দুই ‘চ’ শেষ করে দিল

SHARE

shoyanবেস্ট সেলার৷ হতে হতেও হলো না৷ গল্পটা৷ অথচ চরিত্র ছিল৷ নানা বাঁক ছিল৷ সেয়ানে-সেয়ানের কোলাকুলি ছিল৷ রোমহর্ষক মুহূর্ত ছিল৷ বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে শিরায় শিরায় শিরশিরানি অনুভবও ছিল৷ কিন্তু না, গল্পের শেষটা জানার পর মনের মধ্যে কষ-কষ ভাবটা জেগে উঠল! কেন? চাপ আর চোকার্স– দুই ‘চ’র গেরোতে ফের হোঁচট খেল দক্ষিণ আফ্রিকা৷

দুর্ধর্ষ বললেও কম বলা হয় যে দলের বোলারদের৷ মারকাটারি বললেও কম বলা হয় যে দলের ব্যাটসম্যানদের৷ সেই দলই কি না ‘চোকার্স’র খোলসে আবার বন্দী করে ফেলল নিজেদের! শেষ বেলায় বাঁধুনিটা আঁটোসাঁটো করতে করতে ওরা এতটাই করে বসল যে, সেটাই হয়ে গেল ফাঁসি! একটা বলও গলতে দেবে না, পণ নিয়ে একের পর এক ক্যাচ ফেলল! সহজ রান আউটের সুযোগ নষ্ট করল! চাপ নিতে যে প্রোটিয়ারা এই ২০১৫-তেও শেখেনি সেটাই প্রমাণ করে বসল৷ হ্যাঁ, হ্যাঁ, আবারও৷ নিউজিল্যান্ডের ৪ উইকেটে জয়ের কৃতিত্বকে ছোট করার কোনো উদ্দেশ্য নেই৷ তবে, ম্যাচটার শেষে যে বিরক্তি, উদ্বেগ, মনের কষ-কষ ভাবখানার কথা আগে বলেছি, তার জন্য ডি’ভিলিয়ার্সরাই দায়ী৷

ম্যাচটার শেষের ওভারগুলো নিয়ে আরও অনেক কিছু বলার, লেখার আছে৷ তবে, এবার ফিরছি শুরুতে৷ সেই যখন মেঘে ঢাকা আকাশ৷ সূর্য উঠতেই প্রায় এক ঘণ্টা চলে গেল৷ তার আগেই দক্ষিণ আফ্রিকা ২ উইকেট হারিয়েছে৷ মেঘলা আবহটা পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করল নিউজিল্যান্ডের জোরে বোলার সাউদি, হেনরি, বোল্ট৷ টিম সাউদি নিজের দিকটা ধরে রেখেছিল৷ আর বোল্ট অন্য দিক থেকে ব্যাটসম্যানদের একের পর এক প্রশ্ন করে গেল যার একটা উত্তর তাদের কাছে ছিল না৷

বোল্টকে দেখে ওয়াসিম আকরামের কথা মনে পড়ে গেল৷ এর চেয়ে বড় প্রশংসা আর কী হতে পারে৷ এটা যদি যথেষ্ট না হয়, তবে দেখলাম নিউজিল্যান্ডের ক্যাপ্টেন ম্যাককালাম ওকে চারটা স্লিপ, একটা গালি দিল৷ যতটুকু ঘুম ছিল চোখে কেটে গেল৷ ব্যাটসম্যানদের পাড়ায় বোলারদের দাদাগিরি দারুণ লাগল৷ মস্তানি করার ঠিক লোক থাকলে যেকোনো পাড়ায় মস্তানি করা যায়৷ হেনরিকে তো দারুণ লাগল৷ জোর আছে৷ সঙ্গে সুইংও৷ ২০ ওভার পরে দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোর ছিল ৭৭৷২৷ ক্রিজে তখন ডু’প্লেসিস আর রসৌ৷ প্যাভেলিয়ানে ফিরে গেছে কুইন্টন ডি’কক, আমলা৷ দু’জনেই বোল্টের শিকার৷

ওই সময় দক্ষিণ আফ্রিকার একটা পার্টনারশিপ দরকার৷ আর নিউজিল্যান্ডের দরকার ডি’ভিলিয়ার্স আসার আগে ওদের কমজোরি বোলারদের অ্যান্ডারসন, উইলিয়ামসন আর এলিয়টদের ওভারগুলো খাইয়ে দেওয়া৷ না, দক্ষিণ আফ্রিকার পার্টনারশিপ হলো না৷ অ্যান্ডারসনের বলে রসৌ, গাপটিলের নেওয়া একটা অসাধারণ ক্যাচে প্যাভেলিয়নে ফিরল৷ এবার প্রবেশ মহানায়ক ডি’ভিলিয়ার্সের৷ স্কোর তখন ১১৪/৩৷ হাতে রয়েছে ২৩ ওভার৷ দক্ষিণ আফ্রিকা চাপে৷ ৩৮ ওভার পর স্কোর যখন ২১৬/৩ বৃষ্টি নামল৷ নিউজিল্যান্ড একটু নিস্তার পেল৷ তবে ইতিমধ্যে ডি’ভিলিয়ার্স রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে৷ নিউজিলা্যন্ড তখন চাইছিল বৃষ্টিটা দক্ষিণ আফ্রিকার মোমেন্টাম নষ্ট করে ওদের আশায় পানি ঢালবে৷ পরে খেলা শুরু হতেই ডু’প্লেসিস আউট (৮২)৷ দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে এটা ব্লেসিং ইন ডিসগাইজ৷ ডু’প্লেসিসকে আটকে রাখা যাচ্ছিল৷ ওর জায়গায় মিলার এসে বিদ্যুৎগতিতে ১৮ বলে ৪৯ করে গেল৷ এমনকি ডি’ভিলিয়ার্সকেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর ইনিংস দেখতে হলো৷ ডাকওয়ার্থ-লুইস নিয়মে যে দল পরে ব্যাট করে তাদের সুবিধা হয়৷ দক্ষিণ আফ্রিকা ৪৩ ওভারে তুলল ২৮১/৫৷ আর ডি’ভিলিয়ার্স? নতুন কিছু করেনি৷ যা করে থাকে তা-ই করল৷ ৪৫ বলে ৬৫ রান৷ ইনিংসটা সম্পর্কে কিছু লিখতে পারছি না৷ কখন রান করল বুঝতেই পারলাম না যে!

উইকেট ভালো৷ মাঠটাও ছোট৷ তাই আশায় বুক বেঁধেছিলাম একটা ভালো ম্যাচ দেখার জন্য৷ ম্যাকালামের শুরু দেখে সুনামিকেও শান্ত মনে হবে৷ স্টেন আর ফিল্যান্ডারকে ক্লাব স্তরে নামিয়ে আনল৷ ২৬ বলে ৫৯ করল! ৮টা চার, ৪টা ছয়৷

তখনই মনে হয়েছিল, নিউজিল্যান্ড অল আউট না হলে ম্যাচটা জিতবে৷ হ্যাঁ, জিতলও৷ কিন্তু যে গল্পের পরিণতিটা মনে হচ্ছিল পানির মতো স্বচ্ছ, সেটাই কেমন যেন অস্বচ্ছ হতে বসেছিল একসময়! শেষের দিকে লড়াইটা মুহুর্মুহু নিল বাঁক! কখনও দরকার ৪৮ বলে ৬৭৷ দু’ওভার পেরোতেই ৩৬ বলে ৪৭৷ ৩৮ ওভারের শেষে তো লড়াই আরও হাড্ডাহাড্ডি৷ নিউজিল্যান্ডের তখন দরকার ৩০ বলে ৪৬৷ হাতে ৫ উইকেট৷ কোরি অ্যান্ডারসানকে ফেরানোর পর দক্ষিণ আফ্রিকা আরও বেশি বেশি করে তখন উজ্জ্বীবিত৷ মনে মনে ভাবলাম, অ্যান্ডারসনের আউটাই টার্নিং পয়েন্ট হয়ে যাবে৷ কিন্তু স্ক্রিপ্টটা লেখা হলো না, আমার ভাবনার ঢঙে৷ এলিয়টই লিখতে দিল না৷ তবে স্টেন আগুনের সামনে বিশ্বের তাবড় তাবড় ব্যাটসম্যান যেখানে ঝলসে যায়, সেখানে রঞ্চি আর কী বা করত? স্টেনের বলে রসৌকে ক্যাচ দিয়ে প্যাভেলিয়নের দিকে হাঁটা লাগাল৷ নিশ্চিত, ওকে এগিয়ে আসতে দেখে ম্যাকালামের চোখ-মুখ লাল হয়েছে৷ চিন্তায়, চাপে৷ ওই সময়টা স্টেন গানের গোলাগুলি তো ছিলই৷ সঙ্গে চোখে পড়ছিল, সতীর্থদের পেপ টক দেওয়া৷ প্রায় সব বলের শেষেই সতীর্থদের নিয়ে ছোটখাটো মিটিং সেরে নিচ্ছিল৷ এটা ক্রিকেটের পুরনো কৌশল৷ এতে একদিকে যেমন নিজেদের বাঁধনটা আঁটোসাঁটো হয়৷ তেমন বিপক্ষের ওপর চাপটাও বাড়ে৷ স্টেন সেটাই চাইছিল৷ পারছিলও৷

কিন্তু, তারপর? ৪০.৩ ওভারে কুইন্টন ডি’কক মিস করে বসল রান আউটের সুযোগ৷ ৪১.২-এ ফের একটা সুযোগ৷ এবার রান আউট নয়৷ মরকেলের বলে ক্যাচ তুলল এলিয়ট৷ কিন্তু দুই ফিল্ডার ছুটে এসেও ক্যাচ ফস্কাল! আবারও ক্যাচ তুলল এলিয়ট৷ বেহারদিয়েন বলটা ধরার জন্য তৈরিই ছিল৷ কিন্তু ফাইন লেগ থেকে ততক্ষণে ছুটে এসেছে ডুমিনি৷ তালেগোলে আবারও ক্যাচ পড়ল!

এতগুলো সুযোগ হারানোর পরও শেষে ম্যাচের হিসাবটা গিয়ে দাঁড়াল ৬ বল ১২ রান৷ শেষ ওভারে সব দায়িত্ব ছিল স্টেনের কাঁধে৷ প্রথমবার বিশ্বকাপ ফাইনালের টিকিটের জন্য লড়ছে, বোঝা যাচ্ছিল৷ কিন্তু, চাপটা নিতে পারল কি? এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার বদলে, অন্য একটা কথা, অন্য এক নাম বলতে ইচ্ছে করছে৷ স্টেন যতই বড় নাম হোক৷ চাপের মুখেই বিচার হয় কে বড়, কে মাঝারি৷ বলব, এলিয়ট ‘বড়’৷ অন্তত মঙ্গলবারের ম্যাচের নিরিখে তো বটেই৷ ওই সময় মাথা ঠান্ডা রাখা! ওভাবে তুলে ছয় মারা! ম্যাচের এক বল বাকি থাকতে! তাও আবার স্টেনের মতো বোলারকে! ‘বড়’র তকমাটা ও সত্যিই আদায় করে নিল৷ ৭৩ বলে করল অপরাজিত ৮৪ রান৷ ৭টা চার, ৩টা ছয়৷ নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসে স্মরণীয় ইনিংস৷

এবার প্রশ্ন, স্টেন কত নম্বর পাবে? নম্বরে ওকে বাঁধছি না৷ শুধু বলব, ও পার্শ্ব অভিনেতাই থেকে গেল৷ নায়ক হওয়া আর হলো না৷

শেষ করব, এটুকু লিখেই– চোকার্স তকমা, মরচের দাগের মতোই নাছোড়৷ ঘষলেও উঠতে চায় না৷ উঠলও না ডি’ভিলিয়ার্সদের গা থেকে৷