দেশ যদি না বাঁচে কাপ দিয়ে কী হবে, খেলায়-পলিটিক্সে ভুল থাকবেই: মাশরাফি

SHARE

হোটেলে ফিরে রাতে খেতে যাওয়ার সময়ও খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। কারণ ভারতের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে ষষ্ঠ ওভারে বোলিংয়ের সময় হ্যামস্ট্রিংয়ের পুরনো চোটটা আরো বেড়েছে। এর পরও বিশ্রাম নেই। সকালেই আইসিসি বিশেষ গাড়ি পাঠাচ্ছে লন্ডনে যাওয়ার জন্য। রাতেই ২০১৯ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান রয়েছে বটে। তবে বাংলাদেশ অধিনায়কের জন্য বিশেষ গাড়ির ব্যবস্থার কারণ ব্রিটেনের রানির সঙ্গে সাক্ষাৎপর্ব রয়েছে বিশ্বকাপের ১০ অধিনায়কের। পরশু রাতে এরই মাঝে কালের কণ্ঠ’র সাইদুজ্জামানকে সময় দিয়েছেন মাশরাফি। কথা বলেছেন ক্রিকেট আর রাজনীতির মাঠে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে

প্রশ্ন : চার নম্বর বিশ্বকাপ খেলতে নামবেন ২ জুন। প্রথমটার কথা মনে আছে? এবারও কি একই রোমাঞ্চ অনুভব করছেন?

মাশরাফি বিন মর্তুজা : বিশ্বকাপ দুই রকমের। একটি শুধুই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। অন্যটি হলো, হাইপ যদি বেশি থাকে তাহলে খেলার দিকেই মনোযোগ বেশি থাকে। আমার কাছে ২০০৩ বিশ্বকাপ ছিল শুধুই রোমাঞ্চের। প্রথম বল হাতে নেওয়ার স্মৃতিটা এখনো মনে আছে। ডারবানে কানাডার সঙ্গে ম্যাচে কোন এন্ড থেকে প্রথম দৌড় শুরু করেছিলাম, সেটাও স্পষ্ট মনে আছে। ওদের মূল ব্যাটসম্যান (জন ডেভিসন), নামটা মনে নেই…চিনতাম না। কয়েক ম্যাচে পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরিও করেছিল। আমার বাউন্সার পুল করে দিয়ে আউট হয়েছিল। থ্রিলই অন্য রকম ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই রোমাঞ্চ আর থাকে না। এখন এক্সসাইটমেন্টের চেয়ে কনসার্নই বেশি। এখন দলকে ঘিরে অনেক প্রত্যাশা। আমার নিজেরও শেষ বিশ্বকাপ। এটা নিয়েও বেশি আবেগ নাই। আমার ক্যারিয়ার তো কবেই শেষ হয়ে যেতে পারত। এখনো যে খেলছি, সেটা তো বোনাস। বলতে পারেন ‘লাইফ’ পাওয়া ক্যারিয়ার।

প্রশ্ন : এসব কারণেই কি আজকাল উইকেট পেলে এমনকি দল জিতলেও ‘পাগলা’কে খুব বেশি উচ্ছ্বসিত দেখা যায় না?

মাশরাফি : সবারই ইমোশন আছে। কেউ পারে, কেউ পারে না। আমি যে একেবারেই আবেগ দেখাই না, তা-ও না। তবে এখন আর আগের মতো লাফালাফি করতে ভালো লাগে না। উইকেট পেলে মনে হয় এটাই তো আমার কাজ।

প্রশ্ন : আপনার এবারের বিশ্বকাপে কিন্তু বাড়তি অনুষঙ্গও আছে। আপনি সংসদ সদস্যও। বিশ্বকাপে আপনিই প্রথম।

মাশরাফি : দুটি ভিন্ন ভিন্ন কাজ। দুটি কাজ করতে গেলে আপনাকে সুইচ অন-অফ করাটা শিখতে হবে। এটা আমি খুব ভালো পারি। যখন যেটার মধ্যে থাকি, সেটা নিয়েই ভাবি। এলাকায় থাকলে ওটা নিয়ে ভাবি, এখানে যেমন ক্রিকেট নিয়েই আছি। এটা পুরোপুরিই সুইচ অন-অফের ব্যাপার। ক্রিকেট খেলছি প্রায় ২০ বছর হতে চলল। রাজনীতিতে নতুন হলেও আমার একটা সুবিধা আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে এলাকার উন্নয়নের দায়িত্ব দিয়েছেন, রাজনীতি করছেন পুরনোরাই। রাজনীতি আমি এখনো শিখিনি। তবে মানুষের জন্য ভালো কাজ কোনগুলো, সেগুলো আমরা সবাই-ই কিন্তু জানি। আমি সে কাজগুলোই করার চেষ্টা করছি। দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি, যখন যেটা সামনে আসছে। কাজ করতে গিয়ে ভুলত্রুটিও হয়তো হচ্ছে। তবে কাজ করতে গেলে এমন হতেই পারে। আপনার সব সিদ্ধান্তই সঠিক হবে না, সেটা ক্রিকেট কিংবা রাজনীতির মাঠে একই। কেউ ধরিয়ে দিলে শুধরে নিই, নেবও।

প্রশ্ন : জাতীয় দলের অধিনায়ক আর নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য—দুটোর জন্যই তো নেতৃত্বগুণ জরুরি। দুই ধরনের নেতৃত্বে কোনো মিল কিংবা অমিল কি খুঁজে পেয়েছেন?

মাশরাফি : দুটি ভিন্ন ক্ষেত্র। যেমন ধরুন নড়াইলের জন্য কাজ করতে গেলে নির্দিষ্ট একটা পদ্ধতি আছে। সরকারি নিয়ম-নীতি আছে। আপনি একটা উন্নয়নমূলক কাজ করতে গেলে ধাপে ধাপে অনুমোদনের বিষয় আছে। একটু সময় নিলেও আপনি জানেন যে ওটা একসময় পাওয়াও যাবে। প্রথাগত নিয়মের বাইরে কাজ করার সুযোগ নেই। সংসদ সদস্য হিসেবে আমাকে শুধু একটা ব্যাপারই নিশ্চিত করতে হচ্ছে যে জনগণের প্রাপ্যটা তারা বুঝে পাচ্ছেন কি না। আমার কাছে মনে হয় সংসদ সদস্যের কাজটা একরকম নির্ধারিতই আছে। যেমন ধরেন, সাধারণ মানুষের জন্য নানা ধরনের সরকারি ভাতা আছে। আমি চেষ্টা করি সেসব যেন তাদের হাতে পৌঁছায়। আর ক্রিকেটের ব্যাপারটা অন্য রকম। এই যে এত দিন খেলছি তবু নিশ্চিত নই পরের ওভারে কী হবে। মাঠে প্রায় আপনি ‘আনকমন’ প্রশ্নের সামনে পড়বেন। খুব ভালো বোলিং করেও মার খেতে পারেন। আবার বাজে বোলিংয়েও উইকেট পেতে পারেন। এখানে ভাগ্যটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি। প্রথাগত নিয়মের বাইরে যাওয়ার ঝুঁকিও আপনাকে নিতে হবে।

প্রশ্ন : ক্রিকেটে নেতৃত্বের মূল রসায়ন তো ম্যান ম্যানেজমেন্ট। মানুষকে বোঝার ক্ষমতা রাজনীতির মাঠে কতটা কাজে দিচ্ছে?

মাশরাফি : হান্ড্রেড পারসেন্ট! এটা খুব জরুরি। নেতার মাঝে এ গুণটা থাকতেই হবে। ক্রিকেটে প্রচারের জন্য ছুটতে হয় না। ভালো করি কিংবা মন্দ, আপনারা প্রচার করবেন। আজকে আপনি আমার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, আমার প্রচারও হবে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রচারেই প্রসার স্লোগানের বিরোধী। যদিও এখন চিত্রই এমন যে একজন একটা কিছু করেই প্রচারের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আবার অন্য সংকটও আছে। ক্রিকেটে তো আর গোপন কিছু থাকে না, আপনারা সেসব খবর মানুষকে জানিয়ে দেন। কিন্তু রাজনীতির মাঠে মানুষও জানতে চায় নেতা কী করেছে তাদের জন্য। এ জন্যই হয়তো প্রচারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমি মানুষের এই ঘটা করে জানানো কিংবা জানার আগ্রহ—দুটিরই বিরোধী। আপনি যদি কারো জন্য কাজ করেন, সেটাতে তার উপকার হলেই তো যথেষ্ট।

প্রশ্ন : ক্রিকেট মাঠে আপনার অনেক সাফল্য আছে। সংসদ সদস্য হয়েছেন খুব বেশি দিন হয়নি। তবু জানতে চাচ্ছি, জাতীয় দল নাকি নিজের এলাকার মানুষকে নেতৃত্ব দেওয়া বেশি কঠিন?

মাশরাফি : পৃথিবীতে কোনো কাজই সহজ না, দুটিই কঠিন। পুরোটাই নির্ভর করবে আপনি কতটা দায়িত্বশীল, তার ওপর। মানুষ কথা বলবে, সমালোচনা করবে। এখন চয়েসটা আপনার, আপনি কাজ করবেন নাকি মানুষের কথাই শুনবেন। এত দিন ক্রিকেট খেলেও মাঠের কোনো কিছুই নিজের আয়ত্তের মধ্যে মনে হয় না। অঙ্ক না মিললে উল্টোপাল্টা মনে হয়। আমার কাছে ক্রিকেট খেলাটা অনেক কঠিন। রাজনীতিও কঠিন। তবে আগেই বলেছি আমি রাজনীতি করি না। শুধু মানুষের উপকারের জায়গাটা দেখি। সেটার জন্য আপনি নিজে ঠিক থাকলেই হয়। অবশ্যই ক্রিকেটের চেয়ে সংসদ সদস্যের কাজটা অপেক্ষাকৃত সহজ।

প্রশ্ন : সেই আপাত সহজ কাজে সাফল্যের ব্যাপারে আপনি কতটা আশাবাদী?

মাশরাফি : একজন মানুষের পক্ষে তো আর সব কিছু করা সম্ভব না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে একটা দায়িত্ব দিয়েছেন যেন নড়াইল-২ এর উন্নতি করা। সেখানে সবার পূর্ণ সহযোগিতা দরকার। আমি ভাগ্যবান যে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা আমি প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সব মন্ত্রণালয় থেকে পাই। তবে ওই যে বললাম একটা প্রক্রিয়ার ব্যাপার আছে। তাই আমার চাওয়াগুলো দৃশ্যমান হতে কিছু সময় লাগবে। অনুমতি মিললেও একটা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হতেও বছর দুয়েক লেগে যেতে পারে। আর আমাদের নড়াইলের তো সমস্যার শেষ নেই। আমার কাজ লেগে থেকে প্রয়োজনী কাজগুলো শেষ করা।

প্রশ্ন : সম্প্রতি আপনার এলাকার এক কৃষকের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যিনি সরকারিভাবে ধান বিক্রি করতে পেরে আপ্লুত। একজন সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারা কতটা আনন্দের?

মাশরাফি : এই গল্পের অন্য পিঠও আছে। অনেক কৃষক হয়তো এখনো ধান যে বিক্রি করা যাবে এবার, সে খবরটাই জানে না। অনেকের বাড়ি হয়তো দূরে। তবে আমার চেষ্টা ছিল যে ধারায় এটা চলছিল সেটা ভাঙতে পেরেছি কি না। দশজন কৃষক হলেও এ সুবিধাটা পেয়েছে কি না। আমি নিশ্চিত আগামীবার আরো অনেক বেশি কৃষক ধান বিক্রির সুযোগটা নেবে। তবে এটা আমার একার কৃতিত্ব না। সরকারি নীতিমালাতেই এটা আছে। আমি শুধু সেটা অনুসরণ করেছি।

প্রশ্ন : ধান বিক্রি করতে পারা কৃষকের মুখের হাসি নাকি দলের জয়ের পর গ্যালারির দর্শকের হাসি আপনাকে বেশি আপ্লুত করে?

মাশরাফি : অবশ্যই কৃষকের মুখের হাসি। কৃষকের মুখের হাসির সঙ্গে সবার হাসি জড়িত। মাঠের হাসি স্রেফ বিনোদন। ক্রিকেটের প্রতি আমার টান অন্তত একজন সাধারণ ক্রিকেট অনুসারীর চেয়ে বেশি। এত দিন ধরে এতগুলো অপারেশনের পরও এমনি এমনি তো আর খেলাটা খেলি না। এর পরও বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক হয়েও বলছি, ক্রিকেট আমাদের দেশের জীবন-মরণ সমস্যা না। ক্রিকেট যদি কাল থেকে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে কিছু মানুষ নিশ্চয় কষ্ট পাবেন, কেউ মারা যাবেন না। কিন্তু কৃষক যদি মাঠে না যায় আমি-আপনি মরে যাব। এটাই বাস্তবতা।

প্রশ্ন : আপনার সামনে দুটি কল্পিত ছবি যদি রাখি; একটি ১৪ জুলাই আপনার হাতে বিশ্বকাপ। আরেকটি আপনার স্বপ্নের ‘ক্লিন নড়াইল গ্রিন নড়াইল’। কোনটা বেশি টানবে আপনাকে?

মাশরাফি : দুটির সঙ্গে তুলনা করতেই চাই না। প্রথম কথা হলো, বিশ্বচ্যাম্পিয়নের প্রত্যাশাটাই বাড়াবাড়ি। ভক্তরা ভাবতে পারেন, তবে বাড়াবাড়ি হবে। আমরা এখনো ওই পর্যায়ে যাইনি। তার পরও কল্পনার সূত্র ধরেই যদি বলি, তাহলে অবশ্যই বিশ্বকাপ জিতলে দারুণ কিছুই হবে। ক্লিন নড়াইল গ্রিন নড়াইল আরো বড়। কাপের চেয়ে বড় এ কারণেই বলব, একটা জায়গাও যদি পরিবর্তন হয়, সেটা একটা মাইলস্টোন হবে। দেশ যদি না বাঁচে তাহলে কাপ দিয়ে কী হবে? দেশ বাঁচলে পরে না কাপ! তবে সঙ্গে এটাও বলব, বিশ্বকাপ জেতাটাও গর্বের ব্যাপার হবে।