চেয়ারম্যানের স্ত্রী খুকি ও এমপিপুত্রের দিকে অভিযোগের আঙুল

SHARE

নিহত রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফের একটি সংবাদ সম্মেলনের প্রতিবাদ জানিয়ে ও নিজের মেয়ে আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে নির্দোষ দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর। আজ বুধবার দুপুর ১২টায় বরগুনা প্রেসক্লাবে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে মিন্নির মা জিনাত জাহান মনি, ছোট বোন মেঘলা, ভাই কাফি, নানা মাহতাব হোসেন মোল্লা, নানা পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান জাকির সিকদার উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বলেন, দুলাল শরীফ প্রভাবশালী মহল দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইতোপূর্বে আমার মেয়ের গ্রেপ্তারের জন্য দাবি তুলেছিলেন। যার প্রেক্ষিতে মিন্নি ১ নম্বর সাক্ষী থেকে আসামি হয়েছে। রিফাত শরীফ হত্যায় আসামিদের আড়াল করতে মিন্নিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

প্রভাবশালী মহল কারা? সংবাদ সম্মেলনের এক পর্যায়ে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বলেন, এখানে দুটি চক্রের সদস্যরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, যার একটি পক্ষ নয়ন বন্ড। এই নয়ন বন্ডকে শেল্টার দিতেন এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথ। এই সুনাম দেবনাথই মিন্নিকে ফাঁসানোর জন্য মানববন্ধনসহ বিভিন্ন চক্রান্ত করে যাচ্ছে।

মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর এ সময় আরো বলেন, তার মেয়ে অসুস্থ। কিছুদিন আগেও তাকে চিকিৎসা করানো হয়েছে ঢাকা নিয়ে। পুলিশি নির্যাতনে তার মেয়ে এখন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। তার চিকিৎসার বিশেষ প্রয়োজন। পুলিশ এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রভাবশালী মহলকে আড়াল করতে আমার মেয়েকে ফাঁসাচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, রিফাত হত্যাকাণ্ডের আগে রিফাতের সাথে বরগুনা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রী শামসুন্নাহার খুকির সাথে বাক-বিতণ্ডা হয়। এরপর খুকি তার বোনের ছেলে রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীর কাছে এ বিষয়ে নালিশ করে যা ইতোমধ্যে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে। যেদিন হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল, সেদিন হত্যাকারী রিফাত ও রিশান ফরাজী বলেছিল, ‘তুই আমার মাকে গালাগাল করেছিস। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বল’।

মোজাম্মেল হোসেন কিশোর আরো বলেন, রিফাত ও রিশান ফরাজী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খুকিকে মা বলে ডাকতেন। তাই তা ধারণা হচ্ছে এটাও এই হত্যাকাণ্ডে রিফাত ও রিশান ফরাজীর আগ্রাসী ভূমিকার কারণ হতে পারে। মাকে গালাগাল করার প্রতিশোধ নিতে গিয়েই রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী হত্যাকাণ্ডের অগ্রভাগে ছিলেন বলে তার ধারণা। রিফাত ও রিশান ফরাজিই এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছে যা পুলিশ সঠিকভাবে তদন্ত করলেই এ বিষয়ে নকল তথ্য বেরিয়ে আসবে।

তিনি আরো বলেন, ‘২৬ জুন প্রকাশ্য দিবালোকে তার জামাতা শাহনেওয়াজ রিফাতকে (রিফাত শরীফ) কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। সে সময় শত শত মানুষ কেউ এগিয়ে না এলেও তার মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অস্ত্রের মুখে দাঁড়িয়ে স্বামী রিফাতকে একা বাঁচানোর চেষ্টা করে। এ ঘটনায় যে ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয় তার মাধ্যমে মিন্নি দেশবাসীর কাছে সাহসী নারী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

এরপর দুলাল শরীফ বরগুনা সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার ১ নম্বর সাক্ষী হিসেবে মিন্নিকে রাখা হয়।

প্রভাবশালী মহলের চাপে ১৩ জুলাই মিন্নির গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন দুলাল শরীফ। এরপর মানববন্ধন করে মিন্নির গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়। ১৬ জুলাই পুলিশ মিন্নিকে আসামি শনাক্তকরণের কথা বলে বরগুনার পুলিশ লাইন্সে নিয়ে যায়। এরপর দীর্ঘ ১১ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাত ৯টায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এরপর রিমান্ডে নিয়ে তার ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে বাধ্য করে।

মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বলেন, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমনিতেই তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করছেন। তার সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ। তাদের স্কুলে যাওয়া-আসাও বন্ধ। বিভিন্ন মহলের হুমকির কারণে প্রতি মুহূর্তে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে তাকে চলতে হয়। প্রভাবশালী মহলের চাপে প্রথমদিকে কোন আইনজীবী তার মেয়ে মিন্নির রিমান্ড শুনানিতে দাঁড়াননি।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে মোজাম্মেল হোসেন কিশোর আরো বলেন, রিফাত শরীফ হত্যার পরে তার বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে বরগুনা সদর থানায় যখন হত্যা মামলা দায়ের করেন তথন তার পুত্রবধূ মিন্নিকে ১ নম্বর সাক্ষী রাখেন। কারণ তখন তার পুত্রবধূর প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা ছিল। যখনই প্রভাবশালী মহলের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, যখনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিন্নির বিরুদ্ধে মিথ্যাচার শুরু হয়েছে। যখনই নয়ন বন্ডের মা প্রভাবিত হয়ে মিথ্যা তথ্য দিতে শুরু করেন, যখনই মূল ভিডিও আড়াল করে আর একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করা হয়। তখনই মিন্নিকে সাক্ষী থেকে আসামি করা হলো।

‘রিফাত রিশান কেন ঘটনার অগ্রভাগে’ এমন শিরোনামে দৈনিক কলের কণ্ঠের ২১ জুলাইয়ের একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, সেখানে ছাপা হয়েছে, গত ৫ মে বরগুনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেনের বাসার গেটের পাশে থাকা মাটিয়াল ক্যাফে রেস্টুরেন্টে নিহত রিফাত ও তার স্ত্রী নাস্তা করতে গেলে রিফাত শরীফ তার মোটরসাইকেল চেয়ারম্যানের বাসার সামনের গেটে রাখতে গেলে চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রী খুকির বাধা দেন। এতে দুজনের মধ্যে বিতর্ক হয়। খুকি তার বোনের দুই ছেলে রিফাত-রিশানের কাছে এ বিষয়ে নালিশ করলে তারাও রিফাত শরীফের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এ কারণেই হত্যার ঘটনায় তাদের অগ্রভাগে দেখা যায়। এ ঘটনার কথা তার জামাতা রিফাত শরীফ ও মেয়ে মিন্নি তাকে মোজাম্মেল হোসেন কিশোরকে জানিয়েছিল।

মোজাম্মেল হোসেন কিশোর আরো বলেন, পুলিশের তদন্তে আস্থা রাখতে পারছেন না তিনি। পুলিশ শুরু থেকে একটি প্রভাবশালী মহলকে বাঁচাতে তার মেয়েকে ফাঁসাচ্ছে। বরগুনা পুলিশের হাতে তদন্তের দায়িত্ব থাকলে তার মেয়ে মিন্নিকে ফাঁসিয়ে প্রকৃত খুনীদের আড়াল করা হবে। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ও আাাইজিপির প্রতি তিনি বিনীত অনুরোধ জানান, সুষ্ঠু বিচারের স্বার্থে যাতে রিফাত হত্যা মামলার তদন্ত পুলিশের কাছ থেকে পিবিআইতে হস্তান্তর করা হয়।

মিন্নির সাথে জেলগেটে আইনজীবীর সাক্ষাৎ
বরগুনার রিফাত হত্যাকাণ্ডের প্রধান সাক্ষী থেকে আসামি হওয়া নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সাথে জেল হাজতে দেখা করেছেন তার আইনজীবী। বুধবার বেলা ১টার দিকে মিন্নির আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. মাবুবুল বারী আসলাম মিন্নির সাথে দেখা করেন। এসময় তার সাথে ছিলেন এ মামলার অপর আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাইফুর রহমান সোহাগ। বরগুনা জেলা কারাগারে মিন্নির সাথে তারা ১০ মিনিটের মতো কথা বলেছেন বলে জানান অ্যাডভোকেট মাহবুবুল বারী আসলাম।

জেলা কারাগার থেকে বের হয়ে অ্যাডভোকেট মাহবুবুল বারী আসলাম বলেন, মিন্নির খোঁজ খবর নেয়ার পাশাপাশি তাকে কিছু আইনি পরামর্শ দেয়ার জন্য আমি মিন্নির সাথে দেখা করতে জেলা কারাগারে যাই।

মিন্নির উদ্ধৃতি দিয়ে অ্যাডভোকেট মাহবুবুল বারী আসলাম বলেন, মিন্নির সমস্ত শরীরে ব্যথা আছে। মিন্নি রাতে ঘুমাতে পারে না। মিন্নি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। মিন্নি রিফাত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, তা পুলিশ শিখিয়ে দিয়েছে। তাই সেই জবানবন্দি মিন্নি প্রত্যাহার করতে চাচ্ছে। তাই আমি মিন্নিকে এই স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের আবেদনের প্রক্রিয়া শিখিয়ে দিয়েছি বলে জানান জনাব আসলাম।

মিন্নি জেল হাজতে থাকা অবস্থায় পড়াশুনা করতে চায় জানিয়ে আইনজীবী আসলাম আরো বলেন, মিন্নির লেখাপড়ার বিষয়ে আবেদন করা হলে জেলার সেই আবেদন মঞ্জুর করবেন বলে জানিয়েছেন। মিন্নি একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন জানিয়ে এই আইনজীবী আরো বলেন, মিন্নির চিকিৎসার দরকার হলে কারা কর্তৃপক্ষ তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন বলে জেলার জানিয়েছেন।