বুয়েট ছাত্রের পোস্ট আবরার হত্যা মামলার আসামির পক্ষে, কমেন্টে নিন্দার ঝড়

SHARE

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর এতে অভিযুক্ত এক আসামির পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে বুয়েটের ১৫ ব্যাচের অপর এক শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ লিংকন। এ পোস্টের পর তাঁর সতীর্থদের মন্তব্য ও পাল্টা মন্তব্যে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এখানে তুলে ধরা হলো তার পোস্টটির কিছু অংশ-

তিনি লিখেছেন, ‘পোস্টটির প্রত্যেকটি কথা আমার নিজস্ব। কারও পছন্দ হলে গ্রহণ করবেন। নাইলে নাই। আদালত বাকিটা দেখবে।’

অভিযুক্ত আকাশের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার সম্ভবনা আছে জানিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘দয়া করে ওকে নিয়ে পাবলিক শেমিং এখনই করবেন না। আদালত বাকিটা দেখবে।’

‘বুয়েটের আবরার খুন ও আসামী আকাশের কথা’ শিরোনামের সেই পোস্টে তানভীর আহমেদ লিংকন লিখেছেন-

‘আমি বুয়েটের ১৫ ব্যাচের, চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। আমি আবরার হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে আন্দোলনের সাথেও যুক্ত ( ফ্রন্ট লাইনে না, সাধারণদের সাথে)। অবশ্যই একজন খুনির পক্ষ নিচ্ছি না, আপাতত লিখছি একজন অসহায় ছেলের পক্ষ হয়ে অভিযুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত।’
তিনি লিখেছেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে আমার কিছুই হোক না কেন আকাশ কে নিয়ে একটা পোস্ট দেয়া উচিত। আকাশ, ১৬ ব্যাচের সিভিলের শিক্ষার্থী। আবরার হত্যাকাণ্ডের এজাহারের ১৩তম আসামী। তার বাবা রিকশাচালক এবং এক সময় মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন থেকে বৃত্তি পেত এখন পায় না, এখন ভলান্টিয়ার হিসেবে আমার সাথে কাজ করে।
আকাশকে আমি খুব ভালো করেই চিনি। সে এমন করার কথা না। তাই এজাহারে নাম আসার পর থেকেই তার ব্যাপারে খোঁজ-খবর করতে থাকি এবং বুয়েটের আড়িপেতে শোনা গ্রুপে একটা পোস্ট দিই তার ব্যাপারে খোঁজ-খবর করার জন্য। ১৬, ১৭, ১৮ ব্যাচের অনেকের সাথে কথা বলে কেউ আকাশের ব্যাপারে র‍্যাগ দেয়া তো দূরে থাকল জুনিয়র দের সাথে ঝাড়ি মেরেও কখনো কথা বলে নি। কিন্তু এরপরও ফার্দার খোজ খবর নেয়ার পরও কেউ আকাশের ব্যাপারে আমাকে নেগেটিভ কিছু জানাতে পারেনি।’

‘ঘটনার দিন তিতুমীরের ক্যান্টিনে আমার সাথে আকাশের দেখা হয়। সেই সময় তার সাথে কথা বলে জানতে পারি আকাশ আবরার এর ঘটনাটা খুব কাছ থেকেই দেখেছে।
আকাশ খুব আফসোস করে বলতেছিল -“ভাই মেরেই ফেলল শেষ পর্যন্ত। আমি চাইছিলাম হাসপাতালে নিতে৷ কিন্তু যখন নিতে চাই ওকে সিড়ির কাছে রেখে যায়। ভাইদের বলতেছিলাম তখন আপনাদের রবিন, আর জিয়ন ভাই দেখে হাসে। বলে ও ভং ধরতেছে। তখন ছেলেটা কালেমা পড়তেছিল। এর একটু পরই ছেলেটা মারা যায়।”- লিখেছেন তানভীর।

‘এদিকে আকাশের বুয়েট লাইফের শুরু থেকেই EEE 09, BUET এর এক ভাইয়া ওকে খুব সাহায্য করেছে। নিজে গাবতলীতে গিয়ে আকাশ কে প্রথম নিয়ে এসেছিল হলে উঠায়ে দিয়েছিল। নিজ হাতে ওকে ঢাকা শহর চিনিয়েছে। টার ডিপার্টমেন্ট এর সিনিয়র দের সাথে পরিচয় করে দিয়েছে৷ আপন বড় ভাই এর মতই পাশে থেকেছে।

আকাশ শুরু থেকেই খুব টেনশনে ছিল। টিউশনি করিয়ে ও গাজিপুরে যায়। তারপর সেই ভাইয়ার সাথে কথা হয়। ভাইয়া আকাশ কে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। আকাশ তখন পুলিশ কে ফোন দিয়ে নিজের অবস্থান জানায় এবং পুলিশ বলে আপনাকে আসতে হবে না আমরা আসতেছি। কিন্তু পুলিশ তাকে গ্রেফতার হিসেবে দেখিয়েছে।’

‘আকাশ ও তার রুমমেট Farjain Ismail এর ভাষ্যমতে-

১. রাত ১১ টা পর্যন্ত দুই রুমমেট রুমেই ছিল, পড়ছিল। এরপর ইসমাইল বাইরে খাইতে যায়।

২. আকাশের ভাষ্যমতে, রাত ১২:৩০-এ ফোনে জাস্ট ডাক দেয় (কোনো কারন, ঘটনা কিছুই বলেনি) কোন এক বড়ভাই, যেভাবে আবরারকে ডাক দেয়া হইছিল। সিসি ফুটেজে ১২:৪৪-এ ওরে ২০১১-এর দিকে যাইতে দেখা গেছে।

৩. ২০১১-তে গিয়ে আবরারকে মাটিতে শোয়া দেখে আকাশ আর রুমে ঢুকে নাই। এই অবস্থায় রুমমেট ইসমাইল উপরে এসে রুমের চাবি নেয়। (সিসি ফুটেজ ১২:৫৪)

৪. আকাশও রুমে ফিরে আসে। (সিসি ফুটেজ ১২:৫৬) তারপর আবার উপরে যায়, গিয়ে ২০০৫ এ দেখতে পায় গুরুতর অবস্থায়। সে সময় অনেকেই দেখতে আসে আবরারকে। অ্যাম্বুলেন্স,পুলিশও আসে।

৫. সে বাকিদেরকে বলে, আবরারকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য। বাকিরা হাসাহাসি করে (এইটা পরে অন্যের থেকে শুনেছি)

৬. আবরারকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য সিঁড়ির কাছে আনলে আবরারের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, সে কলেমা পড়ে। এই অবস্থায় ওরে অইখানেই নামায় রাখে।

ওর ভাষ্যমতে ও কোনো অন্যায় করেনাই। উলটা আবরারকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলে হাসির পাত্র হয়।

আর কয়েকটা বিষয় হলো-

আকাশ ছাত্রলীগের কোন পোস্টেড ও ছিল না। তবে ও কিছুদিন আগে ছাত্রলীগে জয়েন করেছিল। কিছু করার ছিল না। নাম দিয়েছিল। হলে থাকতে হলে অনেক কিছুই মেনে চলতে হয়৷ কিন্তু কেউ কোনোদিন আকাশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দিতে পারে নি। অভিযোগ দিবে কিভাবে। আকাশ নিজেইতো ঠিকমত কিছু বলতে পারে না।

আকাশ কি করেছে বা করেনি সেটা অবশ্যই আদালত দেখবে। বিচার আদালত করবে৷ কিন্তু এমন এমন যাতে না হয় ওর পক্ষে কোনো উকিল না থাকার জন্য নিজে ফেসে না যায়।

কেননা ওর বাবা রিকশা চালায়। পরিবারের কেউ পড়ালেখা জানে না। ছোট ভাই বোন ক্লাস ৭ ও ৪-এ পড়ে। টাকা এক আনাও নাই। কোনো উকিল ওর পাশে দাঁড়াবে না। কাগজপত্রের কাজ করারও কেউ নাই। এই সুযোগে প্রকৃত খুনীরা ওরে বলির পাঠা বানিয়ে বের না হয়ে যায়।

ওর ফ্যামিলির সাথে কথা বললাম এখন পর্যন্ত তারা ঢাকা আসতে পারে নি। কোন খোজ নিতে পারে নি। কোন লইয়ার ধরতে পারেনি।

বিচারে কিছুই হোক সে একটা অন্তত নিজস্ব লইয়ার পেতে পারে। আর বিচারের আগ পর্যন্ত তাকে পাবলিক শেমিং থেকে বিরত রাখাই উচিত৷ আমার মনে হয় সে কয়েকদিন পর ব্যতিক্রম কিছু না হয় এমনিতেই ছাড়া পেয়ে যাবে।

‘আরো কয়েকটি বিষয়’ শিরোনামে তানভীর লিখেছেন-

১. এখন পর্যন্ত কারো জবানবন্দিতে আকাশের নাম আসে নাই।

২. আব্রার খুনের মেসেঞ্জার গ্রুপে আকাশ ছিল না; ওরে রাখে নি। ছাত্রলীগ নাম লিখায় নিয়ে গিয়েছিল দুই রুম মেটের। এইটা ডিনাই করার সামর্থ্য যেখানে কারো নাই, আকাশের তো না ই! সামান্য সদস্য বিধায় ওর সাথে কেউ কিছু শেয়ার না করায় কিছুই জানতো না।

৩. আকাশ বলছিল, ৫-৭ মিনিট দাঁড়ায় ছিল ২০১১ এর সামনে (বাস্তবে সিসি ফুটেজ অনুসারে ১২:৪৪ এ দুই তলায় উঠে এবং ১২:৫৬তে নেমে যায়)। কারন বলছিল ওরে বড় ভাই ডাকছে, দেখা করতে গিয়েছিল, রুমে আব্রার কে আহত অবস্থায় দেখে ঘাবড়ে যায়। নেমে আসার পরে আবার দুই তলায় যায় বিবেকের তাড়নায়, গিয়ে ডাক্তারের কথা বলে হাসির পাত্র হয়।’

এ বিষয়ে সুবিচারের প্রত্যাশা করেছেন পোস্টদাতা তানভীর। তিনি লিখেছেন-
‘আমার শুধু চাওয়া:
১. আকাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে নির্দোষ প্রমানিত হবার। সে নির্দোষ হয়ে বেরিয়ে এসে যেন শেইমিং-এর শিকার না হয়।
ওর মানসিক শক্তি যে রকম, আমার ধারণা সে ক্ষেত্রে ও সুইসাইড কিংবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যেতে পারে। যা একজন নির্দোষের ক্ষেত্রে মানা যাবে না।
আশংকা:
ওর পক্ষে কথা বলার জন্য কোনোদিনই উকিল পাওয়া যাবে না। আর নির্দোষ বলেই মেইন খুনিরা ওরে ফাঁসিয়ে দেবার চান্স আমি দেখছি। সেক্ষেত্রে আসলে আমাদের কিছুই করার নাই।
আমি আকাশ কে নিয়ে যতটুকু জানি তা লিখলাম। বুয়েটের অনেকেই পাশে আছে তার। আর আকাশ কে নিয়ে এতোদিন পাবলিক শেমিং হল তা আপাতত অফ রাখলেই মনে হয় ভাল হয়।
পোস্টের মূল উদ্দেশ্য হল আকাশ কে নিয়ে পাবলিক শেমিং বন্ধ করা। এবং এই মুহুর্তে তার এলাকার কেউ থাকলে সামাজিক ভাবে তার পরিবার কে সাপোর্ট দেয়া।’

তবে এ পোস্টটি দেওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবরামের হত্যা পরবর্তী নানা ঘটনার বিষয় বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। অনেকেই কড়া সমালোচনা করেছেন পোস্টদাতার। এর মধ্যে কয়েকটি তুলে ধরা হলো নিচে-

রুদ্র আসাদুজ্জামান লিখেছেন, ‘একটা গণপিটুনিতেও তিন-চারজনের বেশি কেউ মারতে পারে না। এখানেও তিন-চারজনের বেশি কারো মারার কথা না। কিন্তু প্রত্যক্ষ দায় সবার।….”

রিজওয়ান হুসেই বাপ্পি লিখেছেন, ‘অপরাধ জেনেও সে চুপ করে থাকার প্রেক্ষিতে সে ফেঁসে যেতে পারে। তার উচিত ছিল পুলিশকে বা প্রভোস্টকে ঘটনা অবহিত করা। কিন্তু সে করেনি। এই কারণে সেও ফাঁসবে। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে দুজনেই আইনের চোখে অপরাধী।’

আসিফ হোসেইন লিখেছেন, ‘অমিত নাকি হলেই ছিল না- এমন পোস্ট দেখার পর এই পোস্ট দেখে বিরক্তি ধরে যাচ্ছে। আদালত সম্ভবত অনেককেই বেকসুর খালাস দিবে। বিশ্বজিতের কথা মনে আছে বা আবুবকরের? সবাই নিরপরাধ। তাই হুদাই আর এই সাফাই পোস্ট দিয়েন না।’

রাফিউল আনুপ লিখেছেন, ‘ওইদিন রাত ৯টার পর সে মুগদায় টিউশনি করে হলে ফিরে গেছে। ৯:৩০-১০টার আগে তার হলে পৌঁছার কথা না। ঘটনার শুরু মনে হয় আরো আগেই হয়েছে।’

আসিফ মো. ইমরান খান লিখেছেন, ‘অপরাধীদের জন্য ট্রাম্প কার্ড বেরিয়ে পরল। এখন পরবর্তী স্বীাকারোক্তি গুলোতে দেখা যাবে অপরাধীদের লয়্যার রা শিখায়া দিতেছে যে আকাশের নাম বেশি নিবা। বলব প্রাণঘাতি আঘাত টা ওি করছে। এই পোস্ট গুলো আমরা যেমন দেখছি, অপরাধীদের পরিবার, উকিল রাও দেখছে। উকিলরা টাকার জন্য কাজ করে, টাকার জন্য ওরা দিনকে রাত করতে পারে। এই একজনের ঘাড়ে পা রেখে বাকিগুলো পার হবে এখন।’

মিনহাজ এলাহি ইসলাম লিখেছেন, ‘আমরা বিচারের আগেই বিচার করে ফেলি ! অমিতের ম্যাসেজ ফাঁস না হলে হয়তো তাকে নিয়েও অনেকে পোস্ট করত , সে নির্দোষ ! অথচ এক ম্যাসেজই সব কিছু উলট পালট করে দিলো । এই জাতীয় পোস্ট ই আমার কাছে অপরাধ বলে গণ্য , কারন কে জড়িত আর কে জড়িত না সেইটা এইভাবে বলার এখতিয়ার এখন আর আমাদের নেই । তদন্তে দোষী প্রমানিত হলে এই পোস্টদাতাকেও গ্রেপ্তার করার দাবী জানাই।’

ইমতিয়াজ হাসান লিখেছেন, ‘আকাশের বাবা রিক্সা চালায়, গরীব… হ্যান ত্যান লজিক দিয়ে যাতে কোন খুনি পার না পেয়ে যায়। তবে, কোন নির্দোষ ব্যক্তির সাজা হোক এটাও চাই না। আকাশ যদি খুনের সাথে জড়িত না থাকে, আল্লাহ ওকে রক্ষা করুক।’