ইউক্রেন ভূখণ্ডে প্রতি বর্গকিমি দখলে গড়ে ২৭ সেনা হারিয়েছে রাশিয়া

SHARE

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ২০২৪ সাল ছিল রাশিয়ার জন্য সবচেয়ে রক্তাক্ত বছর। ওই বছর অন্তত ৪৫ হাজার ২৮৭ জন রুশ সেনা নিহত হয়েছেন, যেটা আগের বছরের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি। তখন যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ ও দীর্ঘতম সংঘর্ষ হয়েছিল বাখমুতে।

১ অক্টোবর ২০২৪-এ রুশ বাহিনী ডোনেৎস্কের গুরুত্বপূর্ণ শহর ভুহলেদার দখল করে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ারের মতে, সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রাশিয়া ইউক্রেনের দুই হাজার ৩৫৬ বর্গকিমি এলাকা দখল করে। পুরো বছরজুড়ে দখল করা এলাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ১৬৮ বর্গকিমি। এর বিপরীতে রাশিয়া হারায় অন্তত ৪৫ হাজার ২৮৭ সেনা অর্থাৎ প্রতি বর্গকিমি দখলে গড়ে ২৭ জন রুশ সেনার মৃত্যু হয়।

বিবিসি রুশ সার্ভিস, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম মিডিয়াজোনা এবং স্বেচ্ছাসেবক দলগুলোর সমন্বয়ে রুশ কবরস্থান, সামরিক স্মৃতিসৌধ ও মৃত্যুসংবাদ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে— যুদ্ধ চলাকালীন এখন পর্যন্ত এক লাখ ছয় হাজার ৭৪৫ জন নিহত রুশ সেনার পরিচয় শনাক্ত করা গেছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি। অনুমান অনুযায়ী, এই সংখ্যা ৪৫ শতাংশ থেকে ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ মোট মৃত্যু হতে পারে এক লাখ ৬৪ হাজার ২২৩ থেকে দুই লাখ ৩৭ হাজার ২১১ জন।

২০২৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ছিল রুশ বাহিনীর জন্য সবচেয়ে প্রাণঘাতী দিন।
ওই দিন দোনেৎস্কের দখলকৃত ভোলনোভাখা শহরের কাছে একটি প্রশিক্ষণস্থলে ইউক্রেনের হিমারস ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করলে ৬৫ জন রুশ সেনা নিহত হন, যাদের মধ্যে ছিলেন আলদার বায়রভ (২২), ইগর বাবিচ (৩২) ও ওখুনজোন রুস্তামভ (৩১)। তারা ৩৬তম মোটর রাইফেল ব্রিগেডের সদস্য ছিলেন এবং সেদিন তাদের একটি পদক প্রদানের জন্য সারিবদ্ধ হতে বলা হয়েছিল।

বায়রভ পূর্ব সাইবেরিয়ার বুরিয়াতিয়া অঞ্চল থেকে আসা এক তরুণ, খাদ্য স্যানিটেশন বিষয়ে পড়াশোনা করলেও বাধ্যতামূলক সেনাসেবার পর পেশাদার সেনা হন। রুস্তামভ ছিলেন একজন ওয়েল্ডার এবং পূর্বে বিশেষ বাহিনীতে কাজ করেছেন। বাবিচ ছিলেন একজন স্বেচ্ছাসেবী, যিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের শারীরিক থেরাপিতে সহায়তা করতেন।

সেদিন মোট ২০১ জন রুশ সেনা নিহত হন। একই দিন সন্ধ্যায় তৎকালীন রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সামনের সাফল্য নিয়ে বৈঠক করেন, তবে প্রশিক্ষণস্থলে হামলার কোনো উল্লেখ ছিল না।

২০২২ সালে রাশিয়া কমপক্ষে ১৭ হাজার ৮৯০ জন সেনা হারায়। ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭ হাজার ৬৩৩ জনে। ২০২৪ সালে পুরো বছরজুড়ে কোনো সময় কমেনি মৃতের সংখ্যা। অবদিইভকা, রোবোটিনে, পোক্রোভস্ক ও তোরেৎস্কের দিকে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলেছে ধারাবাহিকভাবে। বিশেষ করে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে ধীরগতির পূর্বমুখী অগ্রযাত্রায় সবচেয়ে বেশি সেনা প্রাণ হারান।

মার্কিন বিশ্লেষক মাইকেল কফম্যান বলেন, ‘ছোট ছোট দল নিয়ে বারবার আক্রমণের কৌশল রুশ সেনার মৃত্যু হার বাড়িয়ে দিয়েছে।’

সেনাসংকট মোকাবেলায় নিয়োগ বাড়াচ্ছে রাশিয়া

২০২৪ সালের শেষার্ধে রাশিয়া সেনা নিয়োগ বাড়ায় এবং তা মৃতের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক সেনাদের এককালীন প্রণোদনা বৃদ্ধি করা হয়। আইনগত সুবিধার কারণে কারাবন্দিদের মধ্য থেকেও অনেকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুদ্ধে যোগ দেন।

২০২৩-২৪ সালে হাজার হাজার চুক্তিভুক্ত স্বেচ্ছাসেবককে মাত্র ১০-১৪ দিনের স্বল্প প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়। ফলে তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে আসে। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে বাশকিরতিস্তানে। সেখানে ৪ হাজার ৮৩৬ জনের মৃত্যু হয়। বেশির ভাগই ছিলেন গ্রামীণ এলাকা থেকে আসা এবং ৩৮ শতাংশের কোনো সামরিক অভিজ্ঞতা ছিল না।

উন্মুক্ত উৎস থেকে মৃত্যু পরিসংখ্যান সংগ্রহের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়। অনেক মৃতদেহ এখনো যুদ্ধক্ষেত্রে রয়ে গেছে এবং তাদের উদ্ধার করা ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের হিসাব ধরলে মৃতের সংখ্যা আরো বাড়বে।

মৃত্যুসংবাদ ও নিখোঁজের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, অতিরিক্ত ২১ হাজার থেকে ২৩ হাজার ৫০০ জন নিহত হতে পারেন, যার ফলে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় এক লাখ ৮৫ হাজার থেকে দুই লাখ ৬০ হাজার ৭০০ জনে।