৩ দিনে নিহত অন্তত ১৩০০, নতুন করে কী হচ্ছে সিরিয়ায়

SHARE

সিরিয়ায় গত গত কয়েক দিনে নিরাপত্তা রক্ষী বাহিনীর সঙ্গে আসাদপন্থী সেনাদের সংঘাতে বেসামরিক নাগরিকসহ এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। ডিসেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা এটি। সাম্প্রতিক এই সংঘাতের শুরু হয় বৃহস্পতিবার। সিরিয়ার পশ্চিম উপকূলের শহর লাতাকিয়া ও জাবলেতে নিরাপত্তা রক্ষীদের ঘাঁটিতে সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সমর্থক সেনারা হামলা করে, যাতে নিরাপত্তা রক্ষা বাহিনীর অনেক সদস্য মারা যান।

এই হামলার জবাবে শুক্র ও শনিবার সিরিয়ার নিরাপত্তা রক্ষীরা পশ্চিম উপকূলের লাতাকিয়া, জাবলে ও বানিয়াস শহরে আসাদ সমর্থক সেনাদের ওপর হামলা চালায়। নিরাপত্তা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে হামলায় যোগ দেয় কিছু সশস্ত্র বিদোহী গোষ্ঠীর সদস্যও। সেসব হামলায় ওই অঞ্চলে বসবাসরত সংখ্যালঘু আলাউইত সম্প্রদায়ের বহু বেসামরিক নাগরিক মারা গেছে বলে জানাচ্ছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস।

সংস্থাটি বলছে, গত কয়েক দিনের ‘গণহত্যা’য় অন্তত ৮৩০ জন বেসামরিক নাগরিক মারা গেছে।
অন্যদিকে দুই পক্ষের সংঘাতে নিরাপত্তা রক্ষা বাহিনীর ২৩১ জন, আর আসাদ সমর্থক ২৫০ জন মারা গেছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা এক হাজার ৩১১ জন।

সংঘাত ছড়িয়ে পড়ল কিভাবে
গত বছরের ডিসেম্বরে সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ পালিয়ে যাওয়ার পর দেশটির শীর্ষ নেতা হন বিদ্রোহী দলগুলোর নেতৃত্ব দেওয়া হায়াত তাহরির আল শামের (এইচটিএস) প্রধান আহমেদ আল-শারা। সে সময় সিরিয়ার নিরাপত্তা রক্ষা বাহিনীর অনেকে বিদ্রোহী সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও আসাদ সমর্থক সেনাদের কিছু দল আত্মসমর্পন করেনি।

আত্মসমর্পণ না করা তেমনই আসাদ সমর্থক কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা সিরিয়ার বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা করছেন বলে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার খবরেও উঠে এসেছে। সে রকম একটি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আসাদের সেনাবাহিনীর সাবেক একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ঘাইয়াথ দাল্লাহর নেতৃত্বে বৃহস্পতিবার লাতাকিয়া ও জাবলে শহরের নিরাপত্তা রক্ষা বাহিনীর ঘাঁটিতে হামলা করে হতাহতের ঘটনা ঘটায় এক দল আসাদ সমর্থক সেনা।

ওই ঘটনার পর নিরাপত্তা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা আসাদ সমর্থক সেনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে। সিরিয়ার টেলিভিশনে প্রচারিত এক ভাষণে দেশটির নেতা আহমেদ আল-শারা ‘আসাদের বিশ্বস্ত’দের খুঁজে বের করার ঘোষণা দেন। তবে আহমেদ আল-শারার ইসলামপন্থী বাহিনী তিন মাস আগে সিরিয়ার ক্ষমতা দখল করলেও সবগুলো বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ওপর এখনো তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই।
সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো বেশ কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে, যাদের দলে বিদেশি সেনা রয়েছে এবং যারা কট্টরপন্থী ইসলামী মতাদর্শের অনুসারী।

আসাদ সমর্থক সেনাদের বিরুদ্ধে সিরিয়ার নিরাপত্তা রক্ষীরা অভিযান চালানোর সময় সিরিয়ার পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত সংখ্যালঘু আলাউইত গোষ্ঠীর নাগরিকদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালানো হয়। ভুক্তভোগীদের অনেকে বলছেন, তাদের ওপর বিদেশি বিদ্রোহী যোদ্ধারা হামলা চালিয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও লুটপাট চালায়।

পশ্চিম উপকূলের বানিয়াস শহরের হাই আল কুসর অঞ্চলের বাসিন্দা মোহামেদ ফারেস বিবিসি সংবাদদাতাকে ঞ্জানান, তিনি একাধিক পরিবারকে নিজেদের ঘরের ভেতর গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছেন। তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো পরিবারের সদস্যরা বাঁচতে ছাদেও পালাতে চেয়েছিল। সেখানে উঠে তাদের গুলি করা হয়।’

পাশাপাশি বানিয়াস শহরের বাসিন্দা আলী বলেন, ‘তারা আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে এবং আমাদের সব টাকা নিয়ে নেয়। আমার প্রতিবেশীর গাড়ি, সোনা আর টাকা নিয়ে নেয়। তাদের কথা শুনে তাদের উজবেক বা চেচেন মনে হচ্ছিল।’

আলাউইত সম্প্রদায়ের ওপর কেন হামলা
আলাউইতরা শিয়া মুসলিমদের একটি উপসম্প্রদায়। সিরিয়ার জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ আলাউইত। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদও ছিলেন এ সম্প্রদায়ের সদস্য।

গত ১৪ বছর সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলার সময় বাশার আল-আসাদের বাহিনীর হাতে সিরিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিরা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আলাওয়াইত সম্প্রদায়ের সেনা কর্মকর্তাদের অনেকের বিরুদ্ধে এসব নির্যাতন চালানোর পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, আসাদের শাসনামলে হাজার হাজার সিরীয়র, বিশেষ করে সুন্নিদের হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে আলাউইত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। সে সময় সুন্নি সেনা কর্মকর্তারা হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে মনে করে সুন্নি মতাবলম্বী সেনা কর্মকর্তাদের একটা বড় অংশ।

এর ফলে আসাদের পতনের পর থেকেই আলাউইতদের বিরুদ্ধে এক ধরনের জাতিগত বিদ্বেষের মনোভাব তৈরি হচ্ছিল সুন্নি মতাবলম্বী অনেকের মধ্যে।

এ রকম পরিস্থিতিতে পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে আসাদ সমর্থক আলাউইত সম্প্রদায়ের সেনারা নিরাপত্তা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা চালানোর পর সেসব এলাকার বেসামরিক আলাউইত নাগরিকদের ওপর হামলা ছড়িয়ে পড়ে।

কেন সিরিয়ায় এই অবস্থা
বাশার আল-আসাদের পতনের পর থেকে সিরিয়ায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অনেকে সাম্প্রতিক অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ী মনে করেন অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার নেওয়া কিছু সিদ্ধান্তকে। তিনি কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া সিরিয়ার সেনাবাহিনী, পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষাকারী সব বাহিনী ভেঙে দিয়েছেন। এর ফলে হাজার হাজার কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছেন ও তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে গেছে। আবার হাজার হাজার সরকারি কর্মকর্তাকেও চাকরিচ্যুত করেছে নতুন প্রশাসন।

সিরিয়ার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে ও তাদের একটা বড় অংশের চাকরি নেই। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ভেতর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, সিরিয়াকে এখন নিরাপদ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ হবে বিদেশি যোদ্ধাদের বের করা ও এমন একটি সংবিধান প্রণয়ন করা, যার মাধ্যমে ধর্ম বা সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব সিরিয়ানের অধিকার সুরক্ষিত হবে।