আইসিসি চেয়ারম্যান শ্রীনিবাসন ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আইসিসি সভাপতি মুস্তফা কামালকে বিশ্বকাপ ট্রফি দিতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফাইনালের আগের রাতে মেলবোর্নের লেংহ্যাম হোটেলে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর, বৈঠকে রীতিমতো কামালকে একঘরে করে রাখার চেষ্টা করেন শ্রীনিবাসন। কিন্তু ছেড়ে কথা বলেননি মুস্তফা কামাল। একাই বৈঠকে সবার বিরুদ্ধে লড়েন তিনি। এমনকি একপর্যায়ে শ্রীনিবাসনকে তুলাধোনা করতেও ছাড়েননি আইসিসি সভাপতি। এসব ঘটনায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসহ ভারতীয় গণমাধ্যমেও ব্যাপক তোলপাড় হয়। এদিকে গতকাল সোমবার রাতে বিবিসি বাংলাকে মুস্তফা কামাল বলেন, এ ঘটনায় বাংলাদেশ ও ভারতের ক্রিকেট সম্পর্কে প্রভাব পড়বে না।
পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা ওই বৈঠকের খবর সবিস্তারে প্রকাশ করেছে। ‘ট্রফি দিতে না পেরে উত্তেজিত আইসিসির সভাপতি ঢাকা ফিরে মামলা করতে পারেন’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে তারা লিখেছে, ‘নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন বিশ্বজয়ী অধিনায়ক ক্লার্কের হাতে ওয়ার্ল্ড কাপ তুলে দেওয়ার সময় পর্যন্ত তিনি (মুস্তফা কামাল) অবশ্য আর অপেক্ষা করেননি। অপমানে আগেই বেরিয়ে যান।
জানা হলো না, গোটা এমসিজি যখন শ্রীনিবাসনের নাম ঘোষণা হতেই বিদ্রূপে ফেটে পড়ল, তখন তিনি কোথায় ছিলেন?’ শনিবার রাতে লেংহ্যাম হোটেলে যে বৈঠকে শ্রীনিবাসন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সে বৈঠকের বিবরণও তুলে ধরে পত্রিকাটি। বৈঠকে শ্রীনিবাসন কামালকে বলেন, আইসিসির কোড অব কন্ডাক্ট ভাঙার অভিযোগে আমরা আপনাকে ট্রফি দিতে দেব না। তখন কামাল অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, মিস্টার শ্রীনিবাসন, আজকের দিনে আইসিসি প্রেসিডেন্ট কে? শ্রীনিবাসন বলেন, আপনি। কাল আইসিসির প্রেসিডেন্ট কে থাকবে? শ্রীনিবাসন বলেন, আপনি। তাই যদি হয়, তাহলে আমি বিশ্বকাপ তুলে দেব না কেন? শ্রীনিবাসন তখন বলেন, উত্তরটা আপনাকে আগেই দেওয়া আছে। এ সময় নাকি তীব্র বাদানুবাদের সৃষ্টি হয়। মুস্তফা কামাল নাকি তখন কাউকে ছেড়ে কথা বলেননি।
আনন্দবাজার জানায়, তর্কাতর্কির মধ্যে আইসিসি প্রেসিডেন্ট রীতিমতো আইসিসি চেয়ারম্যানকে শাসান, ‘আপনি এমন কোনো বেআইনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তা হলে আইসিসির গঠনতন্ত্র বদলাতে হবে।’ এতেও শ্রীনিবাসনকে প্রভাবিত হতে না দেখে কামাল বলেন, ‘এতে কিন্তু আগুন জ্বলবে। আপনি বুঝতে পারছেন না, কী করতে যাচ্ছেন।’ বিসিবি সভাপতিও নাকি শ্রীনিবাসনের সঙ্গে দেখা করে তীব্র আপত্তির কথা জানান। আনন্দবাজার পত্রিকা শঙ্কা প্রকাশ করেছে, চলমান এ দ্বন্দ্বে আগামী জুনে ভারতীয় ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে।
মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডেও (এমসিজি) কর্মফল পেয়েছেন নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন। ফাইনালে পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে সঞ্চালক মার্ক নিকোলাস শ্রীনিবাসনের নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এমসিজির গ্যালারি একসঙ্গে দুয়োধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে। তখন মঞ্চে উপস্থিত সবাই বেশ লজ্জায় পড়ে যান। অতিথিরা বুঝতে পারেন, শ্রীনিবাসনের ওপর ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছেন দর্শক। তার ভাগ্য ভালো। অবস্থা বেগতিক দেখে সঞ্চালক শ্রীনিবাসনের ডানে থাকা ক্রিকেট লিজেন্ড শচীন টেন্ডুলকারের নামটি একটু তড়িঘড়ি করেই ঘোষণা করেন। শচীনের নাম বলার সঙ্গে সঙ্গেই এমসিজির ৯৩ হাজার দর্শক করতালি দিয়ে ওঠেন। গতকাল এ বিষয়টি নিয়ে মুস্তফা কামাল কিংবা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কেউই কোনো কথা বলেনি। আগামীকাল বুধবার দুপুর ১২টায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামবেন মুস্তফা কামাল। সেখানে সংবাদ সম্মেলন করবেন তিনি।
আইসিসির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সভাপতি মুস্তফা কামালের বিজয়ী দলের হাতে ট্রফি তুলে দেওয়ার রেওয়াজ। কিন্তু গায়ের জোরে চেয়ারম্যান শ্রীনিবাসন তাকে মঞ্চেই উঠতে দেননি। এ অন্যায় গ্যালারির দর্শকের চোখ এড়িয়ে যায়নি। তাই তারা দুয়োধ্বনি দিয়ে শ্রীনিবাসনের গোঁয়ার্তুমির প্রতিবাদ করেন। ফাইনালে এমসিজিতে থাকা ৯৩ হাজার ১৩ দর্শকের মধ্যে উপমহাদেশের অনেকে ছিলেন। এর একটা বড় সংখ্যা আবার ভারতীয়। তারাও শ্রীনিবাসনের এ অন্যায় মেনে নিতে পারেননি। এমনকি ভারতীয় মিডিয়াগুলোও তার সমালোচনায় মুখর ছিল।
পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকা ছাড়াও এই সময়, এ বেলা থেকে শুরু করে ইংরেজি টেলিগ্রাফ, এনডিটিভিসহ প্রায় অধিকাংশ ভারতীয় গণমাধ্যম বেশ গুরুত্ব দিয়ে সংবাদটি প্রচার করেছে; পুরস্কার বিতরণীতে ঘটে যাওয়া লজ্জাজনক ঘটনাটির পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলে ধরেছে। তারা একপর্যায়ে লিখেছে, এ লজ্জার হাত থেকে উদ্ধার করায় শ্রীনিবাসনের উচিত শচীনকে একটি স্পেশাল ধন্যবাদ দেওয়া। সে যাই হোক, এক-আধটু ক্রিকেটের খোঁজখবর যারা রাখেন, তাদের কাছেও শ্রীনিবাসনের চেহারা স্পষ্ট হয়ে গেল। সে সঙ্গে আইপিএল ফিক্সিংয়ে তাকে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের কাছে অভিযুক্ত করার বিষয়টি সবিস্তারে বর্ণনা করেছে প্রভাবশালী ইংরেজি এ দৈনিকটি।
ট্রফি দিতে না দেওয়া গঠনতন্ত্রবিরোধী: বিবিসি বাংলাকে গতকাল রাতে আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘আমার সঙ্গে আইসিসির সম্পর্ক খারাপ হয়নি। কিন্তু আমাকে অপমান করা হয়েছে। এটা গঠনতন্ত্রবিরোধী।’তিনি বলেন, ‘আমি শেষদিন পর্যন্ত জানতাম ট্রফি আমি দেব। আমাকে বলা হয়েছে, ট্রফি দিতে পারব না। কারণ আমি বাংলাদেশ-ভারত খেলা নিয়ে মন্তব্য করেছি। কিন্তু ক্রিকেটে অনিয়মের বিষয়ে তো আমি কথা বলব।’ তবে কারা তাকে এ কথা বলেছে তা তিনি প্রকাশ করেননি। মুস্তফা কামাল বলেন, ‘আইসিসির খারাপ লোকেরা তাকে ট্রফি দিতে দেয়নি।’
আইসিসি প্রেসিডেন্ট বলেন, আমি আইসিসিতে থাকাব কি থাকব না তা দেশে ফিরে ঠিক হবে। আমার আইনি লোকজনের সঙ্গে কথা বলে মামলা করব। এটা পরিষ্কারভাবে অবমাননা। ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ নিয়ে মন্তব্য এবং শ্রীনি’র সঙ্গে এই ঝামেলার ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের ক্রিকেট সম্পর্কে ফাটল ধরবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভারতের যার কথা বলছি তিনি ভারতেই সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি। এমনিতেই ভারতের ক্রিকেটের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক রয়েছে।