এক অঙ্কে কোটি টাকা!

SHARE

এক অঙ্কের সমাধান করে পাঁচ কোটি টাকার পুরস্কার জিতেছেন ব্রিটিশ গণিতবিদ ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক এন্ড্রু ওয়াইলস। সে অঙ্কটি আবার ৩৬১ বছরের পুরোনো। সমাধান করার ২০ বছর পর এই পুরস্কার পেয়েছেন এন্ড্রু।

১৬৩৫ সালে ইতালীয় গণিতবিদ পিয়েরে দ্যা ফের্মার শেষ উপপাদ্যটি ১৯৯৬ সালে সমাধান করেন এন্ড্রু। তাঁর এই সমাধানের জন্য ২০১৬ সালে গণিতের নোবেল পুরস্কার হিসেবে খ্যাত আবেল পুরস্কার পেয়েছেন এই গণিতবিদ। পুরস্কারের আর্থিক মূল্য সাত লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় পাঁচ কোটি।

মার্জিনে মন্তব্য
an + bn = cn

এই গাণিতিক সমীকরণটি ইতালির গণিতবিদ পিয়েরে দ্যা দ্য এরেথমেটিকা নামের একটি বইয়ের মার্জিনে ১৬৩৫ সালে লেখেন। সেই সঙ্গে তিনি লেখেন, এই সমীকরণে n এর মান যদি ২-এর চেয়ে বেশি হয়, তাহলে এর কোনো পূর্ণ সাংখ্যিক মান পাওয়া যাবে না। তারপরই তিনি যোগ করেন, ‘আমি এই উপপাদ্যের একটি চমৎকার প্রমাণ খুঁজে পেয়েছি, কিন্তু মার্জিনে যথেষ্ট জায়গা না থাকায় লিখতে পারলাম না!’ সেই থেকে গণিতবিদেরা প্রায় সাড়ে তিন শ বছর ধরে ফের্মার ‘চমৎকার প্রমাণটি’ খুঁজে বেড়িয়েছেন।

এই সমীকরণে n=২ হলে এর অসংখ্য সমাধান পাওয়া যায় এবং এই সমাধানগুলো পিথাগোরাসের সংখ্যা নামে পরিচিত। যেমন সবচেয়ে ছোট সমাধান হলো ৩ (৩২=৯), ৪(৪২=১৬), ৫(৫২=১৫)। এ রকম অসংখ্য সমাধান রয়েছে। কিন্তু সেই ১৬৩৫ সাল থেকে পরবর্তী ৩৬১ বছর ধরে এর কোনো সাধারণ সমাধান কেউ বের করতে পারেনি। এমনকি ফের্মার আর কোনো কাজকর্মেও এই গাণিতিক উপপাদ্যের ‘চমৎকার প্রমাণটি’ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এন্ড্রুর আগের কাজ
ফের্মার মার্জিনের মন্তব্যটি খুঁজে পাওয়ার পর থেকে অনেকেই এই সমাধানের জন্য চেষ্টা করতে শুরু করেন। শুরুতে n=৪ এর একটি সমাধান পাওয়ার পর একটি ধারণা হয় যে, n এর মান মৌলিক সংখ্যা হলে উপপাদ্যটি সত্য হবে। কিন্তু পরবর্তী দুই বছরে কেবল ৩, ৫ ও ৭ মৌলিক সংখ্যার জন্য উপপাদ্যটি প্রমাণিত হয়। কিন্তু কোনো সাধারণ সমাধান পাওয়া যায়নি। সে সময় ফরাসি গণিতবিদ সোফি জারম্যান উপপাদ্যটি প্রমাণ করতে গিয়ে মৌলিক সংখ্যার নতুন একটি শ্রেণির খোঁজ পেয়ে যান। কিন্তু উপপাদ্যটি অধরাই থেকে যায়। উনিশ শতকে জার্মান গণিতবিদ আর্নস্ট কামার ‘নিয়মিত মৌলিক (Regular Prime)’ সংখ্যার জন্য উপপাদ্যটি প্রমাণ করেন। তাতে করে কেবল অনিয়মিত মৌলিক সংখ্যাগুলোকে নিয়ে কাজটা বাকি থাকে। আর্নস্ট কামারের কাজের ওপর ভিত্তি করে এবং কম্পিউটার ব্যবহার করে এর পর গণিতবিদেরা প্রথম ৪০ লাখ মৌলিক সংখ্যার জন্য উপপাদ্যটি প্রমাণ করেন কিন্তু সাধারণ সমাধানটি আর পাওয়া যায়নি।

১৯৫৫ সালে জাপানি গণিতবিদ গোরো সিমুরা ও ইয়ুতাকা তানিয়ামা গণিতের সম্পূর্ণ দুইটি ভিন্ন শাখার মধ্যে যোগসূত্র আঁচ করেন। উপবৃত্তকার বক্ররেখা ও মড্যুলার ফরম নিয়ে তাঁদের কাজ নতুন আশা জাগায়।

এবং এন্ড্রু ওয়াইলস

এর আট বছর পর, ১০ বছর বয়সী এন্ড্রু প্রথম ফের্মার শেষ উপপাদ্য সম্পর্কে জানতে পারেন। সে সময় ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে বেড়ে উঠছিলেন তিনি। স্থানীয় গ্রন্থাগারে একটি বইতে প্রথম ফের্মার উপপাদ্যটি দেখে তিনি অবাক হন এই ভেবে যে, কেন তিন শতাব্দী ধরে এর সমাধান হচ্ছে না? সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘সেই মুহূর্ত থেকে আমি জানি, আমাকে এর সমাধান করতেই হবে।’

১৯৮৪ সালে গর্হার্ড ফ্রে এবং ১৯৮৬ সালে কেন রিবেট মড্যুলার তত্ত্বের সঙ্গে ফের্মার উপপাদ্যের সম্পর্ক খুঁজে পান। এমনকি কেন এটিও প্রমাণ করেন যে, মড্যুলার উপপাদ্য যদি প্রমাণ করা যায় তাহলে ফের্মারকে প্রমাণ করা যাবে। সে সময় এন্ড্রু প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক। কেন্টের কথা জানার পর তিনি মড্যুলার উপপাদ্য প্রমাণের চেষ্টা শুরু করেন এবং দীর্ঘ ছয় বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ১৯৯৩ সালে ফের্মার শেষ উপপাদ্যের একটি প্রমাণ হাজির করেন। ফের্মার মার্জিনের মন্তব্যের চেয়ে প্রমাণটি কয়েক শগুণ আকারে বড়। কিন্তু প্রকাশের আগেই প্রমাণের এক জায়গাতে ছোট্ট একটি ভুল পাওয়া যায়। এরপর নিজের ছাত্র রিচার্ড টেইলরকে নিয়ে এন্ড্রু সেটি সমাধান করেন এবং ১৯৯৫ সালে তাঁর প্রমাণটি প্রকাশিত ও গৃহীত হয়।

আর তার ২১ বছর পর ওই ছোট্ট অঙ্কের সমাধানের জন্য পাঁচ কোটি টাকার পুরস্কার পান এন্ড্রু ওয়াইলস। আগামী ২৪ মে নরওয়ের যুবরাজের হাত থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৬ সালের আবেল পুরস্কার গ্রহণ করবেন একুশ শতকের অন্যতম মেধাবী এই গণিতবিদ।