এই শিরোনামে ভারতের কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা আজ একটি প্রতিবেদন ছেপেছে। আনন্দবাজার লিখেছে, ঢাকা চাইছে সংঘাত পর্ব কাটিয়ে নয়া দিল্লি-কলকাতার এই খুশি খুশি ভাবটাই টিকে থাকুক। এর ফলেই স্থলসীমান্ত চুক্তির জট ছাড়ানো গিয়েছে। তার পর এবার সূত্র মিলুক তিস্তার পানি বণ্টনের!
আনন্দবাজার লিখেছে:
ঢাকা থেকে শনিবার রাতেই কলকাতায় ফিরে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ফিরলেন রবিবার সন্ধ্যায়। কিন্তু যুগলের ‘সফল সফর’ শেষে আশা জিইয়ে রইল বাংলাদেশের রাজধানী শহরে। যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়ে গেল সেই ‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’!
মোদি বলেছিলেন, ‘‘মমতাজি সফরসঙ্গী হওয়ায় আমি খুশি!’’ ঢাকা চাইছে সংঘাত পর্ব কাটিয়ে নয়াদিল্লি-কলকাতার এই খুশি খুশি ভাবটাই টিকে থাকুক। এর ফলেই স্থল সীমান্ত চুক্তির জট ছাড়ানো গিয়েছে। তার পর এবার সূত্র মিলুক তিস্তার পানি বণ্টনের!
অতীতে মনমোহন সিংহের সরকারও তিস্তার জট ছাড়াতে সক্রিয় হয়েছিলেন। বাংলাদেশের সঙ্গে পানি বণ্টন সূত্র এক প্রকার চূড়ান্ত করে তার পর মমতার ছাড়পত্র চেয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু কেন্দ্রের এই চাপিয়ে দেওয়ার নীতি মানেননি মমতা। কলকাতার সেই মেজাজ বুঝেই এবার কৌশল সম্পূর্ণ বদলে ফেলেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। সমাধান সূত্র খুঁজে বার করার দায়িত্ব তিনি দিয়েছেন খোদ মমতাকেই। শনিবার আগে নিজেদের মধ্যে একান্ত আলোচনায় বোঝাপড়া সেরে নিয়ে তার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একত্রে বৈঠকে বসেন মোদি ও মমতা। সেই বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া আঞ্চলিক পরিকাঠামো উন্নয়নের কিছু প্রস্তাব ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন প্রধানমন্ত্রী। নেপাল, ভুটানের মতো ছোট প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং সিকিম-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে উন্নয়নের কাজ একযোগে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মমতার প্রস্তাব বাস্তববাদী বলে মনে করছেন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের কর্তারাও। এ হেন প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জাতীয়তাবাদী, আন্তরিক এবং সমস্যা সমাধানের সূত্র দিতে সচেষ্ট।’’ প্রসঙ্গত, ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর ঢাকা সফরে তিস্তা সমস্যার সমাধান সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী নিজেও সেই বার্তাই দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন হলো, সমাধান সূত্র তা হলে কী হতে পারে?
সাউথ ব্লকের কর্তারা জানাচ্ছেন, ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রীর অবশ্যই কথা হবে। কিন্তু তারই পাশাপাশি অফিসার পর্যায়ে একটা মেকানিজমও তৈরি করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তারও আবার দুটি স্তর থাকবে। পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্কর ও রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র সমাধান সূত্র খুঁজতে আলোচনা চালাবেন।
আবার আর একটি স্তরে আলোচনা প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব ভাস্কর খুলবে এবং মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের সচিব গৌতম সান্যাল। এর মধ্যেই এই দুই স্তরে আলোচনা শুরুও হয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রকে তিস্তা চুক্তির খসড়া সম্পর্কে রাজ্য সরকারের আপত্তিগুলি এক-দুই করে জানিয়েছেন মুখ্যসচিব। এমনকী পানি প্রবাহের যে সব পরিসংখ্যান খসড়ায় দেওয়া হয়েছে, তাতেও কিছু ভুলভ্রান্তি রয়েছে বলে দাবি রাজ্য সরকারের। তিস্তায় পানির স্রোত ও পরিমাণ সম্পর্কে কল্যাণ রুদ্র কমিটি মমতার কাছে আগেই রিপোর্ট পেশ করেছে। সেটি প্রকাশ করা না-হলেও তার মোদ্দা বক্তব্য কেন্দ্রকে জানানো হয়েছে। তবে সূত্রের মতে, ওই রিপোর্টেও চুক্তির পক্ষেই মত দেওয়া হয়েছে। তবে তিস্তা চুক্তি কী ভাবে উত্তরবঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, তার কিছু সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে রিপোর্টে। সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় পানিসম্পদ মন্ত্রী উমা ভারতীর সঙ্গেও আবার পশ্চিমবঙ্গের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কয়েক প্রস্ত আলোচনা হয়েছে।
রাজ্যে সরকারের বক্তব্য, বাস্তবে শুখা মরসুমে তিস্তায় পানিই থাকে না। বর্ষায় তিস্তা যখন পানিতে ভাসে তখন এমনিতেই ওপর থেকে নীচে পানিতের স্রোত যায়। বাংলাদেশও তখন পর্যাপ্ত পানি পায়। সুতরাং মূল সমস্যা হচ্ছে, শুখা মরসুমে পানি ভাগাভাগি নিয়ে। রাজ্যের প্রশ্ন- শুখা মরসুমে পানি না-থাকলে বা নামমাত্র থাকলে তার ভাগ বাংলাদেশকে দেওয়া যাবে কী ভাবে? তার ওপর পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সিকিম অন্তত আটটি বাঁধে বেঁধেছে তিস্তাকে। যদিও সিকিম সরকারের দাবি, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। সে জন্য পানির স্রোত কমেনি। তবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই দাবি মানতে নারাজ।
এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার কিছু বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে কেন্দ্রকে। এক, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তিস্তার ভূগর্ভস্থ পানি ওপরে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাতে শুখা মরসুমেও অনেক পানি পাওয়া যাবে। মুখ্যসচিব এই প্রস্তাবের ব্যাপারে কেন্দ্রকে সবিস্তার জানিয়েছেন। দুই, গুজরাতে পানিতের অভাব থাকায় সেখানে নদী নালার মধ্যে ছোট ছোট বাঁধ দিয়ে জলাধার নির্মাণ করে পানি সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছোট ছোট নদী নালা থেকে পানি সরু হয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে আসে। জলাধার নির্মাণ করে ধরে রাখলে তা ব্যবহার করা যায়, অপচয়ও হয় না। এই প্রকল্পে খরচও কম। এই সূত্র তিস্তার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্ভব কি না, তা নিয়েও আলোচনা চলছে। তিন, তিস্তা চুক্তি সম্পাদন হলে বিশ্বব্যাঙ্কও অর্থ সাহায্য করতে প্রস্তুত। ওই টাকায় তিস্তার সংস্কার ও নাব্যতা বাড়ানো যেতে পারে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে বলা হচ্ছে, এখন যে খসড়া চুক্তি রয়েছে তার মেয়াদ দশ বছর ধার্য করা হয়েছিল। অর্থাৎ এটাও চিরস্থায়ী ব্যবস্থা নয়। খসড়ায় বলা হয়েছে, তিস্তার পানি অর্ধেক অনুপাতে দুই দেশের মধ্যে ভাগ হবে। দুই দেশ যে পানি পাবে, তার কিছুটা করে অংশ আবার তিস্তাকেই নাব্য রাখতে ‘চার্জিং’-এর কাজে ব্যবহার করা হবে। তবে রাজ্য সরকারের বক্তব্য, গঙ্গায় পানি পরিমাপ করা সহজ ছিল। তিস্তার ক্ষেত্রে তা নয়। তাই নানা জনের নানা মত রয়েছে। সেই কারণেই সবিস্তার আলোচনা করে সমাধান সূত্র বার করাটা প্রয়োজন। মোদ্দা কথা হলো, পরিকাঠামো উন্নয়ন করে যদি পশ্চিমবঙ্গে তিস্তার অংশে পানি ও তার স্রোত কেন্দ্র যথাযথ রাখতে পারে, তা হলে মমতা সরকারের আপত্তি নেই। রাজ্যের বক্তব্য- এই কথাটা স্থলসীমান্ত চুক্তির ক্ষেত্রেও মমতা বলেছিলেন। ওই চুক্তি নিয়ে রাজ্যের আপত্তি ছিল না। রাজ্যের বক্তব্য ছিল, চুক্তির জন্য কেন্দ্র রাজ্যকে কী পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দেবে, সেটি সুনিশ্চিত হওয়া চাই। রাজ্যের সেই দাবি মেনে নিয়েই স্থল সীমান্ত চুক্তির জন্য ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন বাবদ রাজ্যকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা দিতে সম্মত হয়েছে কেন্দ্র। রাজ্যের মতে, এ ক্ষেত্রেও কেন্দ্রের মনোভাব একই থাকলে তিস্তার পানি দ্রুত বাংলাদেশের দিকে গড়াতেই পারে।
মোদির ঢাকা সফরের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শীঘ্র ভারত সফরে আসবেন। তাঁর সেই সফরে তিস্তা নিয়ে আলোচনা হবে। হাসিনার সফরের আগে ঢাকার তরফে এই আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর ব্যক্তিগত উপদেষ্টাকে নিয়োগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিস্তা নিয়ে প্রত্যাশার পারাও চড়ছে পদ্মাপারে। বাংলাদেশের এক কূটনীতিকের কথায়- মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় কলকাতায় ফেরার সময় তার সঙ্গে বাক্স ভরে প্রচুর মিষ্টি পাঠিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিস্তা প্রশ্নে নয়া দিল্লি ও কলকাতা থেকে পাল্টা মিঠে খবরের অপেক্ষাতেই রইলেন বাংলাদেশের মানুষ।