ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় সমর্থন দিতে ছয়জন নেতাকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে বিএনপি। প্রতিটি সিটিতে দু’জন করে মোট ছয়জন সম্ভাব্য প্রার্থীকে নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ কষছেন দলের হাইকমান্ড। ওই সব নেতার অবদান ও দলে গ্রহণযোগ্যতাসহ প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর বিষয়টিও বিবেচনা করছেন তারা। সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা উত্তরে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুকে দলীয় সমর্থন দেওয়ার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত।
যদি কোনো কারণে মিন্টু প্রার্থী হতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে ঢাকা মহানগরের যুগ্ম আহ্বায়ক এম এ কাইয়ুমের কথা ভাবছে দলটি। অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন ও মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও বর্তমান মেয়র মনজুর আলম ও দলের মহানগর সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেনের ব্যাপারে হাইকমান্ড খোঁজখবর নিচ্ছেন।
অবশ্য কোনো কারণে প্রথম দু’জনের কাউকেই সমর্থন দেওয়া সম্ভব না হলে ঢাকা উত্তরে যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, দক্ষিণে দলের অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালাম ও সহসাংগঠনিকসম্পাদক কারারুদ্ধ নাসিরউদ্দিন আহম্মেদ পিন্টু এবং চট্টগ্রাম সিটিতে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিনের মধ্য থেকেও কেউ দলীয় সমর্থন পেতে পারেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান গতকাল বিবিসিকে বলেছেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা যায় কি-না, সেটা নিয়ে তারা ভাবছেন। যদিও একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, বিএনপি নির্বাচনে যাচ্ছে।
ঢাকা উত্তর: বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু দলের ঢাকা মহানগর কমিটিরও প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক। এফবিসিসিআইর এই সাবেক সভাপতি অখণ্ড ঢাকা সিটি করপোরেশনেও বিএনপির পক্ষে সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী হিসেবে আলোচিত ছিলেন। জানা গেছে, ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র হওয়ার ‘স্বপ্ন’ অনেক আগে থেকেই এই শিল্পপতির। আসন্ন নির্বাচনে ঢাকা উত্তর থেকে তিনি বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে হাইকমান্ডের চূড়ান্ত তালিকায় রয়েছেন। উত্তর সিটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এফবিসিসিআইর অপর সাবেক সভাপতি আনিসুল হকের নাম ঘোষণা করায় বিএনপিতে মিন্টুকেই সব বিবেচনায় যোগ্যতম ভাবা হচ্ছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, মিন্টু বৃহত্তর ঢাকার মেয়র হিসেবেই একজন যোগ্য নেতা। ঢাকা উত্তরে তিনি যোগ্যতম একজন প্রার্থী হিসেবে লড়বেন বলে জানান এই নেতারা।
কোনো কারণে মিন্টু নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলে বিকল্প হিসেবে রয়েছেন মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক কাউন্সিলর এম এ কাইয়ুম। দীর্ঘদিন কাউন্সিলর ও মহানগর বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে থাকায় ঢাকা উত্তর এলাকায় তার ভালো পরিচিতি রয়েছে। এ ছাড়া দলের একজন প্রভাবশালী প্রবাসী নেতার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের সঙ্গেও তার সদ্ভাব তৈরি হয়েছে।এ ছাড়া যুবদল সভাপতি ও মহানগর বিএনপির সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালও উত্তর সিটি করপোরেশনের ‘অন্যতম’ সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় রয়েছেন। দলের তরুণ কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে জনপ্রিয় হিসেবে তাকে অন্যতম বিকল্প প্রার্থী হিসেবে ভাবছেন হাইকমান্ড।
ঢাকা দক্ষিণ: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বিএনপির সমর্থন পাওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছেন কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন ও দলের ঢাকা মহানগর কমিটির সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক কারাবন্দি নাসিরউদ্দিন আহম্মেদ পিন্টুর নামও তালিকায় রয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আসাদুজ্জামান রিপনই দলের হাইকমান্ডের নজরে এগিয়ে রয়েছেন। ছাত্রদলের এই সাবেক সভাপতির নিজ জেলা মুন্সীগঞ্জের বিপুলসংখ্যক ভোটার রয়েছেন এ এলাকায়। এই ‘নিজস্ব ভোটব্যাংক’ থাকার সুবাদেও তিনি দলীয় সমর্থন পেতে পারেন। এ ছাড়া পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক হিসেবেও তার সুনাম রয়েছে। ২০১২ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের স্থগিত নির্বাচনেও তাকে কেন্দ্র করে সচেতন জনতা নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন তার অনুসারীরা।
অন্যদিকে, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল দলের তরুণ কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে জনপ্রিয় বলে মনে করেন সিনিয়র নেতারা। ছাত্রদলের এই সাবেক সভাপতি স্বেচ্ছাসেবক দলকে নির্জীব অবস্থা থেকে একটি কার্যকর সংগঠনে পরিণত করেছেন বলেও হাইকমান্ড মনে করেন। এ কারণেই অপেক্ষাকৃত এই তরুণ নেতাকে দলের মহানগর কমিটির সদস্য সচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। দলে নতুন প্রজন্মের যোগ্য নেতা তৈরি করার উদ্দেশ্যেই সুবক্তা সোহেলকে ঢাকা দক্ষিণে দলের সমর্থন দেওয়ার চিন্তা করছেন হাইকমান্ড।
এ ছাড়া কারাবন্দি নেতা নাসিরউদ্দিন আহম্মেদ পিন্টুকেও দক্ষিণ সিটিতে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ভাবা হচ্ছে। তবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় নিয়ে কারাগারে থাকায় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এ নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত তাকে দল থেকে সমর্থন দেওয়া হবে কি-না, তা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। দলের ভেতরে একাধিক গ্রুপিংয়ের বিষয় থাকায় একজন মেয়র পদপ্রার্থীর সশরীরে উপস্থিত না থাকলে নির্বাচনী দৌড়ে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কার কথা ভাবছে দল। সে হিসেবে শেষ পর্যন্ত পিন্টু নির্বাচনে অংশ নাও নিতে পারেন বলে জানা গেছে।
বিএনপির অর্থনীতি বিষয়ক সম্পাদক ও মহানগর বিএনপির উপদেষ্টা আবদুস সালামের কথাও সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে শোনা যাচ্ছে। মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব এই নেতার ঢাকার রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘ পরিচয় রয়েছে। একই সঙ্গে সাবেক প্যানেল মেয়র হিসেবেও তিনি অভিজ্ঞ প্রার্থী বলে বিবেচিত। তবে বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তিনি একটু বেকায়দায় রয়েছেন বলে মনে করছেন অনেকে।
চট্টগ্রাম সিটি: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বিএনপির মেয়র পদে সমর্থনের দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন বর্তমান মেয়র এম মনজুর আলম ও মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মীর নাছির উদ্দিন লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে মেয়র এম মনজুর আলম বলেন, ‘চট্টগ্রামে বিএনপির সমর্থন কে পাবে, সেটি চূড়ান্ত হওয়ার পরই নির্বাচন নিয়ে খোলামেলা কথা বলব। চেয়ারপারসন যার ওপর আস্থা রাখবেন, তারই নির্বাচন করা উচিত বলে আমি মনে করি।’জানা গেছে, বিএনপির সমর্থনে মনজুর আলম মেয়র হলেও পরে দলের সঙ্গে তিনি সেভাবে সম্পর্ক রাখেননি। তবে মনজুর আলমকে এগিয়ে রাখছে অভিজ্ঞতা ও ইমেজ। কাউন্সিলর হিসেবে টানা ১৫ বছরের সঙ্গে গত পাঁচ বছর মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা আছে তার। সিটি করপোরেশন পরিচালনার এ সময়ে সুনির্দিষ্ট কোনো দুর্নীতিতে জড়াননি তিনি।
আবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে যুবদল-ছাত্রদলের আখড়াও করেননি। উন্মুক্ত টেন্ডারে লটারির মাধ্যমে সব কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন, যা তার পক্ষে যাবে। তবে বড় প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ আনার ব্যর্থতা, জলাবদ্ধতা দূর, আবর্জনামুক্ত চট্টগ্রাম গড়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা ও করপোরেশনের আয় বাড়াতে পর্যাপ্ত নতুন প্রকল্প গ্রহণ করতে না পারার বিষয়গুলো যাচ্ছে তার বিপক্ষে। এ ছাড়া মেয়র থাকাকালে বিএনপির পরিবর্তে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে সখ্য বাড়ানোর কারণে দলীয় নেতারা নাখোশ তার ওপর।
এ কারণে মেয়র পদে বিএনপি এবার যোগ্য প্রার্থী মনে করছে দলের মহানগর সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেনকে। তৃণমূলের বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত থাকায় শাহাদাতের জন্য নেতাকর্মীরা মনেপ্রাণে মাঠে থাকবেন বলে ধারণা হাইকমান্ডের। মামলার আসামি হয়ে শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে থাকায় চট্টগ্রামে মেয়র নির্বাচনে এবার তৃণমূল নেতাকর্মীদেরই বড় ভূমিকা থাকবে বলে মনে করে বিএনপির এ অংশ।
এদিকে, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়টি মাথায় রেখে মীর নাছিরকেও তালিকায় রেখেছেন হাইকমান্ড। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে ভূমিকা রাখেন- বিএনপির এমন কোনো কোনো নেতার সঙ্গে ডা. শাহাদাতের বনিবনা না হওয়ার খবরও আছে হাইকমান্ডের কাছে। এ হিসেবে মীর নাছিরকেও আবার দলের হয়ে মেয়র নির্বাচনের দৌড়ে নামতে হতে পারে বলে নেতারা জানিয়েছেন।