কামারুজ্জামানের রিভিউয়ের রায় সোমবার

SHARE

kamruzzama5মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনের শুনানি শেষ হয়েছে।

সোমবার রায়ের দিন ধার্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

রোববার সকালে প্রথমে আসামিপক্ষে শুনানি করেন কামারুজ্জামানের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। এরপর বিরতি দেওয়া হয়। বিরতির পরে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ শুনানি গ্রহণ করেন। বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হলেন বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

শুনানিতে কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় বাতিল করে খালাসের পক্ষে চারটি যুক্তি দেখান খন্দকার মাহবুব হোসেন।

তিনি বলেন, সোহাগপুর গ্রামে হত্যার ঘটনায় তিন সাক্ষীর বক্তব্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তারা হলেন ১১নং সাক্ষী হাসেনা বানু, ১২নং সাক্ষী হাফিজা বেওয়া ও ১৩নং সাক্ষী করফুলি বেওয়া। তাদের মধ্যে ১১নং সাক্ষী শোনা সাক্ষী।

অপর দুইজন সাক্ষী নিজেদেরকে প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করলেও তারা জেরায় বলেছেন, স্বাধীনতার পরে তারা কামারুজ্জামানকে দেখেছেন। অর্থাৎ পরের দুইজন সাক্ষী প্রত্যক্ষদর্শী হলেও তাকে স্বাধীনতার পরে দেখেছেন। এ অবস্থায় এসব সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না।

দ্বিতীয় যুক্তিতে তিনি আদালতকে বলেন, ট্রাইব্যুনালে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় আসামিপক্ষে দু’টি বই দাখিল করা হয়েছে। ওইসব বইয়ে রাষ্ট্রপক্ষের এক সাক্ষীর সাক্ষ্যও আছে। সেখানে কামারুজ্জামানের নাম নেই। কিন্তু আপনারা সেই দুই বই গ্রহণ করেননি। কারণ, ওই বইগুলো ২০১১ ও ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়েছে।

খন্দকার মাহবুব বলেন, ৪নং অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। আপিল বিভাগ এখানে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দেন। কারণে বলেছেন, ওই অভিযোগের সাক্ষীদের তথ্য সরাসরি হয়নি।  এই একই কারণে ৩নং অভিযোগে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা যায় না। এ দু’টি শাস্তি অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই আপনাদেও দেওয়া রায় পুনর্বিবেচনার যোগ্য।

সর্বশেষ যুক্তিতে খন্দকার মাহবুব বলেন, বিশ্বে যুদ্ধাপরাধের ৭টি বিচার হয়েছে। এর মধ্যে নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রায়ালে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিলো। অপর ৫টিতে নেই। এমনকি গোটা বিশ্ব মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি কমে আসছে। আমাদের দেশেও বিষয়টি বিবেচনার যোগ্য।

আসামিপক্ষের সময়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে এর আগে দু’দফায় পিছিয়েছে শুনানির দিন। গত বুধবার (১ এপ্রিল) কামারুজ্জামানের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন অসুস্থ বলে উল্লেখ করে চার সপ্তাহের সময়ের আবেদন জানানো হয়। ওইদিন চারদিন পিছিয়ে রোববার দিন পুনর্নির্ধারণ করেন আপিল বিভাগ। গত ৯ মার্চও শুনানির জন্য কার্যতালিকায় এলে প্রথমবার চার সপ্তাহের সময়ের আবেদন জানান আসামিপক্ষ। সেবারও কারণ হিসেবে খন্দকার মাহবুব হোসেনের ব্যক্তিগত অসুবিধার কথা বলা হয়েছিল। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে শুনানি পিছিয়ে ১ এপ্রিল পুনর্নির্ধারণ করেন সর্বোচ্চ আদালত।

গত ৫ মার্চ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল মামলার চূড়ান্ত পূর্ণাঙ্গ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদনটি দাখিল করেন কামারুজ্জামানের আইনজীবীরা। পরে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার বিচারপতির আদালতে শুনানির দিন ধার্যের আবেদন জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৮ মার্চ চেম্বার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী রিভিউ আবেদনটি শুনানির জন্য পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন।

মোট ৭০৫ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে ৪৪টি যুক্তি দেখিয়ে কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বাতিল ও তার খালাস চেয়েছেন আসামিপক্ষ।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) এসকে সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির একই বেঞ্চ কামারুজ্জামানের আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা করেন।

এরপর ১৯ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ তিন বিচারপতি কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করেন। অন্য দুই বিচারপতি হচ্ছেন বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলাম।

পরে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মুস্তাফিজুর রহমান মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে আইজিপি (প্রিজন) এর বরাবরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠান। পরে কারাগারে কামারুজ্জামানকে মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়।

গত বছরের ৩ নভেম্বর কামারুজ্জামানকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেওয়া ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে চূড়ান্ত রায় সংক্ষিপ্ত আকারে দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের কিলিং স্কোয়াড আলবদর বাহিনীর বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা কমান্ডার কামারুজ্জামানকে ২০১৩ সালের ৯ মে ফাঁসির আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

মুক্তিযুদ্ধকালে ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার সভাপতি ছিলেন কামারুজ্জামান। ২২ এপ্রিল তিনি জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ আলবদর বাহিনীর কমান্ডার কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে এই বাহিনী ওই অঞ্চলজুড়ে মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ ঘটায়।

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনা মোট ৭টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের মধ্যে সোহাগপুর গণহত্যার (৩ নম্বর অভিযোগ) দায়ে চূড়ান্তভাবে ফাঁসির আদেশ হয়েছে তার। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।

বিচারপতি ওয়াহহাব মিয়া সোহাগপুর গণহত্যায় কামারুজ্জামানকে অভিযুক্ত করলেও এ অভিযোগে তিনি তাকে যাবজ্জীবন দণ্ডের পক্ষে মত দেন। সেই সঙ্গে ১, ২, ৪, ৭ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া দণ্ড থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দেওয়ার পক্ষে মত দেন তিনি।

আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি) এসকে সিনহা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও  বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী সর্বোচ্চ সাজার পক্ষে মত দিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আসামির দণ্ড নির্ধারিত হয় মৃত্যুদণ্ড।

অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফাকে হত্যার (৪ নম্বর অভিযোগ) দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছেন তিনি। এ অভিযোগে ট্রাইবুন্যাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও সাজা কমিয়ে দিয়েছেন আপিল বিভাগ।

এ অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়।

দারাসহ ছয় হত্যার (৭ নম্বর অভিযোগ) দায়ে যাবজ্জীবন ও অধ্যক্ষ আব্দুল হান্নানকে নির্যাতনের (২ নম্বর অভিযোগ) দায়ে আরও ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া এ সাজাও বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।

তবে মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামান হত্যার (১ নম্বর অভিযোগ) দায় থেকে আপিল বিভাগ তাকে খালাস দেন। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছিলেন কামারুজ্জামান। এছাড়া ৫ নম্বর (১০ জনকে হত্যা) ও ৬ নম্বর অভিযোগে (টুনু হত্যা ও জাহাঙ্গীরকে নির্যাতন) ট্রাইব্যুনালের রায়ের সঙ্গে একমত হয়ে আপিল বিভাগও খালাস দিয়েছেন।