বাংলাদেশকে বিদায় করে সেমিতে ভারত

SHARE
Bangladesh's Mustafizur Rahman (C) celebrates New Zealand's Martin Guptill being caught with teammates Mashrafe Mortaza (L) and Shakib Al Hasan during the one day international cricket match between New Zealand and Bangladesh at the Hagley Park in Christchurch on December 26, 2016. / AFP / Marty Melville (Photo credit should read MARTY MELVILLE/AFP/Getty Images)

লক্ষ্যটা বড় হলেও অসম্ভব ছিলো না। বিশেষ করে চলতি আসরেই আগের ৬ ম্যাচে যে দল ৩ বার পেরিয়েছে ৩০০ রানের কোটা, তাদের জন্য ৩১৫ রানের লক্ষ্যটা অন্তত ধরাছোয়ার মধ্যেই ছিলো। তার ওপর মাথায় যখন ঝুলছে হারলেই বিদায় হওয়ার শঙ্কা, তখন নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে হলেও এ লক্ষ্য ছুঁয়ে ফেলা উচিৎ ছিলো বাংলাদেশ দলের।

কিন্তু পারেননি টাইগার ব্যাটসম্যানরা। এক সাকিব আল হাসান ব্যতীত আর কোনো স্বীকৃত ব্যাটসম্যান উইকেটে বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি। শেষদিকে একাই লড়াই করেছেন পেস বোলিং অলরাউন্ডার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। দুজনই ফিফটি করেন, তবে তা যথেষ্ঠ প্রমাণিত হয়নি।

যে কারণে ভারতীয়দের করা ৩১৪ রানের জবাবে ২৮৬ রানের বেশি করতে পারেনি বাংলাদেশ। ২৮ রানের ব্যবধানে হেরে পঞ্চম দল হিসেবে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেল টাইগাররা। একইসঙ্গে এ জয়ের ফলে অস্ট্রেলিয়ার পর দ্বিতীয় দল হিসেবে সেমিফাইনালের টিকিট নিশ্চিত হয়েছে ভারতের।

৩১৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ওপেনিং জুটি মোটামুটি ভালোই শুরু করেছিল। কিন্তু সেট হয়ে আউট হয়ে যান তামিম। চলতি বিশ্বকাপে নিজেকে হারিয়ে ফেলা বাঁহাতি এই ওপেনার দেখেশুনে ২২ রানে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তারপর আর ইনিংস বড় করতে পারেননি।

ফিল্ডিংয়ের শুরুতে রোহিত শর্মার ক্যাচ ফেলে দিয়েছিলেন। তামিম নিশ্চিতভাবেই চাপে ছিলেন। ব্যাট করতে নেমেও দেখা গেল শুরু থেকেই ধুঁকছেন। ভুবনেশ্বর কুমার কিংবা জসপ্রিত বুমরাহদের বলে বার বার পরাস্ত হচ্ছিলেন এই ওপেনার। তবুও চেষ্টা করছিলেন সৌম্য সরকারকে নিয়ে একটি ভালো জুটি গড়ার।

কিন্তু পারলেন না শেষ পর্যন্ত। ৯.৩ ওভারে ৩৯ রানের জুটি গড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হলো তামিম ইকবালকে। ৩১ বলে ২২ রান করে মোহাম্মদ শামির বলে বোল্ড হন তিনি। এর মধ্যে বাউন্ডারি হাঁকান ৩টি।

তামিম ফেরার পর সৌম্যকে নিয়ে হাল ধরার চেষ্টা করেন সাকিব আল হাসান। দ্বিতীয় উইকেটে তাদের ৩৫ রানের জুটিটি ভাঙে হার্দিক পান্ডিয়ার করা ১৬তম ওভারের প্রথম বলে, সৌম্যর ভুল শটে।

হার্দিক পান্ডিয়াকে এক্সট্রা কভারে মারতে গিয়ে বিরাট কোহলির সহজ ক্যাচে পরিণত হন সৌম্য। তাতেই অপমৃত্যু ৩৮ বলে ৪ বাউন্ডারিতে গড়া তার ৩৩ রানের আশা জাগানিয়া ইনিংসের।

সৌম্য ফিরে গেলেও দলের ব্যাটিংয়ের স্তম্ভ, মুশফিকুর রহীম দারুণ স্বচ্ছন্দ্যেই শুরুটা করেছিলেন। ২৩ বলেই ৩ বাউন্ডারিতে ২৪ রান তুলে ফেলা এই ব্যাটসম্যান হঠাৎ সুইপ করতে গিয়ে ফাঁদে পড়েন। ইয়ুজবেন্দ্র চাহালের বলে মিডউইকেটে মোহাম্মদ শামির হাতে ক্যাচ হন তিনি।

মুশফিকের দেখানো পথ ধরে দারুণ খেলছিলেন লিটন কুমার দাসও। কিন্তু সুখ যেনো বেশিক্ষণ সয়নি তার। তাই তো হার্দিক পান্ডিয়ার করা ৩০তম ওভারের দ্বিতীয় বলে ছক্কা হাঁকানোর এক বল পরেই পুল করতে গিয়ে ধরা পড়েন শর্ট মিড উইকেটে দাঁড়ানো দিনেশ কার্তিকের হাতে।

আউট হওয়ার আগে ২৪ বল থেকে ২২ রান করেন লিটন। বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতও। ৩৩তম ওভারে দলীয় ১৭৩ রানের মাথায় জাসপ্রিত বুমরাহর স্লোয়ার ডেলিভারিকে থার্ডম্যানে গ্লাইড করতে গিয়ে সরাসরি বোল্ড হয়ে যান ৭ বলে ৩ রান করা মোসাদ্দেক।

একপ্রান্ত আগলে রেখে খেলছিলেন সাকিব আল হাসান। কিন্তু তাকে সঙ্গ দেয়ার মতো অন্য প্রান্তে থাকছিলেন না কেউই। অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহীমের পর সাজঘরে ফিরে যান দুই তরুণ লিটন কুমার দাস এবং মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতও।

নিঃসঙ্গ যোদ্ধা বনে যাওয়া সাকিবও এগুতে পারেননি বেশিদূর। ইনিংসের ৩৪তম ওভারের পঞ্চম বলে হার্দিক পান্ডিয়ার করা স্লোয়ার ডেলিভারিটি বুঝতে পারেননি চলতি বিশ্বকাপে সপ্তম ম্যাচে ৬ষ্ঠ ফিফটি করা সাকিব। ধরে পড়েছেন শর্ট কভারে দাঁড়ানো দিনেশ কার্তিকের হাতে। আউট হওয়ার আগে ৬ চারের মারে ৭৪ বলে ৬৬ রান করেছেন সাকিব।

দলের আশা-ভরসার সবচেয়ে বড় প্রতীক সাকিব সাকিব আল হাসানের বিদায়ের পর হারের শঙ্কা ঢুকে গিয়েছিল বাংলাদেশের ভক্ত-সমর্থকদের মনে। তবে শেষের আগে যেনো শেষ মানতে রাজি ছিলেন না দুই তরুণ সাব্বির রহমান ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন।

সপ্তম উইকেটে দুজন মিলে রান তুলেছেন বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই। ৪৪তম ওভারের প্রথম বলে সাব্বির আউট হওয়ার আগে দুজন মিলে গড়েন ৫৬ বলে ৬৬ রানের জুটি। জাসপ্রিত বুমরাহর ভেতরে ঢোকা বলে বোল্ড হওয়া সাব্বির ৩৬ বল খেলে করেন ৩৬ রান।

এরপরের গল্পটা স্রেফ সাইফউদ্দিনের একার লড়াইয়ের। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা দারুণ এক ছক্কা হাঁকিয়ে পরের বলেই আউট হয়ে যান ৫ বলে ৮ রান করে। রুবেল হোসেনকে নিয়ে নবম উইকেটে শেষ চেষ্টাটা করেন সাইফ।

দুজনের জুটিতে ২১ বলে ২৯ রান পায় বাংলাদেশ। ইনিংসের ৪৮তম ওভারের শেষ বলে নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হওয়ার আগে ৯ রান করেন রুবেল। তার এ ইনিংসে ছিলো দর্শনীয় এক স্ট্রেইট ড্রাইভে চারের মার।

সে ওভারের শেষ বলেই মোস্তাফিজুর রহমানকে বোল্ড করে দুই ওভার বাকি থাকতেই ২৮৬ রানে বাংলাদেশকে অলআউট করে দেন জাসপ্রিত বুমরাহ। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ফিফটি করে সাইফউদ্দিন অপরাজিত থাকেন ৩৮ বলে ৫১ রান করে।

ভারতের পক্ষে বল হাতে ৪ উইকেট শিকার করেছেন জাসপ্রিত বুমরাহ, হার্দিক পান্ডিয়া নিয়েছেন ৩টি উইকেট। এছাড়া ১টি করে উইকেট ঝুলিতে পুরেছেন বাকি তিন বোলার ভুবনেশ্বর কুমার, মোহাম্মদ শামি ও ইয়ুজভেন্দ্র চাহাল।

এজবাস্টনে টস জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন বিরাট কোহলি। ব্যাট করতে নেমে শুরু থেকেই বাংলাদেশ বোলারদের দারুণ ইকোনোমিক্যাল বোলিংয়ের মুখোমুখি হন ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। যার দরুণ, ৫ম ওভারেই আউট হতে পারতেন রোহিত শর্মা। ১০ রানের মাথায় ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তামিম ইকবাল দৌড়ে এসে ক্যাচটা হাতের তালুতে নিয়েও ছেড়ে দেন।

ইনিংসের পঞ্চম ওভারের ঘটনা। মোস্তাফিজুর রহমানের শর্ট ডেলিভারিটি স্কয়ার লেগের দিকে উড়িয়ে মেরেছিলেন রোহিত শর্মা। দৌড়ে গিয়ে সেটি একদম হাতে পেয়ে যান তামিম। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে ফেলে দেন।

যার ফলে ১০ রানে জীবন পেয়ে যান রোহিত। আর কে না জানে, রোহিত ক্যারিয়ারে ব্যাট করতে নেমে যতবারই জীবন পেয়েছিলেন, প্রায় ততবারেই সেটাকে সেঞ্চুরিতে রূপান্তরিত করেছেন। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। ১০ রানে তামিমের হাত ফসকে ক্যাচ পড়ে যাওয়ার পর সেঞ্চুরিই করলেন রোহিত শর্মা।

কিন্তু রোহিত শর্মাকে জীবন দেয়ার মাশুলই গুনতে হয়েছে বাংলাদেশকে। ভারতীয় ইনিংসের পঞ্চম ওভারেই আউট হতে বসেছিলেন রোহিত। তামিম ইকবাল সহজ ক্যাচ ফেলে দেন। এরপর থেকে দুই ওপেনার বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই ব্যাট চালিয়ে যান এবং ১৮০ রানের জুটি গড়ার পর বিচ্ছিন্ন হন।

৯০ বলে ৬ বাউন্ডারি আর ৫ ছক্কায় সেঞ্চুরি করার পর ৯২ বলে ১০৪ রান করে অকেশনাল বোলার সৌম্যকে উইকেট দিয়ে ফেরেন তিনি। ৩০তম ওভারের দ্বিতীয় বলে সৌম্যর অফ কাটারে এক্সট্রা কভারের ওপর দিয়ে লফটেড ড্রাইভ করতে চেয়েছিলেন রোহিত। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা লিটন দাস দাঁড়িয়ে থেকে অনায়াসেই ক্যাচটি ধরে ফেলেন।

সেঞ্চুরি করা রোহিত শর্মাকে তুলে নেয়ার পর বেশিক্ষণ আর অপেক্ষা করতে হয়নি। তার সঙ্গী লোকেশ রাহুলকেও অসাধারণ এক ডেলিভারিতে তুলে নিলেন বাংলাদেশ দলের পেসার রুবেল হোসেন। ৩৩তম ওভারে উইকেট দিলেন লোকেশ রাহুল। রুবেল হোসেনের করা ওভারের ৪র্থ বলটি ছিল হালকা আউট সুইঙ্গার। যেটাকে খেলতে গিয়ে ব্যাটের কানায় বল লাগিয়ে দেন। ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই ক্যাচ তালুবন্দী করে নেন মুশফিক। মুশফিকের নেয়া ক্যাচটাও ছিল দুর্দান্ত। ৯২ বলে ৭৭ রান করে ফেরেন লোকেশ।

এরপর এক ওভারেই বিরাট কোহলি এবং হার্দিক পান্ডিয়াকে ফিরিয়ে দিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। ইনিংসের ৩৯তম ওভারেই পরপর বিরাট কোহলি এবং হার্দিক পান্ডিয়াকে সাজঘরে ফিরিয়ে দিলেন বাংলাদেশ দলের এই কাটার মাস্টার।

৩৯তম ওভারের দ্বিতীয় বলে মোস্তাফিজকে মিডউইকেটের ওপর দিয়ে ছক্কা মারতে গিয়েছিলেন বিরাট কোহলি। কিন্তু তার কাটারের কাছেই পরাস্ত হন কোহলি। বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়ানো ছিলেন রুবেল হোসেন। তবে অসাধারণ এক ভঙিতে ক্যাচটি ধরলেন রুবেল। ২৭ বলে ২৬ রান করে ফিরলেন কোহলি।

এক বল বিরতি দিয়ে আবারও উইকেট। এবারের উইকেটটি ছিল সত্যিই অসাধারণ। হঠাৎই প্রথম স্লিপে সৌম্য সরকারকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন অধিনায়ক মাশরাফি। বলটাকে আউটসুইঙ্গার করিয়েছিলেন মোস্তাফিজ। তাতেই ব্যাটের কানায় লাগিয়ে প্রথম স্লিপে বল ফেলেন পান্ডিয়া। সেটাকেই ঝাঁপিয়ে পড়ে তালুবন্দী করে নেন সৌম্য। ২ বল কেলে কোনো রানই করতে পারেননি পান্ডিয়া।

চার নম্বরে নামা রিশাভ পান্ত কিছুটা ভোগান বাংলাদেশের বোলারদের। ধোনির সঙ্গে মিলে ৪০ রানের জুটি গড়ে তোলেন পান্ত। তবে ৪১ বলে তিনি আউট হয়ে যান সাকিব আল হাসানের বলে মোসাদ্দেকের হাতে ক্যাচ দিয়ে। যদিও তিনবারের চেষ্টায় এই ক্যাচটি ধরেন মোসাদ্দেক।

৩৩ বলে ৩৫ রান করেন ধোনি। মোস্তাফিজের একটি বাউন্স খেলতে গিয়ে আকাশে ক্যাচ তুলে দেন ধোনি। সেটি তালুবন্দী করেন সাকিব আল হাসান। তবে এরই মাঝে দিনেশ কার্তিকের উইকেট তুলে নেন মোস্তাফিজ। শেষ ওভারে ভুবনেশ্বর কুমারকে রানআউট করেন এবং ইনিংসের একেবারে শেষ বলে মোহাম্মদ শামিকে বোল্ড করেন মোস্তাফিজ।