করোনার থাবায় পাইকারি পণ্য বিক্রিতে ধাক্কা

SHARE

স্থানীয় ও নিয়মিত যাতায়াত করেন এমন মানুষের কাছে সদরঘাট, বাদামতলী ও শ্যামবাজার তীব্র যানজট ও লোকারণ্য জায়গা। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এসব জায়গায় গাড়িজটের সঙ্গে থাকে মানুষজটও। মাছে মাঝে পায়ে হেঁটে চলাও দুস্কর হয়ে পড়ে। কিন্তু এখন চিত্র ঠিক পুরোটাই উল্টো। মানুষের আনাগোনা নেই। নেই যানজট, রিকশাজট।

বাবুবাজার থেকে সদরঘাটের ওয়াইজঘাট পর্যন্ত এমন ফাঁকা চিত্র দেখা গেলেও শ্যামবাজার কাঁচাবাজারে মিললো উল্টো চিত্র। শত শত মানুষের ভিড়। শাক-সবজি থেকে শুরু করে কাঁচা পণ্য কিনতে মানুষের ভিড়। কেউ মাথায় পণ্য নিয়ে আড়তে নিচ্ছে আবার কেউ আড়ত থেকে রিকশা-ভ্যানে পণ্য তুলছে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা কাঁচাপণ্য বিক্রি চলছে। আড়তদার থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা পণ্য কিনে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে নির্দিষ্ট সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হলেও কারো ক্ষেত্রে এমনটা চোখে পড়লো না। মুখে মাস্ক ও হাতে স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে বলা হলেও ক্রেতা-বিক্রেতা কারো ক্ষেত্রেই দেখা যায়নি। তবে কিছু মানুষকে দেখা গেছে যারা মাস্ক, স্যানিটাইজার কিংবা গ্লাভস পরে বাজারে এসেছেন। নিজে সতর্কতার সঙ্গেও চলার চেষ্টা করছেন।

পণ্য বিক্রেতারা বলছেন, পণ্য বিক্রির আয় দিয়ে সংসার চলে। নিষেধাজ্ঞা মেনে ঘরে বসে থাকলে সংসার চলবে না। আবার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে পণ্য বিক্রি করাও সম্ভব হবে না। তবে বাসায় ফিরলে স্যানিটাইজার কিংবা অন্যান্য সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।

পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী সবজি বিক্রেতা আবুল কালাম বলেন, ‘ঘরে বসে থাকলে তো সংসার চলবে না। নিয়মিত মাস্ক পরি, কিন্তু এখন নেই। নির্দিষ্ট দুরত্বেও থাকা সম্ভব হয় না। ক্রেতার কাছে গিয়ে পণ্য বিক্রি করতে হয়। আল্লাহ যা করবেন, তাই-ই। কিছু করার নেই। সংসার চালাতে তো হবে।’

বাদামতলী ঘাটে ফলের ব্যবসা করেন রহিম শেখ। নিজ জেলা বরিশাল। ঢাকায় আসা যাওয়া থেকে ব্যবসার শুরু। তিনদশক ধরে এখানে ব্যবসা করলেও এমন ফাঁকা ও মানবহীন চিত্র দেখেননি। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বায়তুল আমান মসজিদের সামনে তিনি জানালেন, মানুষ নেই। ফুল বিক্রি কমেছে। বড় বড় দোকানীরা ফল কিনলেও আগের চেয়ে বিক্রি কমেছে এক-তৃতীয়াংশ। আগে লাখ লাখ টাকার ফল বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখন কয়েক হাজার টাকার বিক্রি হয়। দোকান ভাড়া ও অন্যান্য খরচেই সেটা চলে যায়।

আগে বাদামতলীর চেহারা কেমন দেখেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, দিনভর মানুষের ভিড়। রাস্তা দিয়ে রিকশা চলছে। ফলের গাড়ি ঢুকছে। তীব্র যানজট। মানুষের হেঁটে চলার জায়গাও থাকে না। গাড়ির হর্ণের শব্দ বাজতেই থাকতো। করোনার কারণে মানুষের আনাগোনা কম থাকায় বাদামতলীকে অচেনা মনে হয়। সন্ধ্যার পরও ভীড় থাকতো কিন্তু এখন সেটা নেই।’

সরেজমিনে সদরঘাটের বাদামতলী, শ্যামবাজার ও বাবুবাজার ঘুরে দেখা গেছে, স্বাভাবিক সময়ে দিনভর যানজট ও মানুষের ভিড় থাকলেও এখন নেই। রিক্সা ও গাড়ির ভিড়ে পায়ে হাঁটা যেখানে কঠিন ছিল, এখন সেই জায়গাগুলো ফাঁকা। পণ্যের কেনাবেচা কমে যাওয়ায় এখানকার নিম্ন আয়ের মানুষগুলোও পড়েছে মসীবতে। কাজ নেই, তাই কোনো আয়ও নেই। পেটে খাবারের ক্ষুধা ও কাজের ইচ্ছা থাকলেও অবসরে সময় কাটছে তাদের।

বাদামতলীর ফল বিক্রেতারা জানান, করোনার কারণে রাজধানীর সবকিছুই বন্ধ থাকলেও ফল বা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের কেনাবেচায় তেমন কোনো বাধা নেই। পুলিশের দফায় দফায় হুঁশিয়ারিতে পণ্য বিক্রি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। মানুষকে ঘরে থাকতে বলায় ক্রেতার আনাগোনা কম। এক-তৃতীয়াংশ লেনদেন কমে গেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আগের রুপে ফেরার আশা করছেন ফল ব্যবসায়ীরা।

হাজী আফছার-করিম সুপার মার্কেটের সামনে ৮-১০ কার্টন আপেল নিয়ে বসেছিলেন আখতার। তিনি বলেন, ‘বিক্রি অনেক কমে গেছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাটনের পর কাটন মাল (আপেল) বিক্রি করেছি কিন্তু এখন সেটা হয় না। ক্রেতাও নেই। নির্দিষ্ট কিছু দোকানদার আপেল নিচ্ছেন।’

বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষা শ্যামবাজার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাইকারি বাজার। রাজধানীবাসী দৈনন্দিন চাহিদার বড় অংশই মেটায় এই বাজার। বেলা ১২টা থেকে দুইটা পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, শ্যামবাজারে পেঁয়াজ ও রসুনের দোকানে মানুষের ভিড় নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে হাতে গোনা কয়েকজন ক্রেতা পণ্য কিনে নিচ্ছে। বেশির ভাগ দোকানদারকেই অলস সময় কাটাতে দেখা গেছে। বিক্রেতারা জানান, পণ্য বিক্রি নেই বললেই চলে। পেঁয়াজ ও রসুনের দাম কম হলেও ক্রেতা নেই। হাতে গোনা কিছু ব্যবসায়ী আসছেন, যারা নিজের দোকানে পণ্য বিক্রির জন্য কিনছেন।

বাবুবাজার ব্রিজের পূর্বপাশে কয়েকটি মার্কেটে চলছে ওষুধ বিক্রি। মার্কেটগুলো সামনে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, করোনার কারণে মানুষের আনাগোনা কম। পাইকারি দোকানগুলোতে সবসময় ভিড় লেগে থাকতো। কিন্তু এখন সেটা নেই। আলী চেয়্যারম্যান মেডিসিন প্লাজায় কয়েশ পাইকারি ওষুধের দোকান। ছোট ছোট দোকানগুলোতে লাখ লাখ টাকা কেনাবেচা হয়। কিন্তু এখন চিত্র ভিন্ন। ফার্মেসির মালিকরা আসতে না পারায় বিক্রি কমে গেছে। তবে থেমে নেই। ওষুধ বিক্রি চলছে।