মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এখন ভিনগ্রহের শব্দ: তসলিমা নাসরিন

SHARE

toslimaবাংলাদেশে এখন মত প্রকাশের স্বাধীনতা ভিনগ্রহের শব্দে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তসলিমা নাসরিন। ভারতের ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আশি এবং নব্বই দশকের শুরুতে ইসলামের সমালোচনায় এবং মুসলিম সমাজে নারীদের অবস্থা নিয়ে যা আমি লিখতাম, তা পত্রিকায় প্রকাশিত হতো এবং তা ব্যাপকভাবে পড়া হতো। কিন্তু এখন তা কল্পনা করা যায় না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এখন ভিনগ্রহের শব্দে পরিণত হয়েছে।

গতকাল শনিবার দৈনিকটির অনলাইন সংস্করণে তসলিমা নাসরিনের সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারে নিজের মতবাদ, লেখালেখির প্রেক্ষাপট, বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার ক্ষেত্র, ধর্মসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন ভারতে নির্বাসিত এ লেখক। বর্তমানে তিনি দিল্লিতে বাস করছেন।

বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়ার বিষয়ে এই লেখক বলেন, আশির দশকের মাঝামাঝি জেনারেল এরশাদের সময়কালে বিষয়টি প্রথম নজরে আসে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাতিল করে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করা হয়। ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, সত্তর দশকের সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রত্যক্ষদর্শী আমি। সেসময় পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। মানুষ নিজের মতামত তুলে ধরতে পারত। খুব কম নারী বোরখা অথবা হিজাব পরত। কিন্তু ধীরে ধীরে সমাজ পাল্টে গেল।

নিজেকে ‘নাস্তিক’ দাবি করে তসলিমা নাসরিন বলেন, আমি সব ধর্মের সমালোচনা করি, হিন্দুত্ববাদেরও। আমি হিন্দু দেবতাদের বিরোধিতা করি, হিন্দু ধর্মের কারওয়া চৌত ও শিবরাত্রির বিরোধিতা করি। গুজরাটে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের নিন্দা জানিয়েছি। গুজরাটের দাঙ্গায় আহতদের পুনর্বাসনে তহবিল সংগ্রহ করেছেন শঙ্খ ঘোষ। আমি তার তহবিলে ১০ হাজার রুপি দিয়েছি। বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর, জার্মানিতে ইহুদিদের, বসনিয়া, ফিলিস্তিনে মুসলমানদের এবং পাকিস্তানে খ্রিস্টানদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছি। এছাড়াও আমি ‘পিকে’, ‘ওয়াটার’ এবং ‘দ্য লাস্ট টেম্পটেশন অব ‌‌‌ক্রিস্ট’ সিনেমার পক্ষে লিখেছি। দয়া করে আমাকে মুসলমান বলবেন না, আমি একজন নাস্তিক।

কিছুদিন আগে একুশে বইমেলা থেকে বের হয়ে ঢাবি’র টিএসসির সামনে খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায় সম্পর্কে সাক্ষাৎকারে তসলিমা বলেন, অভিজিতকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি। পত্রিকায় নাস্তিক ও মানবতাবাদীদের লেখা না ছাপায় অভিজিৎ মুক্তমনা চালু করে যাতে নি‌‌‌জেদের মত প্রকাশ করতে পারে। অভিজিৎ ছিল একজন বিজ্ঞান লেখক ও মুক্ত চিন্তার মানুষ, একজন নাস্তিক এবং একজন যুক্তিবাদী। সে চেয়েছিল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা ও বিতর্কের একটি ক্ষেত্র তৈরি করতে। পরে ব্লগের লেখাগুলো নিয়ে বই প্রকাশ হয়। মুক্তমনা ইসলামসহ সব ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলার একটি ক্ষেত্রে পরিণত হয়। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে মুক্তচিন্তার সুযোগ হারিয়ে গিয়েছিল। অভিজিৎ নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে তা ফিরিয়ে আনে। এজন্য তার ভূমিকা সত্যিকার অর্থে ‘অপরিসীম’ বলে উল্লেখ করেন তসলিমা।

বর্তমান পরিস্থিতির জন্য তিনি ‘প্রগতিশীল সম্প্রদায় আংশিকভাবে দায়ী’ উল্লেখ করে বলেন, ১৯৯৪ সালে আমাকে যখন দেশ থেকে বিতাড়িত করা হল তখন সবাই নিশ্চুপ ছিল। ওই সময় যদি প্রগতিশীল সম্প্রদায় বাধা দিত তাহলে বাংলাদেশে এমন সমাজ কখনও হতো না।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ভাষা নাকি ধর্মের ভিত্তিতে পরিচিত হবে সম্ভবত দ্বন্দ্বটা এখানেই।

এমন পরিস্থিতি থেকে ‘উত্তরণে’ করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতির চেতনা থেকে বাংলাদেশের জন্ম। ১৯৫২ সাল থেকে বাঙালি মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা চেয়েছে, উর্দুকে নয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে যারা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে তারা ত্রিশ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে। এখন তারা বাংলাদেশকে ইসলামিকরণে জড়িত। তারা মুক্তচিন্তার মানুষ ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করছে।

তসলিমা দাবি করেন, বাংলাদেশের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ এবং ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করা উচিত। মাদ্রাসা শিক্ষার পরিবর্তে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। বাংলাদেশ যাতে ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত না হয় তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি বলেন, আমি বলেছি ধর্ম নারীকে শোষণ করে। আইন সমতার ভিত্তিতে হওয়া উচিত ধর্মের নয়। বিয়ে, তালাক, সন্তান ধারণ ও উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারীদের সমান অধিকার থাকা উচিত। আমি বলেছি, ধর্মের নামে পাথর ছুড়ে নারীদের হত্যা বন্ধ করতে হবে।

তার লেখা ধর্মীয় মৌলবাদীদের শক্তিশালী করছে এমন অভিযোগ নাকচ করে তসলিমা নাসরিন বলেন, সরকারই মৌলবাদকে শক্তিশালী করছে, আমি নই। যখন ধর্মীয় মৌলবাদীরা আমার মাথার দাম নির্ধারণ করল তখন রাষ্ট্র এর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি, সরকারও আমার বিরুদ্ধে গেল।

আওয়ামী লীগ, বিএনপি ‘মৌলবাদীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত’ দাবি করে তিনি বলেন, এমনকি পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী) নেতৃত্বাধীন সরকারও আমাকে বহিষ্কার করেছে। আমার মাথার দাম ঘোষণা করা টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম বরকতিকে মার্কসবাদীরা সাদরে বরণ করেছে। মজার ব্যাপার মমতা ব্যানার্জিও ক্ষমতায় আসার পর ইমামকে বন্ধু বানিয়েছেন।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি বলেন, যদি ইসলামি সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় আনা না হয় তাহলে দেশটি বড় দুর্যোগের মুখে পড়বে। তবে, অতীতের ঘটনা দেখে মনে হয় বিচার হবে না। এসব ঘটনা আরও বাড়বে বলে শংকা প্রকাশ করেন তসলিমা।