বাবরি মসজিদ মামলায় রায় যা-ই হোক লাভ বিজেপির!

SHARE

ভারতে বাবরি মসজিদ নিয়ে মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষ হয়েছে গতকাল। দ্রুতই এই মামলার রায় হতে পারে। এই ইস্যুতে একটি নিবন্ধ লিখেছেন আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক প্রেমাংশু চৌধুরী। নীচে তার ভাষায় এটা তুলে ধরা হলো।

২০০৯ সালের কথা। তখন প্রথমবার অযোধ্যার মাটিতে পা দিয়ে হা-হুতাশ শুনেছিলাম। সেখানেই এক বৃদ্ধ হতাশ গলায় বলেছিলেন, এত বড় একটা জমি বছরের পর বছর লোহার বেড়ায় ঘেরা। মন্দির না হোক, অন্তত একটা কারখানা হলেও কিছু চাকরি হতো।

লিবেরহান কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে। উনিশশো বিরানব্বইয়ের ৬ ডিসেম্বরের আগের দিন পর্যন্ত যেখানটায় বাবরি মসজিদ দাঁড়িয়েছিল, লোহার বেড়ায় ঘেরা সেই এলাকাটার বাইরে পুলিশ, ভেতরে সিআরপি-র পাহারা। পাঁচ বার খানাতল্লাশি পেরিয়ে, লোহার খাঁচার ভিতর দিয়ে হেঁটে রাম ও তাঁর তিন ভাইয়ের বালক-মূর্তির দর্শন মেলে। সেখানে দাঁড়িয়ে সেই বৃদ্ধ ওই কথা বলেছিল। দু’বছর আগে যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে অযোধ্যা যেতে হয়েছিল। বৃদ্ধ মানুষটির সঙ্গে দেখা হয়নি। হতাশার বদলে দেখেছিলাম, অযোধ্যা আশায় বুক বাঁধছে। হনুমানগড়ির রাস্তায় রাম-সীতা-লব-কুশের ছবির পসরা সাজিয়ে বসা কিশোরী বলেছিল, এবার রামমন্দির হবেই হবে। মন্দির হলে দোকানে খদ্দের উপচে পড়বে।

ওই ঘেরা জমির আশপাশে একদল যুবক হাতে এক গুচ্ছ সিডি নিয়ে কেনার জন্য ঝুলোঝুলি করেন। সিডি-র মধ্যে বাবরি মসজিদ ভাঙার দৃশ্য। লালকৃষ্ণ আদভানী আর উমা ভারতীর বক্তৃতা। করসেবকদের ওপর পুলিশের গুলি চালানোর ছবি। উঠতি বয়সের ওই যুবকরা সকলেই রামমন্দির চান। মন্দির হলে দেশ-বিদেশের পর্যটক আসবেন। বিক্রি বাড়বে। গাইডের কাজ মিলবে। কনক মন্দিরের সামনে লাড্ডুর দোকানের মালিকরা বললেন, শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি মথুরার মতো রামের জন্মভূমি অযোধ্যাও পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।

বাবরি মসজিদ যখন ভাঙা হচ্ছে, ২০ বছর বয়সী অজয় সিংহ বিস্ত তখন হেমবতী নন্দন বহুগুণা গঢ়বাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মসজিদ ভাঙার ২৫ বছর পূর্তিতে তিনিই যোগী আদিত্যনাথ রূপে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই অযোধ্যার মানুষের আশার পারদ চড়েছে। দিল্লিতে বিজেপি সরকার। উত্তরপ্রদেশেও। মুখ্যমন্ত্রী গেরুয়াধারী আদিত্যনাথ। যাঁর গুরু গোরক্ষপুর মঠের মহন্ত দিগ্বিজয় নাথ ১৯৪৯-এ বাবরি মসজিদের ভেতরে রামসীতার মূর্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। এমন ঘটনার পরও অযোধ্যায় রামমন্দির হবে না? সরযূ নদীর তীরে মলিন অযোধ্যায় তীর্থযাত্রী-পর্যটকদের হাত ধরে উন্নয়নের জোয়ার আসবে না?

গতকাল বাবরি মসজিদ মামলার শুনানি শেষ হয়েছে। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ সম্ভবত নভেম্বরে অবসরের আগেই এ মামলার রায় ঘোষণা করে যাবেন। সাক্ষী মহারাজের মতো গেরুয়াধারী বিজেপি নেতারা ঘোষণা করে দিয়েছেন, ৬ ডিসেম্বর থেকেই রামমন্দির তৈরির কাজ শুরু হবে। কোর্টের ফয়সালা যা-ই হোক না কেন, রাজনীতির তাস বিজেপি-আরএসএসেরই হাতে থাকবে। তাঁর আমলে রামমন্দির তৈরি হলে নরেন্দ্র মোদি হিন্দুহৃদয়সম্রাট হিসেবে ইতিহাসে জায়গা পাকা করবেন। রায় বিপক্ষে গেলে ফের রামমন্দির আন্দোলনের নামে ধর্মের রাজনীতি শুরু হবে। বিজেপি-আরএসএস-এর এই দুদিকে ধারওয়ালা তরবারির সামনে কংগ্রেসের হাতে পেনসিল ছাড়া কিছু থাকবে না।

ইতিহাসও তা-ই বলছে। ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধী লোকসভা নির্বাচনের প্রচার শুরু করেছিলেন ফৈজাবাদ থেকে। এই ফৈজাবাদ জেলার মধ্যেই অযোধ্যা। অবশ্য এখন জেলার নাম পাল্টে অযোধ্যা হয়েছে। ১৯৮৬-তে শাহ বানো মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় খারিজ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে হিন্দুরা মুসলিম তোষণের চূড়ান্ত নমুনা হিসেবে দেখেছিল। হিন্দুদের মন ফিরে পেতে রাজীব ফৈজাবাদ থেকে প্রচার শুরু করে ‘রাম রাজ্য’ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁর অনুমতিতেই ভোটের আগে বিতর্কিত জমির কাছে রামমন্দিরের শিলান্যাস হয়েছিল বলেও মনে করা হয়। কিন্তু লাভ হয়নি। বোফর্স কেলেঙ্কারির বোঝা ছিলই। নরম হিন্দুত্বে সঙ্ঘ পরিবারেরই লাভ হয়। বিজেপি-আরএসএস একে রামমন্দিরের দাবির জয় হিসেবে তুলে ধরে। উত্তরপ্রদেশে তো কংগ্রেস ধাক্কা খায়ই। গোটা ভারতে বিজেপির সাংসদ সংখ্যা দুই থেকে এক লাফে ৮৫-তে পৌঁছায়।

ইতিহাস জানে, এরপর হিমাচলের পালামপুরে দলের জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে লালকৃষ্ণ আদভানী বিজেপির সভাপতি হিসেবে রামমন্দির আন্দোলনকে সমর্থন করার প্রস্তাব আনবেন। সোমনাথ থেকে অযোধ্যা-তিনি রথযাত্রায় বের হবেন। ভারতে কোনও ধর্মীয় জিগিরের পক্ষে রাজনৈতিক আন্দোলন খুব সম্ভবত সেবারই প্রথম। মোদি-অমিত শাহ জমানায় বিজেপির ‘মার্গদর্শক’ হতে বাধ্য হওয়া আদভানী রথে না চাপলে ভারতের রাজনীতি অন্য খাতে বইত কি না, সেটা অন্য বিতর্ক। কিন্তু বাস্তব হলো, সেদিনও নরসিংহ রাওয়ের কংগ্রেসের কাছে এর কোনও জবাব ছিল না। সোনিয়া-রাহুল গান্ধীর কংগ্রেসের কাছেও নেই।

১৯৯২-এ বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে যাওয়ার পরে ১৯৯৬-এ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ইশতেহারে প্রথম রামমন্দিরের প্রতিশ্রুতি দেয়। তারপর থেকে সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত বিজেপির ইশতেহারে রামমন্দিরের কথা একবারও বাদ যায়নি। ২০১৪ সালের পর ২০১৯-এও বিজেপি তার সঙ্কল্প-পত্রে বলেছে, সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে থেকে রামমন্দির তৈরির সব সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হবে।

সুপ্রিম কোর্টে মামলাতেও মোদি সরকার রামমন্দির তৈরির রাস্তা সহজ করার চেষ্টা করেছে। বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে ১৯৯৩-এ উত্তরপ্রদেশে রাষ্ট্রপতি শাসনের মধ্যেই কেন্দ্রের নরসিংহ রাও সরকার বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমিকে ঘিরে মোট ৬৭.৭০৩ একর জমি অধিগ্রহণ করে। তার মধ্যে রাম জন্মভূমি ন্যাসের ৪২ একর জমি ছিল। মোদী সরকার সুপ্রিম কোর্টে বলে, মুসলিমরা তো বাবরি মসজিদের ০.৩১৩ একর চাইছে। বাকি জমি আসল মালিকদের কাছে ফেরত যাক। বিশেষত রাম জন্মভূমি ন্যাসকে ৪২ একর ফিরিয়ে দেওয়া হোক। বিতর্কিত জমিতে যাওয়া-আসার জন্য রাস্তা খোলা থাকুক।

উদ্দেশ্য স্পষ্ট। জমি ফিরে এলে রাম জন্মভূমি ন্যাস পূজাপাঠ, মন্দির তৈরির কাজ শুরু করতে পারবে। এর পরে বাবরি মসজিদের জমির অধিকার মুসলিমরা ফিরে পেলেও চার পাশে হিন্দু মন্দিরের মাঝখানে এক চিলতে জমিতে নতুন করে কি আর মসজিদ তৈরি হতে পারবে?

রামমন্দির রাজনীতির সামনে কংগ্রেস চিরকাল এমন দিশেহারা ছিল না। ১৯৫২-তে দেশের প্রথম লোকসভা ভোটেও রামমন্দিরের ধুয়ো তুলেছিল রামরাজ্য পরিষদ নামের দল। ১৯৪৯-এ ২২ ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারে বাবরি মসজিদের মধ্যে রামের মূর্তি প্রতিষ্ঠা হয়। জওহরলাল নেহরু এবং সর্দার বল্লভভাই পটেল দিল্লি থেকে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থকে নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন, মসজিদ রক্ষা করতে হবে। কিন্তু জেলা প্রশাসন মূর্তি সরায়নি। ১৯৫২-র লোকসভা ভোটে অবশ্য কংগ্রেস ফৈজাবাদের দু’টি আসনেই জিতেছিল। নেহরুর রাষ্ট্রনির্মাণের ইতিবাচক জাতীয়তাবাদের সামনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মুখ লুকোতে বাধ্য হয়েছিল।

অযোধ্যার মানুষ সবকিছুর সাক্ষী। করসেবকদের দাপট থেকে ফৈজাবাদের নাম পাল্টে অযোধ্যা হয়ে যাওয়া। আদিত্যনাথ সরযূ নদীর ঘাট সাজিয়ে দীপাবলির আগে দীপোৎসব চালু করেছেন। কিন্তু অযোধ্যা এখনও দেশের পর্যটন সার্কিটে নেই। শহরের সবচেয়ে পুরনো হোটেল শান-এ-অবধের মালিক শরদ কপূর দেখা হলেই বলেন, রাস্তা ভালো হওয়া প্রয়োজন। পরিকাঠামো দরকার। অযোধ্যার ছেলেমেয়েদের জন্য ভালো স্কুল-কলেজ, চাকরির সুযোগ দরকার।

অযোধ্যাবাসীর প্রত্যাশা-রামমন্দিরের হাত ধরে রুটিরুজি আসবে। রামমন্দির হলে অবশ্য গোটা দেশেই হিন্দু-আবেগ উসকে দেওয়া হবে। চাকরির অভাব, গাড়ি কারখানায় ছাঁটাই থেকে নজর সরে যাবে। আর যদি রামমন্দিরের বিরুদ্ধে রায় আসে, তা হলে গোটা সঙ্ঘ পরিবার ফের রামমন্দির আন্দোলনে মাঠে নামবে। সে ক্ষেত্রেও রুটিরুজির সমস্যা থেকে নজর সরে গিয়ে ফের দেশের প্রধান চর্চার বিষয় হয়ে উঠবে আড়াই হাজার বছরের পুরনো এক মহাকাব্য।