একইসঙ্গে একটা দেশের ভালোবাসা আর ঘৃণা এত প্রবল ভাবে আর কোনো তারকা কখনো পেয়েছেন? ব্রাজিলে যেমন পান নেইমার দ্য সিলভা স্যান্টোস জুনিয়র?তিনি নতুন যে হেয়ারস্টাইলই নিন, সেটা নকল করতে বাচ্চাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। গোল করার পর স্লো-মোশনে তার সেলিব্রেশন ভঙ্গি ইউটিউবে দেখে কোটি কোটি ভক্ত। অটোগ্রাফ দিতে দিতে তিনি একটু বেলি-ডান্স দেখিয়ে দিলেই ফ্যানেরা খুশি।
কিন্তু শুধুই কি আনন্দ দেয়ার জন্য এ সব করেন নেইমার? নাকি অন্য কোনো অভিসন্ধিও থাকে? বিস্ময় বালক হিসাবে যিনি বন্দিত, তিনিই যে আবার নিন্দিতও। তাকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠা তাই বন্ধ হয় না।
ফিফা নতুন নিয়মই এনে ফেলল, ফুটবলাররা যখন-তখন মাঠের মধ্যে জামাকাপড় খুলে পণ্যের বিজ্ঞাপন করতে পারবেন না। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অন্তত পাঁচ বার টিভি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে নেইমার তার ‘লুপো’ সংস্থার অন্তর্বাস দেখাচ্ছেন। ফিফার এই নতুন নিয়মের তাই নামকরণই হয়ে গিয়েছে ‘নেইমার ল’। যেন এই আইন করাই হয়েছে তার জন্যই। যারা এমন নামকরণ করেছেন, তাদের মধ্যে ব্রাজিলের ফুটবল অনুরাগীরাও আছেন।
বন্দনা এবং নিন্দা বরাবর নেইমারের কেরিয়ারে পাশাপাশি থেকেছে। ব্রাজিলের স্পোর্টস ম্যাগাজিন ‘প্লাকার’ যেমন একবার ক্রুশবিদ্ধ নেইমারের ছবি ছেপেছিল। ব্রাজিলে ৮০ শতাংশ মানুষ যিশু খ্রিস্টে বিশ্বাসী। তাদের চোখ এড়ায়নি সেই ছবি। বছর চারেক আগে নেইমার একবার হঠাৎ বলে দিলেন, তিনি কৃষ্ণাঙ্গ নন এবং সেই কারণে কখনও বর্ণ বৈষম্যের কোপে পড়তে হয়নি। অথচ, ব্রাজিলে অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ নিজেদের কৃষ্ণাঙ্গ বলে ঘোষণা করেছে।
বিশ্বকাপের ক্যাম্প করার জন্য রিও ডি জেনেরো’র পাহাড়ি অঞ্চল তেরেজোপোলিসে ব্রাজিল দল পৌঁছে গিয়েছে গত সপ্তাহেই। ফুটবল-ভক্তদের মধ্যে তাতে বেশ ভালো মতোই সাড়া পড়েছে। প্রিয় তারকাদের কাছাকাছি আসার সুযোগ করে দিয়েছে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি শিবির। ব্রাজিলে ফুটবল নিয়ে সমর্থনের ইতিহাসটা বেশ কট্টর। প্রত্যেকটা শহরেরই আলাদা আলাদা ফুটবল টিম আছে। আর প্রত্যেকটা ক্লাবেরই সমর্থক সংখ্যা প্রচুর। রিও ডি জেনেরো’তেই যেমন ফ্ল্যামেঙ্গো, বোতাফোগো, ফ্লুমিনিজ এবং ভাস্কো- এই চারটি দলের মধ্যে দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা। বিশ্বকাপে অবশ্য নিজেদের ক্লাবের জার্সি তুলে রেখে এরা জাতীয় দলের হলুদ-সবুজ রং গায়ে চাপিয়ে নেবেন।
এই সমর্থন যে ব্রাজিল কতটা মরিয়া ভাবে চাইছে, লুইজ ফিলিপ স্কোলারির কথাতেই তা ধরা পড়েছে। স্কোলারি বলেছেন, ‘‘আমরা চাই পুরো দেশ আমাদের সঙ্গে থাকুক। যদি দেশবাসী আমাদের সঙ্গে না থাকেন, তাহলে আমাদের পক্ষে ভালোপ কিছু করে দেখানো সম্ভব নয়।” একইসঙ্গে তিনি এটাও বলেছেন যে, ‘‘আমি দেশবাসীর সমর্থনের জোর ইতিমধ্যেই টের পেতে শুরু করেছি।” নেইমারকে তেমনই ভীষণ ভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল একটি বিশেষ শিশুর সঙ্গে সাক্ষাৎ।
বিক্ষোভ নিয়ে ব্রাজিলের ফুটবলমহলও দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে। পেলে বা রোনাল্ডোর মতো প্রাক্তন তারকারা বিক্ষোভ নিয়ে পাল্টা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। রোনাল্ডো যেমন বলেছেন, ‘‘ব্রাজিলে দেরি করে স্টেডিয়াম তৈরি হচ্ছে বলে আমি লজ্জিত। আশা করব, বিশ্বের মানুষ আমার প্রিয় দেশ সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা নিয়ে ফিরে যাবেন।” ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জেতানো রোনাল্ডো এখনও ব্রাজিলে বেশ জনপ্রিয়। টিভি শো’তে এসে মজার মজার সব জিনিস ঘটান। গত বছর যেমন টিভি দর্শকদের সামনে নতুন ‘ডায়েট’ মেনে রোগা হলেন। প্রাক্তন ব্রাজিলীয় স্ট্রাইকার রোমারিও এখন রাজনৈতিক নেতা। তিনি প্রকাশ্যেই বিশ্বকাপের দেদার খরচের সমালোচনা করেছেন।
আর ব্রাজিলের রাস্তায় এই সব প্রাক্তনদের হাতের কাছে পাওয়া মোটেও রূপকথার রাজকুমারের সন্ধান পাওয়ার মতো অলৌকিক নয়। রেস্তোরাঁয় গিয়ে হঠাৎ তাদের দেখা পাওয়া যেতে পারে। আমি নিজে একবার বাহা দ্য তিজুকা’র বিচে ঘুরতে গিয়ে আচমকাই আবিষ্কার করি, রোনাল্ডিনহো বিচ ফুটবল খেলছেন!
ব্রাজিলে ফুটবল মানেই তো ধর্মের মতো। আর কখন, কোথায় আরাধ্য দেবতাদের দেখা মিলে যায়, কেউ জানে না। এই বিশ্বকাপের বাজারে যেটা ঘটার সম্ভাবনা আরওই বেশি। নেইমারকে হয়তো রেস্তোরাঁয় পাওয়া কঠিন হবে কারণ ব্রাজিলীয় টিম ম্যানেজমেন্ট ঠিক করে ফেলেছে, বিশ্বকাপ শুরু হয়ে গেলে জনতার কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা হবে ফুটবলারদের। যাতে প্রত্যাশার চাপ থেকে তাদের রক্ষা করা যায়। জনতার সামনে বার করা মানেই তো ভক্তদের বিশ্বকাপ জয়ের আবদারে চাপ আরওই বাড়ল।– ওয়েবসাইট।