বোলিংও ব্যাটিংয়ে হতাশা

SHARE

cricket

মাশরাফি বিন মুর্তজার কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেল নিউজিল্যান্ড। হ্যাগলি ওভালের ব্যাটিং স্বর্গে ২৮০-৩০০ রানকে কোনো ব্যাপার মনে করছিলেন না বাংলাদেশ অধিনায়ক। তাই বলে ৩৪১! এত বড় লক্ষ্য সামনে চলে আসার পর মাশরাফিও হয়তো দেখেননি জয়ের স্বপ্ন। তবু যেরকম ব্যাটিং করে ৭৭ রানে হারল বাংলাদেশ, সেটা কি মেনে নিতে পারছেন মাশরাফি?

থিতু হতে পারলে হ্যাগলি ওভালের উইকেটে ব্যাটিং করাটা আসলেই স্বর্গীয় অনুভূতি দেয়। গাঢ় সবুজ মাঠের চারপাশটাও সবুজ গাছ-গাছালিতে ভরা। সুন্দর ক্রিকেট খেলার এবং দেখার অসাধারণ এক প্রেক্ষাপট। মাঠটাও একটু ছোট। দুটি ভালো ইনিংস, ভালো জুটি হলে ৩৪২-ও তাড়া করা অসম্ভব ছিল না। আর তিন শর বেশি রান তাড়া করে বাংলাদেশ কখনো জেতেনি, তা তো নয়! ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও আছে সে গৌরব।

কিন্তু আসল কাজটা ঠিক না হলে ঘরের মাঠ, পরের মাঠ সবই সমান। ব্যাটিং স্বর্গও তখন নরকযন্ত্রণা এনে দিতে পারে ব্যাটসম্যানদের। যেমন আজ হলো হ্যাগলি ওভাল। আগের দিনও যে উইকেটে ২৮০-৩০০ রান করাটাকে স্বাভাবিক মনে করেছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক, নিউজিল্যান্ডের ৩৪১ রানের সামনে সেখানেই বাংলাদেশ অলআউট ২৬৪ রানে।

বোলারদের দায় আছে নিউজিল্যান্ডের স্কোরটাকে নাগাল-ছাড়া হতে দেওয়ায়। কিন্তু ব্যাটসম্যানদের দায় তো কম নয়। ব্যাটিং-বান্ধব উইকেটে বাংলাদেশের ব্যাটিং হলো পুরোই এলোমেলো। প্রথম ১০ ওভারেই ৪২টি ডট। তার চেয়েও বড় কথা, সিঙ্গেল মাত্র চারটি! শুরু থেকেই কতটা নেতিবাচক মানসিকতায় ব্যাটিং করেছে বাংলাদেশ!

সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম ও মোসাদ্দেক হোসেন অবশ্য ব্যতিক্রম ছিলেন। ৪৬ বলে ৪২ রান করে মুশফিক তো চোট নিয়ে শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে গেলেন। রান আউট থেকে বাঁচতে ডাইভ দিয়েছিলেন পরে আর নামতে পারেননি। আর সাউদির বলে মোস্তাফিজ বোল্ড হওয়ার ঠিক আগের বলেই ওয়ানডেতে নিজের প্রথম ফিফটির দেখা পান মোসাদ্দেক। সবচেয়ে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছিলেন এই তরুণই। ৪৪ বলে ৫০ করেছেন, কিন্তু একবারও মনে হচ্ছিল না অতি আক্রমণাত্মক খেলছেন। কিন্তু শুরুটা এমন হলে আটে নেমে তিনিই বা কী করবেন!

শুরুর এই দায় ইমরুলের কাঁধে যায় কিছুটা। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে সাউদিকে ফিরতি ক্যাচ দিয়েও বেঁচে যাওয়া ইমরুল ওই ওভারেই ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগ দিয়ে মারলেন দুর্দান্ত ছক্কা। এক বল পর বাউন্ডারি। এই আত্মবিশ্বাস ইমরুল ধরে রেখেছেন নিজের ১৬ রানের ইনিংসের শেষ পর্যন্ত। অষ্টম ওভারে সাউদির বলে নিশ্চিত কট বিহাইন্ড হওয়ার পরও নইলে রিভিউ চাইবেন কেন? ব্যাটসম্যানের ব্যাটে বল লেগেছে কি না, সেটা তো সবচেয়ে ভালো জানার কথা তারই।

৩৪ রানে ইমরুলের বিদায়ের পর দলকে ৪৮ রানে রেখে এক ওভারেই ফিরে আসেন সৌম্য সরকার ও মাহমুদউল্লাহ। তামিম-সাকিবের ৩৩ রানের জুটি কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ইদানীং ধীরে চলো নীতিতে শুরু করা তামিম ৫৯ বলে ৩৮ করে ফিরে যাওয়ার পর বাংলাদেশ তাকিয়ে ছিল সাকিব আর মুশফিকের দিকে। ৮১ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ তখন ভীষণই চাপে।

সাকিব-মুশফিক ৬৬ রানের পঞ্চম উইকেট জুটিতে ভালোই পাল্টা জবাব দিচ্ছিলেন। ৫৪ বলে ৫৯ রানে সাকিব ছক্কা মেরেছেন দুটি, বাউন্ডারি পাঁচটি। অবশ্য ফার্গুসনের বলে মিড অনে ক্যাচ তুলে আউট হতে হতে বেঁচেও গেছেন একবার। পরের বলে নিজের দ্বিতীয় ছক্কাটি মেরে সাকিব আউট হন ওই ওভারেরই তৃতীয় বলে। এত কষ্ট করে ইনিংস গড়ার সব চেষ্টা তো ম্লান হয়ে গেল এভাবে আউট হওয়াতে।

ম্যাচটা তো আসলে পঞ্চম উইকেট জুটিতেই নির্ধারিত হয়ে গেল! সাকিব-মুশফিক জুটিটা ল্যাথাম-মানরোর পাল্টা জবাব হয়ে আসতে পারল কই! ১৫৮ রানের সেই জুটিতে ৭ উইকেটে ৩৪১ করে নিউজিল্যান্ড। বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডেতে তাদের সর্বোচ্চ রান। বাংলাদেশের বিপক্ষে যেকোনো উইকেট জুটিতে নিউজিল্যান্ডের নতুন রেকর্ড এটি। সেঞ্চুরি করেছেন ওপেনার টম ল্যাথাম। ৪৭ ওয়ানডের ক্যারিয়ারে মাত্র দুটি সেঞ্চুরির মধ্যে আজকেরটিই বড়। এত ‘সর্বোচ্চে’র দিনে মানরোই আর বসে থাকবেন কেন? ৬১ বলে ৮৭ রানের ঝোড়ো ইনিংসটি এখন পর্যন্ত ওয়ানডেতে তাঁরও সর্বোচ্চ।

উইকেটে রান আছে আগেই বোঝা গিয়েছিল। তাই বলে এ রকম রান বন্যা আশা করেনি কেউই। নিউজিল্যান্ডের মাঠের আকৃতি তুলনামূলকভাবে ছোট হলেও হ্যাগলি ওভালের দুই পাশের বাউন্ডারি যথেষ্ট বড়। ল্যাথাম তো সেঞ্চুরিও পূর্ণ করলেন তাসকিন আহমেদের শর্ট বলে মিড উইকেট দিয়ে ছক্কা মেরে। সেটি সহ ল্যাথামের ছক্কা চারটি, সমান ছয় মানরোরও।

উইকেটের ব্যাটিং-বন্ধুতা কাজে লাগিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা। কিন্তু এ রকম উইকেটে বোলিংটা যেমন হওয়া উচিত, সেটা কি করতে পেরেছেন বাংলাদেশের বোলাররা?

ইনিংসের ষষ্ঠ ওভারে ওপেনার মার্টিন গাপটিলকে কাটারে ফিরিয়েছেন মোস্তাফিজুর রহমান। দীর্ঘ চোট কাটিয়ে ফেরা বাঁহাতি পেসার কিছুটা হলেও আশা জাগিয়েছিলেন তখন।

১৫৮ রানে নিউজিল্যান্ডের ৪ উইকেট ফেলে দেওয়ার পর পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। সাকিব ছাড়া কারও বোলিংয়েই চিন্তার ছাপ ছিল না। এ ধরনের উইকেটে ব্যাটসম্যানরা ভুল না করলে বোলারদের সাফল্য পাওয়া কঠিন। কিন্তু ব্যাটসম্যানদের ভুলের ফাঁদে তো ফেলতে হবে। সেই চেষ্টাও দেখা যায়নি।

এক ​দিক দিয়ে দেখলে এ ম্যাচেও আশাবাদী হওয়ার মতো অনেক কিছু খুঁজে নিতে পারে বাংলাদেশ। ৩১ বল বাকি থাকতে এভাবে অলআউট না হলে বাংলাদেশের স্কোরটাও আরও বড় হতে পারত। কিংবা মুশফিক যদি এমন চোটে না পড়তেন। কিন্তু এর কোনোটাই দলের খুঁতগুলো আড়াল করবে না। কারণ বাংলাদেশ দল নিজেরাই ভালো জানে, আজ যা হয়েছে, তার চেয়ে তারা অনেক ভালো। সেই ‘ভালো’র প্রত্যয় নিয়েই কাল নেলসনে যাবে মাশরাফির দল।

সংক্ষিপ্ত স্কোর
টস: নিউজিল্যান্ড
নিউজিল্যান্ড: ৫০ ওভারে ৩৪১/৭ (ল্যাথাম ১৩৭, মানরো ৮৭, উইলিয়ামসন ৩১; সাকিব ৩/৬৯, মোস্তাফিজ ২/৬২, তাসকিন ২/৭০, মাশরাফি ০/৬১)।
বাংলাদেশ: ৪৪.৫ ওভারে ২৬৪/১০ (তামিম ৩৮, ইমরুল ১৬, সৌম্য ১, মাহমুদউল্লাহ ০, সাকিব ৫৯, মুশফিক ৪২, সাব্বির ১৬, মোসাদ্দেক ৫০, মাশরাফি ১৪, তাসকিন ২, মোস্তাফিজ ২; নিশাম ৩/৩৬, ফার্গুসন ৩/৫৪, সাউদি ২/৬৩)।
ফল: নিউজিল্যান্ড ৭৭ রানে জয়ী
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: টম ল্যাথাম