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি করছেন। তার পরেও অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে। অবিক্রিত দুধগুলো না ফেলে বাধ্য হয়ে বিনামূল্যে এলাকার মানুষদের দিয়ে দিতে হচ্ছে। বর্তমানে ১ কেজি গো-খাদ্যের দাম পরে ৩৩ টাকা। আর এখন ১৫-২০ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি করতে পারছি না।

ময়মনসিংহ বিভাগীয় ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হামিদ সরকার জানান, বর্তমানে ময়মনসিংহ বিভাগে ছোট-বড় মিলিয়ে ৭০০ দুগ্ধ খামার রয়েছে। দৈনিক উৎপাদন হয় দেড় লাখ লিটার দুধ। এ দুধগুলো আগে মিষ্টির দোকানদার ও দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কম্পানি মিল্ক ভিটা নিতেন খামারিদের কাছ থেকে। এখন দেশের মার্কেটগুলো বন্ধ থাকায় মিল্ক ভিটাও নিচ্ছেন না। খামারিরা এখন নামমাত্র মুল্যে মানুষের কাছে বিক্রি করছেন। তার পরেও অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে অনেক দুধ। এখন মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে খামার চালাতে হচ্ছে। দুধ বিক্রি না হলেও তো গাভীকে খাবার খাওয়াতে হয়।

বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ এমরান জানান, দেশের দুগ্ধ খামার শিল্পে বর্তমানে সাড়ে ৩ লাখ দুগ্ধ খামার রয়েছে। এখানে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থেকে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন। বর্তমানে দেশে বার্ষিক প্রায় ৯৯ লাখ মেট্রিক টন দুধ উৎপাদন হয়, যা মোট চাহিদার ৭০ শতাংশ। দেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৫০ লাখ লিটার দুধ অবিক্রিত থেতে যাচ্ছে, এতে খামারিদের দিনে প্রায় ৫৭ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের মিষ্টি দোকানগুলো বন্ধ থাকায় প্রান্তিক পর্যায়ে ১জন খামারিদের দুধ বিক্রি করতে চরম অসুবিধা হচ্ছে, কোথাও কোথাও দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে ১০ থেকে ১২ টাকা লিটার।

এমত অবস্থায় সরকার ও দেশের দুগ্ধ প্রসেসর কম্পানিগুলো আমাদের সহযোগিতায় না আসলে দেশের দুগ্ধ শিল্প ধংস হয়ে যাবার উপক্রম হবে। আমাদের দেশে ৩ টি বড় কম্পানির প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ লিটার দুধ সংগ্রহ করে গুঁড়া দুধ তৈরির সক্ষমতা আছে। পাশাপাশি প্রায় আরো ১০-১২ টি কম্পানির দুধ জাতীয় পণ্য যেমন- ঘি, মাখন, ফ্লেভারড মিল্ক, আইসিক্রিম, ক্রিম তৈরি করার সক্ষমতা আছে। সরকার প্রধান ও দেশের দুগ্ধ প্রসেসর কম্পানিগুলো থেকে এই সহযোগিতা না পেলে অচিরেই গড়ে ওঠা প্রায় ৫০ শতাংশ খামার বন্ধ হয়ে যাবে।