জুয়ার কারবার থেকে সাবেক কয়েকজন মন্ত্রী কত টাকা নিতেন জানিয়েছেন তাঁরা

SHARE

ক্যাসিনো ও জুয়ার আসর বন্ধে চলমান অভিযানে ধরা পড়া যুবলীগের দুই নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও এস এম গোলাম কিবরিয়া (জি কে) শামীম এবং কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ রিমান্ডে গুরুত্বপূর্ণ নানা তথ্য দিচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ক্যাসিনো বার ও জুয়ার কারবার থেকে রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি সাবেক কয়েকজন মন্ত্রী কত টাকা নিতেন সেই তথ্য দিয়েছেন তাঁরা। তাঁরা বলেছেন, উত্তরা, মিরপুর, ওয়ারী, মতিঝিলসহ আটটি এলাকায় সহস্রাধিক জুয়ার আসর ও ৬০টি ক্যাসিনো বার রয়েছে।

ক্যাসিনো ও জুয়ার কারবার বন্ধে গত মঙ্গলবার থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান চলছে। ওই দিন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর গ্রেপ্তার করা হয় যুবলীগ নেতা পরিচয় দেওয়া ঠিকাদার জি কে শামীম ও কৃষক লীগ নেতা ফিরোজকে। তাঁদের তিনজনকেই রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেছেন, শুধু যুবলীগের রাঘব বোয়ালরাই ক্যাসিনো ও জুয়ার কারবারে জড়িত নন, গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের একাংশের বিরুদ্ধেও এসব কারবারে জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। রিমান্ডে থাকা যুবলীগ নেতা খালেদ ও জি কে শামীম প্রতিদিন জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছেন। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদকারী গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ জানিয়েছেন যে তাঁর জানা মতে রাজধানীর সব থানা এলাকায় প্রতিদিন কয়েক হাজার জুয়ার আসর বসে। সেই সঙ্গে অন্তত ৬০টি ক্যাসিনো বার রয়েছে। এর মধ্যে মতিঝিল এলাকায় ১৩টি ক্লাবে ক্যাসিনোর রমরমা কারবার চলত। গুলশানের বেশির ভাগ ক্লাবে জুয়ার আসরের পাশাপাশি অন্তত ২০টি ক্যাসিনো কারবার রয়েছে। এ ছাড়া উত্তরা এলকায় ছোট-বড় ৪০টিরও বেশি ক্লাব, আবাসিক এলাকার ভবনে ক্যাসিনো ও জুয়ার আসর রয়েছে। এ ছাড়া পুরান ঢাকার মধ্যে ওয়ারী এলাকায় কিছু ক্লাবে অন্য জুয়ার পাশাপাশি ক্যাসিনো বারও চলত। মিরপুর, গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও, কামরাঙ্গীর চর এলাকাসহ প্রায় প্রতিটি এলাকায় বিপুলসংখ্যক জুয়ার আসর রয়েছে। খিলগাঁও, বাসাবো, বনশ্রী ও উত্তরার বিভিন্ন সেক্টরের বাসা-বাড়িতে মিনি জুয়ার আসর বসে। সবই পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন জানে। একসময় যারা বিএনপির রাজনীতি করত, তারাও সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে ক্যাসিনো জুয়ার কারবারে জড়িয়ে পড়েছে।

খালেদ আরো বলেছেন, রাজধানীর জুয়ার আসর ও মাদক কারবার তাঁদের নিয়ন্ত্রণেই চলত। নেতৃত্বে ছিলেন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। এই কারবারে একসময় বিএনপি-জামায়াতের কয়েকজন সাবেক শীর্ষ নেতারও নিয়ন্ত্রণ ছিল।

অন্যদিকে জি কে শামীম জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, তিনি গর্ণপূর্তের ঠিকাদারি নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। তবে একসময় যুবলীগ নেতা সম্রাট ও খালেদের সঙ্গে তিনিও ক্যাসিনো কারবারে জড়িত ছিলেন। শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও তাঁর সহযোগী ছিল। সেই সঙ্গে সরকারের অনেক নেতা তাঁকে সব সময় অর্থের বিনিময়ে সুবিধা দিতেন। বিএনপির এক শীর্ষ নেতার সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক রয়েছে।

ক্যাসিনো কারবারে মতিঝিল আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের বেশির ভাগ নেতা

জিজ্ঞাসাবাদে যুবলীগ নেতা খালেদ ঢাকায় ৬০টি ক্যাসিনোর নিয়ন্ত্রক ২৫ জনের নাম বলেছেন। তাঁদের মধ্যে যুবলীগের পাশাপাশি মতিঝিলের আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, গুলশান ও মতিঝিল এলাকার কয়েকজন কাউন্সিলর রয়েছেন। এর মধ্যে যাঁদের নাম জানা গেছে তাঁরা হলেন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, সহসভাপতি এনামুল হক আরমান, সোহরাব হোসেন স্বপন ও সরোয়ার হোসেন মনা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল হক সাঈদ, নির্বাহী সদস্য জাকির হোসেন, খায়রুল, উজ্জল ও রিমন, মতিঝিল আওয়ামী লীগের সহসভাপতি স্বপন, মুরসালিন, মনির হোসেন, মনা ও রানা, সাংগঠনিক সম্পাদক সারওয়ার হোসেন বাবু, সদস্য জামান ও মাকসুদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মোল্লা মো. আবু কাউসার ও কাউন্সিলর আনিসুর রহমান। এ ছাড়া গুলশান এলাকার একাধিক ক্লাব ও জুয়ার আসর এবং বারের সঙ্গে যুক্ত আছেন দুজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর।

এদিকে ঢাকার বিভিন্ন অবৈধ ক্যাসিনোতে কাজ করা ৯ নেপালি নাগরিককে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছিলেন রমনা থানার কনস্টেবল দীপঙ্কর চাকমা এবং একটি গোয়েন্দা সংস্থার দুই সদস্য। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) শৃঙ্খলা বিভাগ ভিডিও ফুটেজ দেখে তাঁদের শনাক্ত করেছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। দুই গোয়েন্দা সদস্যের মধ্যে একজনের নাম আক্তার বলে জানা গেছে। অন্যজনের নাম জানাতে রাজি হয়নি ওই সূত্রগুলো।

ডিএমপির রমনা বিভাগের উপকমিশনার সাজ্জাদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশের এক সদস্য ও দুই গোয়েন্দা সদস্যের সহযোগিতায় ৯ নেপালি নাগরিক পালিয়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।

রমনা থানার ওসি মাঈনুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দীপঙ্কর আমার থানার কনস্টেবল। সে ছুটি না নিয়ে গত ৩ সেপ্টেম্বর থেকে থানায় অনুপস্থিত। মৌখিকভাবে সে অসুস্থতার কথা বলে রাজারবাগ হাসপাতালে চিকিৎসার কথা জানিয়েছিল। এর পর থেকে সে আর থানায় যোগদান করেনি। ক্যাসিনো কারবারে জড়িত নেপালিদের পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করার প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দুই সদস্য ক্যাসিনো কারবারি নেপালিদের র‌্যাবের অভিযানের সময় পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের একজনের নাম আক্তার। যাচাই-বাছাই করে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’