প্রশ্ন উঠেছে, ওসি মোয়াজ্জেম কেন আসামি নন

SHARE

ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় অধ্যক্ষ (বরখাস্ত) সিরাজ উদ দৌলাসহ ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। অভিযোগপত্রে আসামিদের সবার মৃত্যুদণ্ডের সুপারিশ করা হয়েছে।

গতকাল বুধবার দুপুর আড়াইটার দিকে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচার বিভাগীয় হাকিম জাকির হোসাইনের আদালতে অভিযোগপত্রটি দাখিল করা হয়। পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. ইকবাল ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. শাহ আলম আদালতে উপস্থিত হয়ে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রটি দাখিল করেন। আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আজ বৃহস্পতিবার শুনানির দিন ধার্য করেন।

দেশব্যাপী আলোড়ন তৈরি করা এই ঘটনার ৫৪ দিনের মাথায় এবং তদন্তভার পাওয়ার ৫০ দিনের মধ্যে পিবিআই তদন্ত শেষ করেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বড় আকারের এই অভিযোগপত্রে কী পরিস্থিততে, কী পরিকল্পনায়, কিভাবে নুসরাতকে হত্যা করা হয়েছে এবং হত্যার পর কিভাবে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছে তার পুরো বিবরণ রয়েছে। ৬৯ জন সাক্ষী ও ১২ আসামির জবানবন্দি এবং বেশ কিছু আলামতের সাক্ষ্য-প্রমাণও আদালতে উপস্থাপন করেছেন পিবিআইয়ের তদন্তকারীরা। অভিযোগপত্রে প্রত্যেক আসামির হত্যাকাণ্ডে ভূমিকা, ঘটনা ও অপরাধের আলোকে সাক্ষী-প্রমাণসহ উপস্থাপন করা হয়েছে।

গতকাল পিবিআই প্রধান উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের কাজ অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে আমরা করেছি। এখন আমরা বিজ্ঞ আদালতের কাছে বিচারের সুপারিশ করে দিয়েছি। দেশবাসীর মতো তদন্ত সংস্থা হিসেবে আমরাও ন্যায়বিচারই চাইব।’

বিকেলে ফেনীতে ব্রিফ করেন পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. ইকবাল। এ সময় তিনি বলেন, ‘নুসরাত হত্যা মামলার তদন্ত শেষ করে আজ (বুধবার) আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছি। সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ ১৬ জনের নামে জমা দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে মামলার এজাহারনামীয় আটজন ও এজাহারবহির্ভূত আটজন। আমরা সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়ে সুপারিশ করেছি।’

পিবিআইয়ের এ কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘গত ১০ এপ্রিল থেকে মোট ৫০ দিনে ৩৩ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দাখিল করেছি। এ মামলায় সর্বমোট ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে ৬৯ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। অন্য সাক্ষীরা হলেন বিশেষজ্ঞ, মামলার বাদী, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সিজার লিস্টের সাক্ষী। এ মামলায় সাতজন সাক্ষী ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। ১২ আসামি নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে।’

অভিযোগপত্রে যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলো সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ দৌলা (৫৭), নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর (৫০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে চম্পা/শম্পা (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদরাসার সাবেক সহসভাপতি রুহুল আমিন (৫৫), মহিউদ্দিন শাকিল (২০) ও মোহাম্মদ শামীম (২০)।

নুসরাত হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারকৃত তার সহপাঠী আরিফুল ইসলাম, নুর হোসেন, কেফায়াত উল্লাহ জনি, মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, শাহিদুল ইসলামকে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

ওসি মোয়াজ্জেমকে এ মামলার অভিযোগপত্রে কেন আনা হয়নি সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে পিবিআই কর্মকর্তা ইকবাল বলেন, তাঁর (ওসি) বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এ ঘটনায় তাঁর সংশ্লিষ্টতা বা কাজে কী অবহেলা ছিল পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত কমিটি সে প্রতিবেদন দিয়েছে। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

নুসরাতের শ্লীলতাহানির অভিযোগে অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে তার মায়ের করা মামলাটিও পিবিআই তদন্ত করছে। তদন্ত শেষে ওই মামলার অভিযোগপত্র অল্প সময়ের মধ্যে আদালতে দাখিল করা হবে বলে জানান পিবিআই কর্মকর্তা ইকবাল।

এ সময় পিবিআইয়ের ফেনীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক মো. শাহ আলমসহ পিবিআইয়ের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করে অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে মামলা করায় সিরাজ ও তাঁর সহযোগী-অনুসারীরা ক্ষুব্ধ হয় নুসরাতের ওপর। সিরাজের অনুসারীদের মধ্যে শাহাদাত হোসেন শামীমের প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় সে আগে থেকেই নুসরাতের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। আর সিরাজের বিরুদ্ধে মামলা করায় মাদরাসায় তাঁর কাছ থেকে সুবিধা পাওয়া অনুসারী এবং কমিটিতে থাকা নেতারাও সমস্যায় পড়ে। সবার স্বার্থে আঘাত করায় প্রতিবাদী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। সিরাজের নির্দেশে একটি পক্ষ হত্যায় অংশ নেয়। সরাসরি ছিল তিন শিক্ষার্থীসহ পাঁচজন। বাকিরা ছিল সহযোগিতায়। মাদরাসার ব্যবস্থাপনা কমিটির সহসভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন ঘটনা জানলেও ধামাচাপা দিতে চান। তিনি সিরাজ ও আসামি শামীমের পক্ষে কাজ করেন। পৌর আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ আলম সিরাজকে রক্ষায় সরাসরি ভূমিকা রাখেন। হত্যার উপকরণ কিনতে তিনি ১০ হাজার টাকাও দেন।

এ মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজ, নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন নাহার মনি, জাবেদ হোসেন, আবদুর রহিম ওরফে শরীফ, হাফেজ আবদুল কাদের, জোবায়ের আহমেদ, এমরান হোসেন মামুন, ইফতেখার হোসেন রানা ও মহিউদ্দিন শাকিল আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে করা মামলায় মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে ৬ এপ্রিল পরীক্ষা দিতে গেলে নুসরাতকে ডেকে নিয়ে মাদরাসা ভবন কাম সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় অধ্যক্ষের সহযোগীরা।