ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যার পর হাতেনাতে গ্রেফতার দুই খুনি জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলামের সঙ্গে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়ের দুই খুনির যোগসূত্র পাওয়া গেছে। জিজ্ঞাসাবাদে ওয়াশিকুরের দুই খুনি দাবি করেন, অভিজিতের হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত অন্তত দু’জন তাদের চেনাজানা। যাত্রাবাড়ীর মেসে তারা নিয়মিত যাতায়াত করতেন। জিকরুল্লাহ ও আরিফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ইতিমধ্যে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের রহস্য ভেদ করতে কাজ শুরু করেছেন গোয়েন্দারা। দায়িত্বশীল একটি গোয়েন্দা সূত্র এ তথ্য জানায়। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই অভিজিৎ হত্যায় জড়িত ওই দুই খুনির বিস্তারিত পরিচয় প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না গোয়েন্দারা। এছাড়া ওয়াশিকুর হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের মধ্যে আরিফুল প্রথমে জেএমবি সদস্য থাকলেও পরে তিনি উগ্রপন্থি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে যুক্ত হন।
দায়িত্বশীল গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জিকরুল্লাহ ও আরিফুলকে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কেও জানতে চাওয়া হয়। তারা সম্ভাব্য দুই খুনির বিষয়ে তথ্য দিয়েছেন।শারীরিক বিবরণও দেন তারা। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পাশে দুর্বৃত্তরা প্রগতিশীল লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে। স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের চাপাতির আঘাতে আহত হন অভিজিতের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যার আগে যাত্রাবাড়ীতে একটি আস্তানায় খুনিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। অন্তত ১৫ দিন আগে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। কিলিং মিশন সফল করার পাঁচ দিন আগে থেকে পরিকল্পনাকারীরা চাপাতি নিয়ে চলাফেরা শুরু করেন। চাপাতি নিয়ে চলতে অভ্যস্ত হতে তারা এ কৌশল নিয়েছিলেন। হত্যাকাণ্ডের একদিন আগে হাতিরঝিলে করা হয় চূড়ান্ত পরিকল্পনা। ওয়াশিকুর হত্যা মামলায় আট দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে খুনি জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলামকে। তাদের কাছ থেকে এসব তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এখনও হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত অন্যদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। এ ঘটনায় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় দায়ের করা হত্যা মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) স্থানান্তর করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, আরিফুল নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানায় ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় গ্রেফতার হন। ওই সময় তার সঙ্গে আরও ২৩ জন গ্রেফতার হন। তখন সেখান থেকে উগ্র মতাদর্শী লিফলেট উদ্ধার করা হয়। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের করা ওই মামলায় তিনি চার্জশিটভুক্ত আসামি ছিলেন। তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা শেষ করে মিরপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসায় উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য পড়ছিলেন। পরে ওই মামলায় জামিনে বের হয়ে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসীমুদ্দিন রাহমানীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তার অনুসারী হন। পরে সেই দলে যোগ দেন। তিনি উগ্র মতাদর্শী। জিকরুল্লাহ হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র বলে প্রাথমিক তথ্যে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে যাত্রাবাড়ী থেকে একজনের মোবাইল ফোন পাওয়া গেছে।সোমবার রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের দক্ষিণ বেগুনবাড়ীর মসজিদ গলিতে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন তিন তরুণ। তাদের মধ্যে জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম নামের দু’জনকে আটক করে জনতা। আবু তাহের নামের আরও একজন পালিয়ে যান। গ্রেফতারকৃতরা নিজেদের চট্টগ্রাম ও মিরপুরের দুটি মাদ্রাসার ছাত্র বলে পরিচয় দেন।
মনিরুল ইসলাম বলেন, জসীমুদ্দিন রাহমানীসহ তার অনুসারীরা পিকনিকের নামে সেন্টমার্টিন হয়ে মিয়ানমারে আরাকান রাজ্যে জিহাদ করার উদ্দেশ্যে রওনা করার পরিকল্পনা করেন। সেই পরিকল্পনা নস্যাৎ হলে পরবর্তী সময়ে জিকরুল্লাহ এই দলে যোগ দেন। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর স্লিপার সেলের মতো এদের গড়ে তোলা হয়েছে। এরা কেউ কাউকে চেনেন না বা একে অপরকে চেনার চেষ্টাও করেন না। গুপ্তহত্যার বিশেষ প্রশিক্ষণ শেষ করেই এদের মূল মিশনে পাঠানো হয়। গ্রেফতারের পরও তারা নিজেদের আসল পরিচয়, এমনকি সঙ্গীদের তথ্য লুকানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
ডিবি সূত্র জানায়, গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য দেন জিকরুল্লাহ ও আরিফুল। যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে দেখা যায়, সেগুলো সঠিক নয়। তবে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা গেছে। হত্যার নির্দেশদাতা বলে কথিত বড় ভাইয়ের নাম সম্ভবত মাসুম ওরফে হাসিব। জসীমুদ্দিন রাহমানীর অনুসারী এই যুবকের বয়স ৩০ বছরের আশপাশে। স্বাস্থ্যবান ‘বড়ভাই’ পাঞ্জাবি-পায়জামা পরেন। তার মুখে দাড়ি রয়েছে।ডিবি কর্মকর্তারা জানান, ওয়াশিকুরকে হত্যার প্রস্তুতি চূড়ান্ত হওয়ার পর ২৩ মার্চ দিন নির্ধারণ করা হয়। পরিকল্পনা ছিল, হত্যার পরই যে যার মতো পালিয়ে যাবেন। এ জন্য অভিযানে বের হওয়ার আগে তারা নয়ানগরের বাসাটিও ছেড়ে দেন। সেদিন তাদের কাছে চাপাতির পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্রও ছিল। কিন্তু ওয়াশিকুরকে হত্যার জন্য আসার পথে সন্দেহভাজন হিসেবে সাইফুলকে তল্লাশি করে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। এ সময় তার কাছে অস্ত্র-গুলি ও চাপাতি পাওয়া গেলে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এতে সেদিনের অভিযান বাতিল করা হয়। তবে অন্যরা পালিয়ে গিয়ে ফের সংগঠিত হয়ে হত্যার নতুন তারিখ নির্ধারণ করেন। এ যাত্রায় তারা সফল হন।