স্টেডিয়ামে ভারতীয়রাই হতে পারে সংখ্যাগরিষ্ট

SHARE

asu24একটা ম্যাচের মধ্যে অবধারিত ভাবে লুকিয়ে থাকে অনেকগুলো টুকরো টুকরো ম্যাচ!

বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল আলাদা হতে যাবে কেন? বৃহস্পতিবারের এসসিজি-তে আসলে শুধু একটা ক্রিকেট ম্যাচে দুটো দেশ মুখোমুখি হচ্ছে না, বাইশ গজে আট ঘন্টার টক্করে থেকে যাচ্ছে আরও নানারকমের রঙ৷ ম্যাচ শুরুর ৪৮ ঘণ্টার আগে বিতর্কের বারুদে ঠাসা আবহ, যে কোনও সময় শুধু বড়সড় বিস্ফোরণের অপেক্ষা৷

এসসিজি-র উইকেট নিয়ে মাইকেল ক্লার্কের টিম যদি কিউরেটর টম পার্কারের কাছে পেস ও বাউন্সের অলিখিত দাবি পেশ করে থাকে, বিতর্ক এড়াতে পিচের সামনে এদিন সকাল থেকে হাজির আইসিসি-র পিচ কমিটির প্রধান অ্যান্ডি আ্যাটকিনসন৷ যিনি ম্যাচের পরে উইকেট নিয়ে কোনও ট্যাঁ ফোঁ করার সুযোগ কোনো টিমকে দিতে পছন্দ করেন না৷ এসসিজি-র কিউরেটর টম পাকারে্রর সঙ্গে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার কর্তাদের কথা বলতে দেখা যাওয়া নিয়ে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো উত্তেজিত হতে পারে, কিন্ত্ত তাতে বাইশ গজে খুব বেশি বদল হওয়ার সম্ভাবনা কম৷

ধোনির টিম যদি নেটে টানা শর্ট বল খেলে যাওয়ার প্র্যাক্টিসে নিজেদের মগ্ন রাখে তো অজিদের প্র্যাক্টিসে নিজে থেকেই হাজির হয়ে যান প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ৮৫ বছরের বব হক৷ যিনি আবার মাইকেল ক্লার্কের নেতৃত্বের ভক্ত, যৌবনে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে ক্রিকেটটা খেলেছেন৷ লাঠি ঠুকঠুক করতে করতে একেবারে ক্লার্কদের নেটে, বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘যে ভাবে চোট সারিয়ে ফিরে ক্লার্ক বিশ্বকাপটা খেলছে, কাপটা ওর হাতে না দেখলে খুব অবাক হব৷ আমাদের দারুণ টিম, না জেতার কারণ নেই৷’

৪৫ হাজারের স্টেডিয়ামে কারা সংখ্যায় একে অপরকে টেক্কা দেবে, তাই নিয়েও তৈরি হয়েছে জল্পনা৷ অজি অধিনায়ক দেশবাসীকে মাঠে আসার জন্য টুইট করেছিলেন আগেই৷ আর এদিন ব্যাগি গ্রিনের অন্যতম সেরা ম্যাচ উইনার জেমস ফকনার এসসিজি-র প্রেস রুমে এসে অবলীলায় বলে দিলেন, ‘আগের রাতে ডিনারে আমরা আলোচনা করছিলাম ব্যাপারটা নিয়ে৷ ইন্ডিয়ার সাপোর্টাররা যে ভাবে প্রতি ম্যাচে মাঠ ভরিয়েছে, সিডনির ম্যাচটা আমাদের কাছে অ্যাওয়ে ম্যাচ মনে হতে পারে! তাতে অবশ্য কিছু এসে যাচ্ছে না৷’

স্লেজিং বা মাইন্ডগেমের অঙ্ক নিশ্চয়ই সক্রিয়, কিন্ত্ত তার চেয়েও বৃহত্তর পটভূমি থাকছে৷ অ্যাসেজ নয়, আধুনিক ক্রিকেটে বাণিজ্যের অঙ্কে ভারত-অস্ট্রেলিয়াই সবচেয়ে বড় রাইভ্যালরি, ১৪ দেশের বিশ্বযুদ্ধে ক্রিকেটের বেঁচে থাকার প্রাণভোমরা৷ আইসিসি-র পরিসংখ্যান বলছে, অ্যাডিলেডের ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের পরে আগামী বৃহস্পতিবার ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচই বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় ম্যাচ হতে যাচ্ছে, যা প্রায় দেড়শো কোটির বেশি মানুষ গোটা বিশ্বে টিভির মাধ্যমে দেখতে যাচ্ছেন৷

অলিম্পিকে প্রথম পাঁচটা দেশের মধ্যে থাকে, টেনিসে বরাবরের বিশ্বসেরা টিমগুলোর একটা, এখন ফুটবলের মতো খেলাতেও বিশ্বকাপ খেলে অস্ট্রেলিয়া৷ টিম কাহিলদের উন্নতির গ্রাফ অসম্ভব ভালো৷ সেই তুলনায় খেলাধূলোর মানচিত্রে অনেকটাই পিছিয়ে ভারত৷ বিশ্বকাপ ফুটবল খেলে না, কোনোদিন ডেভিস কাপ জেতেনি, অলিম্পিকে পদক তালিকায় প্রথম দশে থাকার স্বপ্নও দেখে না৷ তবে ক্রিকেটের দশটা বিশ্বকাপের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া যদি চারবার জিতে থাকে, ভারত জিতেছে দু’বার৷ ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতোই৷ এবং এই বিশ্বকাপে টানা সাতটা ম্যাচ জিতে পরপর দু’বার খেতাব ধরে রাখার একটা বাস্তবসম্মত পরিস্থিতি তৈরি করেছে৷ বিশ্বকাপের আগে ক্রমাগত হারতে থাকা যে টিমকে এখানকার বেটিং সংস্থা প্রথম পাঁচটা টিমের মধ্যে রাখেনি, তারাই এখন কাপ জয়ের সম্ভাব্য দাবিদার হিসেবে রেখে দিচ্ছে ভারতকে৷

আরও গুরুত্বপূর্ণ, এই মুহূর্তে দু’দশের কূটনীতিক সম্পর্ক৷ সেই ২০০৮ সালে ভারতের সফরের সময় হরভজন সিং ও অ্যান্ড্রূ সাইমন্ডসের কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে যে ‘মাঙ্কিগেট’ বিতর্ক দু’দেশের ক্রিকেটীয় সম্পর্ক একেবারে তলানিতে এনে দাঁড় করিয়েছিল, তা এখন স্রেফ অতীত৷ তার উপর নরেন্দ্র মোদীর গত বছরের নভেম্বরের অস্ট্রেলিয়া সফর দু’দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কেও নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে৷ তিন দশক পরে কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এসেছিলেন এ দেশে আর প্রথম সফরেই বাজিমাত্৷ এই সিডনিতেই কুড়ি বাজার প্রবাসী ভারতীয়ের সামনে ভাষণ দিতে গিয়ে মোদি বলেছিলেন, ‘আই সি অস্ট্রেলিয়া অ্যাজ আ মেজর পার্টনার ইন এভরি এরিয়া অব আওয়ার ন্যাশনাল প্রায়োরিটি৷ অস্ট্রেলিয়া উইল নট বি অ্যাট দ্য পেরিফেরি অফ আওয়ার ভিশন, বাট অ্যাট দ্য সেন্টার অফ আওয়ার থট৷ উই স্ট্যান্ড টুগেদার অ্যাট আ মোমেন্ট অফ এনোরমাস অপরটুনিটি অ্যান্ড গ্রেট রেসপন্সিবিলিটি!’ প্রধানমন্ত্রী টোনি অ্যাবটের সঙ্গে সম্পর্ক অসম্ভব ভালো, অস্ট্রেলীয় পাসপোর্ট থাকলে ভারতে এখন অ্যারাইভ্যাল ভিসাও পাওয়া যাচ্ছে৷

এই রকম একটা আবহে দুটো দেশ মুখোমুখি হচ্ছে, যেখানে দুটো দেশের ক্যাপ্টেনের লক্ষ্য আলাদা৷ একদিকে মাইকেল ক্লার্ক, যাকে প্রমাণ করতে হবে চোট সারিয়ে বিশ্বকাপে যে খেলছেন, যার জন্য জর্জ বেইলিকে বসতে হচ্ছে, সেটার পিছনে কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই৷ অন্যদিকে, মহেন্দ্র সিং ধোনি, যিনি মাত্র তিন মাস আগে এ দেশেই টেস্ট ক্রিকেটকে টা টা করে দিয়েছেন, অথচ টানা দুটো বিশ্বকাপ জেতার লক্ষ্য থেকে মাত্র দুটো ম্যাচ দূরে দাঁড়িয়ে আছেন৷ ইতিহাস গড়ার হাতছানি তার সামনে৷

কেউ ম্যাচটাকে বলছেন ‘ক্র্যাকার’,কেউ আবার বলছেন, ‘ফাইনাল বিফোর দ্য ফাইনাল’! সিডনি শহরটা সবাইকে সাদরে বরণ করে নেয়৷ কাউকে ফেরায় না৷ ভারতীয় আর চীনা বংশোদ্ভূত অসংখ্য, সঙ্গে আছে জীবিকার সন্ধানে ফিলিপিনো, লেবানিজ, থাই, কোরিয়ান এবং ইউরোপের দেশগুলি থেকে আসা বিপুল জনস্রোত৷ এক কথায় ‘বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান!

এসিসিজি-তে তিলধারণের জায়গা বৃহস্পতিবার থাকার কথা নয়৷ একটা টিকিটও পড়ে নেই, ম্যাচের কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে৷ চারটা সেমিফাইনাল জমেনি, চারটাই একপেশে ম্যাচ৷ উইকেট নিয়ে যতই পানিঘোলা হোক, আদর্শ একটা ওয়ান ডে উইকেটই প্রত্যাশিত৷ যেটা স্পিন বা পেস, কোনোটারই স্বর্গ নয়৷

এসসিজি অন্তত এখন পর্যন্ত একপেশে কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে না৷