কফি হাউজের সেই আড্ডাটা…: ‘মান্না কাকা বলেছিলেন, এ কিরকম গান?

SHARE

নিখিলেশ, মইদুল, ডিসুজা, রমা রায়, অমল, সুজাতা। বাঙালির জীবনযাপনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে রয়েছে এই কটা নাম, আজ ছত্রিশ বছর ধরে। স্বপ্নের কফি হাউসের আড্ডায় বসত এরা নিয়ম করে, তারপর ফুরিয়ে গেল আড্ডা, ফুরিয়ে গেল সময়। কিন্তু তাদের নিয়ে ১৯৮৩ সালে যে গান লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, গেয়েছিলেন মান্না দে, সে গান যে ফুরোয়নি, ফুরোবে না, তা ছোট্ট একটা ইউটিউব সার্চ করলেই বোঝা যায়। মান্না দের সেরা দশটি বাংলা গানের তালিকায় যে এটি আজও প্রথম তিনের মধ্যে রয়েছে, তাও দিব্যি বোঝা যায়।

বেঁচে থাকলে এ বছর শতবর্ষে পদার্পণ করতেন মান্না দে, ৯৫-এ পা রাখতেন গৌরীপ্রসন্ন। তাঁদের নামের সঙ্গে চিরকাল জড়িয়ে থাকবে ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’। কিন্তু গানটির নেপথ্যে ছিল আরো একজনের হাত– সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষ। ১৯৮৩ সালে যিনি ছিলেন এমকম পরীক্ষার্থী, আক্ষরিক অর্থেই তরুণ প্রতিভা। প্রবাদপ্রতিম সুরকার নচিকেতা ঘোষের পুত্র তিনি, মান্নাকাকা এবং গৌরীকাকার স্নেহের ‘খোকা’। কিন্তু ওই বয়সেই নিজের আলাদা পরিচিতি তৈরি করে ফেলেছিলেন। ১৯৭৮ সালে মান্না দের কণ্ঠেই ‘সে আমার ছোট বোন’ তাঁর সুর দেওয়া প্রথম গান, যা মুক্তি পাওয়া মাত্রই আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপর একে একে আসে ‘সারা জীবনের গান’, ‘খেলা ফুটবল খেলা’-র মতো আরো হিট গান।

টালিগঞ্জে নিজের ফ্ল্যাটে ছাত্রছাত্রী পরিবেষ্টিত হয়ে বসে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সুপর্ণকান্তি নিজের কৃতিত্ব সম্পর্কে অবশ্য একেবারেই নির্মোহ। বরং তাঁর বক্তব্য, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’র আগে পর্যন্ত তাঁর প্রতিটি হিট গানই ছিল মান্না দের দেওয়া। “উনি ডেকে আমায় কাজ দিয়েছিলেন। এটা আমার মাথায় ঘুরত খুব, যে আমি ওঁকে কোনো কাজ তখনো দিইনি। ততদিনে ছবির গানেও সুর করেছি, কিন্তু কোনো উপহার, বা দেওয়ার মতো গান, ওঁকে দিইনি।”

সুযোগ ঘটে গিয়েছিল অপ্রত্যাশিতভাবে। ১৯৮৩ সাল, সে সময় নিউ আলিপুরে বাস ঘোষ পরিবারের। সুপর্ণকান্তির সুরে গাইবেন শক্তি ঠাকুর, তার মহড়া চলছে। পাশাপাশি চলছে তরুণ সুরকারের এম কম পরীক্ষার প্রস্তুতি এবং তাঁর বোনেদের অঙ্ক কষা শক্তি ঠাকুরের কাছে। বাড়িতে এসেছেন গৌরীপ্রসন্ন, হঠাৎ ‘খোকা’কে দেখতে না পেয়ে প্রশ্ন, “খোকা কই রে? কী করছে ভেতরে? আড্ডা মারছে আর বিড়ি সিগারেট খাচ্ছে?” কথাটা কানে যেতে বেরিয়ে আসেন ‘খোকা’।

এর পরের ইতিহাস অনেকেরই জানা, তবু সংক্ষেপে বলতে গেলে, ‘আড্ডা’ এবং ‘বিড়ি সিগারেট’ নিয়ে উক্তির জেরে তাঁর গৌরীকাকাকে বাংলার আড্ডা, বিশেষ করে কলকাতার বিশ্বখ্যাত কফি হাউসের আড্ডা নিয়ে গান লেখার চ্যালেঞ্জ জানান সুপর্ণকান্তি। প্রথম দুই লাইন সেখানে বসেই মুখে মুখে বলেও দেন কিংবদন্তি গীতিকার। সুরও বসে যায় তখনই। পরদিন সকালে সুপর্ণকান্তিকে ফোন করেন গৌরীবাবুর স্ত্রী। ‘কাকিমা আমাকে বলেন, তোর কাকাকে কী গান লিখতে দিয়েছিস রে? সারারাত ধরে লিখেছেন। উনি অসুস্থ, আর দিবি না এরকম’। উল্লেখ্য, ততদিনে গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত গৌরীপ্রসন্ন।

কিন্তু এতেই শেষ নয়। গানের শেষ স্তবক কোথায়? প্রশ্ন করেছিলেন সুপর্ণকান্তি। ‘আমার মনে হচ্ছিল, গানটার একটা ক্লাইম্যাক্স দরকার। গৌরীকাকার সঙ্গে ফাটাফাটি হয়েছিল। উনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমার কাছে গান লেখা শিখতে হবে?’ হাসেন সুপর্ণকান্তি। দিন দশেক পর এক ব্যক্তি বাড়িতে এসে হাজির, হাতে একটি সিগারেটের খালি প্যাকেট। তাতে লেখা অমর কিছু লাইন। শুরু এই দিয়ে, ‘সেই সাতজন নেই আজ, টেবিলটা তবু আছে…’। সুপর্ণকান্তির শেষ স্তবক। কী ব্যাপার? হাওড়া স্টেশনে বম্বের ট্রেনে বসে লাইন কটি মাথায় আসে গৌরীপ্রসন্নের এবং হাতের কাছে কিছু না পেয়ে সিগারেটের প্যাকেটে সেগুলি লিখে লোক মারফত পাঠিয়ে দেন খোকার কাছে।

এর পরের ঘটনা বহুল প্রচারিত। গানটি নিয়ে মান্না দের কাছে গেলে তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘এ কিরকম গান? এতে কি গান হবে? এই কথায় সুর বসবে কী করে?’ সুপর্ণকান্তি বলেন, ‘আমি বললাম সুর তো বসেছে, দেখুন পছন্দ হয় কী না।’ শেষ পর্যন্ত বম্বেতে গানের রেকর্ডিং হয়। তখন কি মনে হয়েছিল ইতিহাস সৃষ্টি করতে চলেছেন? সুপর্ণকান্তির ততক্ষণাৎ জবাব, ‘একদম না। আর পাঁচটা গান যে যত্ন নিয়ে করতাম, এটাও তাই করেছিলাম।’

কিন্তু সময় প্রমাণ করে দিয়েছে যে এই গান আর পাঁচটা গান হবে না। তার গায়ক, গীতিকার এবং সুরকারের মতোই কালজয়ী হবে সে।
সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস