ফরিদপুরে চরভদ্রাসনের ১৩ বছর বয়সী মেয়েশিশু পারুলকে (ছদ্মনাম) অপহরণের পর গণধর্ষণ করে বাড়ির কাছের পাটক্ষেতে মুমূর্ষু অবস্থায় ফেলে রেখে যায় নরপশুরা। এ ঘটনায় সাতজনকে আসামি করে তার পিতা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(৩) ধারায় অপহরণ ও গণধর্ষণের মামলা করেন। ঘটনার ৪০ দিন পর মেডিকেল সনদ এ মর্মে প্রত্যয়ন করে যে, মেয়েটির বয়স ১৭ বছর, তার শরীরে জোরপূর্বক যৌনসঙ্গমের চিহ্ন নেই, সে যৌনসঙ্গমে অভ্যস্ত। এই সনদের ভিত্তিতে সাতজনের মধ্যে পাঁচ অভিযুক্ত ব্যক্তি বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।
বাকি দু’জন অভিযুক্তের একজনের সঙ্গে পারুলের পূর্বপরিচয় থাকার কারণে আদালত তিনটি সূত্রে তদন্ত কর্মকর্তাকে পুনরায় তদন্ত করার নির্দেশ দেন। নির্দেশনা তিনটি হলো_ ‘ভিকটিমের ভালোবাসার সূত্রগুলো ভালোভাবে দেখিতে হইবে’, ‘প্রত্যক্ষ, নিরপেক্ষ ও স্থানীয় লোকজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করিতে হইবে’ এবং ‘তদন্তপূর্বক আসামিকে গ্রেফতার করিতে হইবে।’পরবর্তী সময়ে দুই অভিযুক্তের একজন সাক্ষ্য আইনের মাধ্যমে ভালোবাসার সম্পর্ক এবং মেয়েটির সঙ্গে তার অপর বন্ধুর শারীরিক সম্পর্ক রয়েছে, সে ‘খারাপ চরিত্রের’_ এই সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে অপহরণ ও ধর্ষণের মামলাটি খারিজ হয়ে যায় এবং আসামিরা খালাস পেয়ে যায়।
সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারা অনুসারে, কোনো ব্যক্তি যখন বলাৎকার বা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারিতে সোপর্দ হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে, অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা। এ ধারাকেই নারীর প্রতি চরম অবমাননা বলে মনে করছেন নারী অধিকার কর্মী ও মানবাধিকার কর্মীরা। তারা বলছেন, আদালতে আপত্তিজনক ও অপমানকর প্রশ্নোত্তর পর্ব নির্যাতিতাকে বিব্রত করে তোলে। তা ছাড়া সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) নম্বর ধারা অনুযায়ী আগে যৌন অভিজ্ঞতা
রয়েছে_ এমন নারীর সাক্ষ্যকে ধর্ষণ প্রমাণে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। কোথাও বিবাহিত নারীরা ধর্ষণের শিকার হলে সেটাও প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য হয়।মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম সমকালকে বলেন, ২০০০ সালে বিচারপতি বিপি জীবন রেড্ডির নেতৃত্বাধীন আইন কমিশনের সুপারিশক্রমে ভারত সরকার ২০০৩ সালে এ ধারা বাতিল করেছে। তিনি প্রশ্ন করেন, অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক থাকলে, অভিযুক্ত চেনা হলে ধর্ষণ হয় না? বিবাহিত নারী ধর্ষণের শিকার হয় না? মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী নারীবিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিক প্রতিকূল প্রেক্ষাপট দমনে সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারা সম্পূর্ণ বাতিলের দাবি জানান তিনি।
ধর্ষন মামলার ক্ষেত্রে অপরাধী নয়, ভিকটিমই স্বয়ং বিচারের মুখোমুখি থাকেন। অধিকাংশ ঘটনায় ‘চরিত্র ভালো না’ প্রমাণ করার তাড়না থেকে ভিকটিমকে ইঙ্গিতপূর্ণ প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন বিপক্ষ আইনজীবীরা। জেরা চলে প্রকাশ্য আদালতে। জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ফাওজিয়া করিম ফিরোজ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে সমকালকে বলেন, আদালতকক্ষে চরিত্র সংক্রান্ত বিষয়ে অভিযুক্ত পক্ষের উকিলের প্রশ্ন প্রসঙ্গে বাদীপক্ষ আপত্তি তুললে স্বয়ং বিচারক কখনও বলে ওঠেন_ ‘আপনি প্রশ্ন করতে দেন, দেখেন না কী বের হয়।’
মির্জাপুর অঞ্চলের আড়তদার পরিবারের বউ শিমুল (ছদ্মনাম)। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় স্বামী যখন প্রবাসে পাড়ি জমান তখন তিনি সন্তানসম্ভবা। কিন্তু সে বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেল মেঝেতে ফেলে রাখা তেলে আছাড় খেয়ে পড়ে। সে সঙ্গে শুরু হলো মেজো দেবরের উৎপাত। ফোনে স্বামীকে সবকিছু জানানোর পর স্বামী বললেন, মানিয়ে নাও, কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।বিয়ের ১৬ মাসের মাথায় মেজো দেবর হাতে এসিড নিয়ে যৌনকাজের প্রস্তাব দিলে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে বাল্বে রাখা এসিড শিমুলের শরীর পুড়িয়ে দেয়। চিৎকাররত অবস্থায় শাশুড়ি, দুই ননাস এবং মেজো দেবর মিলে এসিডদগ্ধ শিমুলের শরীরে মোমবাতি দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়।
ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) আসার পর টানা তিন বছর মামলা চলতে থাকে। শেষমেশ ২০১০ সালে স্বামীর ডিভোর্সের পরবর্তী সময়ে ধর্ষণের হুমকি এবং এসিড-সন্ত্রাসের মামলায় শিমুলের বিরুদ্ধে ‘স্বামী প্রবাসে থাকা অবস্থায় একাধিক দেবর ও বহিরাগতকে যৌনকাজের প্রস্তাব দিয়েছেন’ এবং ভাবির কুপ্রস্তাবে দেবর রাজি না হওয়ায় ‘অর্থের লোভে পারুল নিজের শরীরে মোমবাতি দিয়ে আগুন লাগিয়ে মিথ্যা মামলা সাজিয়েছেন, শিমুলের চরিত্র খারাপ’ এই সাক্ষ্য দেওয়ায় নারী নির্যাতন মামলা খারিজ হয়ে যায়।
ব্লাস্টের গবেষক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা সমকালকে বলেন, ধর্ষণ যতটা না নারীর প্রতি সহিংসতা, নারীর শরীরের প্রতি সহিংসতা, তার চেয়ে বেশি অপরাধী এবং অনৈতিক ধর্ষণকে নৈতিকতা, পবিত্রতা, সম্মান, সম্ভ্রম, সতীত্বের কাঠামোর মধ্যে দেখা হয়। এই বাস্তবতায় ধর্ষণ মামলাগুলো প্রায়ই ভিকটিমের ‘চরিত্রহননের’ ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। অপরাপর আর কোনো মামলার ধরনেই সাক্ষ্য এত জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে না, যতটা একজন সাক্ষী সাক্ষ্য আইনের মারফত ধর্ষণ মামলার ভিকটিমের চরিত্র-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রভাব ফেলতে পারে।তিনি বলেন, ভিকটিমের বিগত যৌন ইতিহাস নিয়ে কথোপকথন ও জিজ্ঞাসাবাদের সংস্কৃতি চালু থাকার দরুন শতকরা ৯০ ভাগ মেয়েশিশু ও নারী ধর্ষণ মামলার অভিযোগ আনতে ভয় পান। কেউ কেউ মামলা মাঝপথে বন্ধ করে দেন। অনেক সময় আসামিপক্ষের উকিলের জেরায় ভিকটিম নারী মানসিক, সামাজিক ও শারীরিকভাবে ট্রমাটাইজড হয়ে পড়েন, এমনকি আত্মহননের পথও বেছে নেন। আমাদের উচিত, এ অবস্থার উন্নয়নে সম্মিলিতভাবে কাজ করে যাওয়া।