১১ সপ্তাহ পর গাজায় ত্রাণ ঢুকল, জাতিসংঘ বলছে ‘সমুদ্রে এক বিন্দু জল’

SHARE

ইসরায়েল ১১ সপ্তাহ পর গাজা উপত্যকায় জাতিসংঘের পাঁচটি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে, যাতে শিশু খাদ্যসহ জরুরি ত্রাণসামগ্রী রয়েছে। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা প্রধান এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও একে বিশাল সাগরে এক বিন্দু পানির ফোঁটার সমান বলে জানিয়েছেন।

তিনি জানায়, ‘প্রয়োজনীয় ত্রাণের সাগরের এক বিন্দু পানি’।’ যুদ্ধবিধ্বস্ত এই অঞ্চলে বসবাসরত ২১ লাখ ফিলিস্তিনির জন্য তা যথেষ্ট নয় বলে সতর্ক করেছেন তিনি।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের মিত্রদের চাপের মুখে ‘সামান্য’ পরিমাণ খাদ্য প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

মানবিক সহায়তা প্রধান বলেন, ‘আমরা দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতিতে যেতে পারি না—ব্যবহারিক ও কূটনৈতিক—দুই দিক থেকেই এটি অনুচিত।’ তবে তিনি জানিয়েছেন, এই খাদ্য সহায়তা সাময়িক, যতক্ষণ না ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও বেসরকারি সংস্থাগুলো যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত একটি পরিকল্পনার আওতায় ত্রাণ বিতরণের কেন্দ্র স্থাপন করতে পারে। এই পরিকল্পনাটি জাতিসংঘ প্রত্যাখ্যান করেছে।

নেতানিয়াহু ঘোষণা করেছেন, গাজার সব এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে ইসরায়েলি বাহিনী। রবিবার থেকে তারা হামাসের বিরুদ্ধে নতুন বিস্তৃত স্থল অভিযানে নামার পর এই ঘোষণা দেওয়া হয়। এদিকে গতকাল সোমবার ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজাজুড়ে অন্তত ৪০ জন নিহত হয়েছেন। নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরের একটি স্কুলে আশ্রয় নেওয়া পরিবারদের ওপর এক হামলায় অন্তত পাঁচজন নিহত হন।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা ওই এলাকায় হামাসের একটি কমান্ড সেন্টার লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।
তারা দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস শহর ও তার পূর্ব উপশহর খালি করে দিতে বলেছে, কারণ সেখানে হামলা চালানো হবে বলে সতর্ক করা হয়েছে।

গত ২ মার্চ ইসরায়েল গাজায় সব ধরনের মানবিক ও বাণিজ্যিক সরবরাহ বন্ধ করে দেয় এবং দুই সপ্তাহ পর আবার সামরিক অভিযান শুরু করে। এতে দুই মাসের যুদ্ধবিরতি শেষ হয়। এই অভিযান এবং অবরোধের কারণে ৪ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং তিন হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
জাতিসংঘ বলেছে, এতে খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে।

হামাস-শাসিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, গত ১১ সপ্তাহে অপুষ্টিজনিত কারণে ৫৭ শিশু মারা গেছে। জাতিসংঘ সমর্থিত সংস্থা আইপিসি জানিয়েছে, প্রায় ৫ লাখ মানুষ ক্ষুধামারিতে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।

জাতিসংঘ বলেছে, আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীনে ইসরায়েলের দায়িত্ব গাজার জনসাধারণের জন্য খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহ নিশ্চিত করা। তবে ইসরায়েল দাবি করছে, যুদ্ধবিরতির সময় হাজার হাজার ট্রাক ত্রাণ প্রবেশ করেছিল এবং হামাস সেগুলো লুট করেছে। হামাস এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

মিত্রদের চাপের মুখে রবিবার রাতে নেতানিয়াহুর কার্যালয় ঘোষণা দেয়, ‘জনগণের জন্য একেবারে মৌলিক খাদ্যসামগ্রী প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে যাতে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি না হয়।’ তবে এই সিদ্ধান্তে ডানপন্থী নেতারা ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
নেতানিয়াহু বলেছেন, মানবিক নয়, বরং কৌশলগত কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘দুর্ভিক্ষ যাতে না হয়, কেবল সে কারণেই আমরা এই সামান্য সহায়তা দিচ্ছি।’

তিনি আরো জানান, নতুন একটি ত্রাণ বিতরণ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে, যেখানে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থা ত্রাণ বিতরণ করবে, যা আইডিএফ এবং নিরাপত্তা কম্পানির সহায়তায় পরিচালিত হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি দুর্ভিক্ষের ছবি দেখাই, তাহলে তা আমাদের কৌশলগত পরাজয় হয়ে উঠবে।’

ইসরায়েলের আরেক মন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ বলেন, এই সামরিক অভিযান মূলত ফিলিস্তিনিদের গাজার দক্ষিণে ঠেলে দেওয়া এবং সেখান থেকে ঈশ্বরের ইচ্ছায় তৃতীয় দেশে পাঠানোর জন্য পরিকল্পিত।

যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডার নেতারা এই সহায়তা উদ্যোগকের সমালোচনা করেছেন। তারা হুঁশিয়ার করে বলেছেন, ইসরায়েল যদি সহিংসতা না থামায় এবং মানবিক সহায়তার ওপর নিষেধাজ্ঞা না তুলে নেয়, তাহলে তারা আরো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। নেতানিয়াহু এর জবাবে বলেন, এভাবে সমর্থন বন্ধ করে তারা ৭ অক্টোবরের হামলার জন্য ‘পুরস্কার’ দিচ্ছে।

সোমবার সন্ধ্যায় ইসরায়েলের সামরিক সংস্থা সিওজিএটি জানিয়েছে, আইডিএফ কর্মকর্তাদের সুপারিশে এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পাঁচটি জাতিসংঘের ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে। জাতিসংঘের মানবিক প্রধান টম ফ্লেচার ইসরায়েলের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানালেও এটি প্রয়োজনের তুলনায় এক ফোঁটা মাত্র বলে অভিহিত করেছেন। আরো বেশি ত্রাণ প্রবেশের জন্য অনুমতি দেওয়ার আহবান জানান তিনি।

ইসরায়েল জানিয়েছে, আগামী দিনে আরো অনেক ত্রাণ ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চ্যারিটি ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেনের প্রধান হোসে আন্দ্রেস বলেছেন, ‘এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে সপ্তাহ লাগবে। ততদিনে মানুষ না খেয়ে থাকবে।’

জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থা জানিয়েছে, তারা ইতিমধ্যেই ৮ হাজার ৯০০ ট্রাক ত্রাণ প্রস্তুত রেখেছে এবং একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও কার্যকর পদ্ধতি রয়েছে ত্রাণ বিতরণের জন্য। তারা ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে।

তারা সতর্ক করেছে, নতুন পরিকল্পনায় চলাফেরায় অক্ষম, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীরা বাদ পড়বে, আরো বাস্তুচ্যুতি ঘটবে এবং সহায়তা প্রদান রাজনৈতিক শর্তসাপেক্ষ হয়ে উঠবে—যা বৈশ্বিকভাবে মানবিক নীতির পরিপন্থী।

খান ইউনিসের পশ্চিমের উপকূলীয় এলাকা আল-মাওয়াসিতে এক বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি আবদ আল-ফাতাহ হুসেইন বলেছেন, তার পরিবার বর্তমানে দিনে এক বেলা খাবার পাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রী পাওয়া খুব কঠিন হয়ে গেছে—প্রায় অসম্ভব। যদি পাওয়া যায়ও, দামে তা অতিরিক্ত চড়া।’

গাজাভিত্তিক দাতব্য সংস্থা ‘শাবাব গাজা’র প্রধান মোহাম্মদ আবু রিজলাহ বলেছেন, তারা সোমবার মাত্র ২ হাজার ৫০০ খাবার বিতরণ করতে পেরেছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম।

নেতানিয়াহু বলেন, ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় ‘ব্যাপক লড়াই’ চালাচ্ছে এবং অগ্রগতি করছে। তিনি বলেন, ‘আমরা গাজার সব এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেব, এটাই আমাদের লক্ষ্য।’

তিনি আরো বলেন, এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য হামাসকে পরাজিত করা এবং এখনো জীবিত থাকা ২৩ জনসহ ৫৮ জন বন্দিকে মুক্ত করা। আইডিএফের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি দেফরিন জানান, পাঁচটি ডিভিশন এই অভিযানে অংশ নিচ্ছে এবং অঞ্চল ভাগ করে জনগণকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হবে।

ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যস্থতাকারীরা কাতারে থাকলেও যুদ্ধবিরতি ও বন্দি মুক্তির বিষয়ে এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে উভয়পক্ষ জানিয়েছে। ইসরায়েল এই সামরিক অভিযান শুরু করে ৭ অক্টোবর ২০২৩ সালে হামাসের এক আকস্মিক আক্রমণের পর, যাতে ১ হাজার ২০০ মানুষ নিহত হয় এবং ২৫১ জনকে বন্দি করা হয়। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, এরপর থেকে অন্তত ৫৩ হাজার ৪৭৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৩ হাজার ৩৪০ জন নিহত হয়েছেন সর্বশেষ সামরিক অভিযানে।

সূত্র : বিবিসি