এবার টার্গেট দ. আফ্রিকা

SHARE

bd cricভারতকে টানা তিন ম্যাচ হারিয়ে বহু আকাঙ্ক্ষিত ‘হোয়াইটওয়াশ’ করা গেল না। প্রথম দুই ম্যাচ যে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে জিতেছিল বাংলাদেশ, তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে নৈপুণ্যের সে রোশনাই যেন কোথায় হারিয়ে গেল! তবুও কি হতাশ মাশরাফি বাহিনী? না! আনন্দের ফল্গুধারায় ভেসে, উদ্বেলিত হয়েই সিরিজ জয়টাকে উদযাপন করছেন ক্রিকেটাররা। প্রতিটি বিজয়ের পরই এক একটা উদযাপন দলকে উৎফুল্ল করে। উন্নতির সুযোগ থাকে, তবুও প্রাপ্তিগুলোকে পরশপাথর করে রাখাটাই আত্মবিশ্বাসের পালে হাওয়া দেয়। নতুন দিনের গান শোনানো বাংলাদেশ দল সেই আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করেই আগামীর লড়াইয়ে নামতে যাচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। বাংলাদেশের এবারের লক্ষ্য ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি দক্ষিণ আফ্রিকা।

গতকাল হোটেল ছেড়েছে উজ্জীবিত টাইগার বাহিনী। অধিনায়কসহ বেশিরভাগ ক্রিকেটারই বলেছেন, তাদের এবারের টার্গেট দক্ষিণ আফ্রিকা। সে লক্ষ্যে চার দিন পরই অনুশীলনে নেমে পড়তে হবে মাঠে। ৩০ জুন দক্ষিণ আফ্রিকা দল ঢাকায় আসছে। ৫ জুলাই দুই ম্যাচের টি২০ সিরিজ দিয়ে শুরু হবে তাদের সফর। ওয়ানডে এবং টেস্টও রয়েছে এর পর। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ শুরু হবে ১০ জুলাই। প্রথম দুটি ওয়ানডে মিরপুরে এবং তৃতীয়টি চট্টগ্রামে। এর পর ২১ জুলাই চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজের প্রথমটি। ৩০ জুলাই থেকে মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটে দ্বিতীয় টেস্টের মাধ্যমে শেষ হবে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ। তার আগে তাই ক্ষণিকের ঘরে ফেরা। যদিও চোটের কারণে টি২০ সিরিজে খেলতে পারছেন না পেসার তাসকিন আহমেদ।

তার পরও, ভারত সিরিজ শেষে আপাতত স্বস্তি নিয়েই ফিরছেন সাকিব-তামিম-মুশফিকরা। সবাই মানছেন, তৃতীয় ওয়ানডেতে আরও ভালো খেলতে পারত বাংলাদেশ। তবে ভারতের মতো দলের বিপক্ষে সিরিজ জয়টাও কম বড় প্রাপ্তি নয়। সঙ্গে দুই ম্যাচ জিতে ওয়ানডে র‌্যাংকিংয়ের সাত নম্বর অবস্থানটা আগামী সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত নিশ্চিত করতে পারায় ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে উত্তীর্ণ হওয়াটাও কম বড় প্রাপ্তি নয়। বাংলাদেশের কারণেই পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে যে কোনো একটি সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলের ওই টুর্নামেন্টে খেলা হবে না! আইসিসির লক্ষ্য ছিল, বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ের মতো দল যেন বড়দের মধ্যে ‘উটকো ঝামেলা’ হয়ে না আসে। এ জন্যই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি আট দলে নামিয়ে আনা। আইসিসিকে কী লজ্জাটাই না দিল বাংলাদেশ!
আসলে তো তা-ই! ভারতের সঙ্গে এই সিরিজে বাংলাদেশের সম্ভাবনার অঙ্ক হিসাব করা হয়েছিল অন্যভাবে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত র‌্যাংকিংয়ের সাতে থাকতে হলে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তিন ম্যাচের সিরিজে মোট ছয় ওয়ানডের মধ্যে দুটি জয় পেতেই হবে। নইলে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি অনিশ্চিত! ফলে ভারতের বিপক্ষে একটি, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে একটি জয়_ এভাবে ভাবতেই পছন্দ করেছেন অনেকে। অথচ, কী আশ্চর্য! ভারতকে শুধু সিরিজই হারায়নি বাংলাদেশ, জাগিয়েছিল হোয়াইটওয়াশের সম্ভাবনাও। সে আত্মবিশ্বাসটাকে মিত্রশক্তি হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে বলেই এখন এবি ডি ভিলিয়ার্সের দক্ষিণ আফ্রিকাকেও কঠিন প্রতিপক্ষ মনে হচ্ছে না। উল্টো বিশ্বকাপ কাঁপানো প্রোটিয়ারাই এখন ‘বাঘ বাহিনী’কে নিয়ে চিন্তিত!

তবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার বক্তব্য বেশ ভিন্ন। তিনি বরং ভারতের বিপক্ষে সিরিজ শুরু হওয়ার আগে মানুষের প্রত্যাশা আর সিরিজ শেষে মানুষের প্রত্যাশার বিশ্লেষণ করে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, ‘ভারতের বিপক্ষে সিরিজের আগে সবাই বলাবলি করছিল, অন্তত একটা জয় চাই। ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ মিলিয়ে দুটি জয় পেলেই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে পারব আমরা; সেটুকু হলেই অনেক। সেখানে আমরা প্রথম দুই ম্যাচেই সিরিজ জিতে গেলাম।’ তবে সিরিজ জয়ের চেয়ে ‘বাংলাওয়াশ’ না হওয়া নিয়ে সমর্থকদের মধ্যে যে আক্ষেপ, সেটাকেও মেনে নিতে পারছেন না অধিনায়ক। বলেছেন, ‘শেষ ম্যাচের পর থেকে সব জায়গাতেই দেখছি বাংলাওয়াশ হলো না, এই আলোচনা। আমাদের সিরিজ জয়ের চেয়ে বাংলাওয়াশ না হওয়ার আলোচনাই বেশি।’ সঙ্গত কারণেই বিরক্ত তিনি, ‘কথায় কথায় বাংলাওয়াশ-বাংলাওয়াশ করা ঠিক নয়। সব সিরিজেই তো আর আমরা সব ম্যাচ জিততে পারব না! সবসময় বাংলাওয়াশের প্রত্যাশা করাও একটা চাপ। আমাদের প্রতিপক্ষও জিততে মাঠে নামে; তারাও জিততে পারে_ এটা মাথায় রাখা উচিত সবার।’

সমর্থকদের প্রত্যাশা যেন গগনচুম্বী না হয়, সেজন্য মিডিয়াকেও ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন অভিজ্ঞ এ ক্রিকেটার। গতকাল বলেছেন, ‘মিডিয়ারও এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখা উচিত। মিডিয়ায় যখন এসব বেশি বেশি লেখা বা বলা হয়, এমনকি ম্যাচের পরও যখন বাংলাওয়াশ হলো না বলে লেখালেখি বা আলোচনা হয়, তখন তা আসলে মানুষকে প্রভাবিত করে।’ পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকা যে ভারতের চেয়েও ভারসাম্যপূর্ণ ও অধিক শক্তিশালী দল, সেটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘ভারতের চেয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা অনেক বেশি ভারসাম্যপূর্ণ দল। ভারতের ব্যাটিং অনেক বেশি শক্তিশালী, বোলিং ততটা নয়। সিরিজেই আগেই আমি বলেছিলাম, আমাদের বোলাররা ভারতের ব্যাটসম্যানদের আটকে রাখতে পারলে আমরা সিরিজ জিতব। সেটাই হয়েছে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারালে সব বিভাগেই ভালো করতে হবে। কারণ ওদের কোনো দুর্বলতা নেই।’

ভারতের বিপক্ষে সিরিজ জয়টাই যে অনেক আনন্দের, সেটা ফুটে উঠেছে অন্যান্য ক্রিকেটারের মুখেও। যেমন, মাশরাফির সুরে কথা বলেছেন অলরাউন্ডার নাসির হোসেনও। হোটেল ছাড়ার আগে গতকাল বলে গেলেন, ‘হোয়াইটওয়াশ করতে পারলে আরও ভালো লাগত। তার পরও বলব, আমরা অনেক ভালো ক্রিকেট খেলেছি। বাংলাদেশ সিরিজ জিতেছে, এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় গর্বের বিষয়।’

বোঝাই যাচ্ছে, সিরিজ জয়টাকেই বড় প্রাপ্তি মানছেন অধিনায়কসহ তার সতীর্থরা। তার পরও, পরিসংখ্যানের কথা বাদ দিলে এই সিরিজে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি আসলে কী? টিম স্পিরিট, নাকি অদম্য লড়াকু মনোভাব? বলা ভালো দুটোই। সেটার নজির স্থাপনে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারেন অভিজ্ঞ মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ_ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান। আঙুলের চোটে পড়ে ভারতের বিপক্ষে সিরিজটাই খেলতে পারলেন না। তার জন্য সিরিজ শুরুর আগে অধিনায়ক মাশরাফির সে কি আফসোস! অথচ, কী অবিশ্বাস্য, রিয়াদের অভাব বোঝাই গেল না!
কলকাতার বিখ্যাত দৈনিক আনন্দবাজার তাই নিজেদের এক প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘মওকা-মওকা বলে বিদ্রুপের চেয়ে বাংলাদেশি সমর্থকরা আরও নুনের ছিটে দেওয়া প্ল্যাকার্ড কেন ব্যবহার করলেন না, মাহমুদুল্লাহ_ আমাদের সেরা ওয়ানডে ব্যাটসম্যান ছাড়াই তোদের বুড়িগঙ্গায় ফেললাম রে।’

দৈনিক আনন্দবাজারের পর্যবেক্ষণটা হয়তো যথার্থ। এমন প্রশংসা ও সাহস বাংলাদেশকে ভারতের প্রায় প্রতিটি মিডিয়াই দিয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নতির ভূঁয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। সেটা প্রাপ্যও। আসলেই কথা তো সত্য যে, রিয়াদ যে নেই এটা সিরিজজুড়েই বোঝা গেল না। অথচ প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ তিন শতাধিক রান করল। দ্বিতীয় ম্যাচে অনায়াসে ভারতের ২০০ রান তাড়া করে ফেলল। তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে প্রায় তিনশ’ বিশ রান তাড়া করতে গিয়ে কেউ হাল ধরার দিকে মনোযোগী ছিলেন না। সবাই তাড়িয়ে খেলতে চেয়েছেন। ঠিক সে সময়টায় রিয়াদের অভাবটা বোঝা গেছে। তবুও বাংলাদেশ ২৪০ রান তুলে ফেলল। ম্যাচ হারল। তবে তার পরই তো ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জয়ের আনন্দে সবাই সেটা ভুলেও গেল!

অবশ্য কোচ ও টিম ম্যানেজম্যান্টের রাডারে তৃতীয় ম্যাচে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স অবশ্যই পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার হবে। যে আশাবাদের পারদ ‘টিম বাংলাদেশ’ নিজেই উত্তুঙ্গ করেছে, সেই দলের ছন্দপতন হতেই পারে। তবে এতটা তো নয় যে, ৭৭ রানে হেরে যেতে হবে! আজকাল ওয়ানডেতে ৭৭ রানে হার মানে অনেক বড় হার। বিশেষত অধিকাংশ উইকেটই ব্যাটিংবান্ধব বলে, প্রতিপক্ষ যতই করুক না কেন, সেটার ধারেকাছে যাওয়া যাবে না, আধুনিক ওয়ানডে ক্রিকেটে বোধহয় সেই দিন আর নেই। বাংলাদেশের এই পারফরম্যান্স তাই আসন্ন দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের আগে সতর্কবার্তাই দিয়ে গেল।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আসলেই সতর্ক থাকতে হবে বাংলাদেশকে। অধিনায়ক মাশরাফির বক্তব্য থেকে সেটা পরিষ্কার। ভারতের মতোই দক্ষিণ আফ্রিকাও গত বিশ্বকাপের সেমিফাইনালিস্ট দল। হেরে গিয়েছিল অন্যতম আয়োজক নিউজিল্যান্ডের কাছে। তবে অধিনায়ক এবি ডি ভিলিয়ার্সসহ এই দলে আছেন বিশ্বমাতানো বেশ কয়েকজন হার্ডহিটার ব্যাটসম্যান। তারকা পেসার ডেল স্টেইন আসছেন না ওয়ানডেতে। তবুও দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিং লাইনআপ অনেক শক্তিশালী। আর ফিল্ডিংয়ে তো তারা বরাবরই বিশ্বসেরা। দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য একমাত্র প্রতিকূলতা হলো উপমহাদেশের কন্ডিশন। যে কন্ডিশনে তারা স্পিনের বিপক্ষে বরাবরই বিপাকে পড়ে। বাংলাদেশের লক্ষ্যও সেভাবেই তাদের ফাঁদে ফেলা।
এর মধ্যেই অবশ্য গতকাল একটা দুঃসংবাদ শুনতে হয়েছে বাংলাদেশকে। ভারতের বিপক্ষে তৃতীয় ওয়ানডেতে সাইড স্ট্রেনের কারণে খেলতে না পারা পেসার তাসকিন আহমেদ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি২০ সিরিজে খেলতে পারছেন না চোট না সারায়। তবে ফিরছেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ।

অবশ্য দলের অবস্থা এখন এমনই যে, কারও অভাবই অনুভূত হচ্ছে না। টিম স্পিরিট এমনই এক টনিক! টিম স্পিরিটটা যে উত্তুঙ্গ, দলের একজন যে আরেকজনকে সাহায্য করতে উন্মুখ, যিনিই নতুন আসুন তিনিই যে সাহায্য পাচ্ছেন, সেটা বোঝা গেল সৌম্য সরকারকে দেখে। নিজেকে নিয়ে নয়, তিনি মুস্তাফিজুর রহমানকে নিয়েই বেশি উচ্ছ্বসিত। বললেন, ‘মুস্তাফিজের উত্থানটা বেশি ভালো লাগছে। সাতক্ষীরার একটা ছেলে ১৩ উইকেট নিয়েছে। আমার খুবই ভালো লাগছে।’
এগুলোই তো আশাবাদী ও ইতিবাচক বাংলাদেশের প্রতীকী চিত্র। তার পরও যারা হতাশ তাদের জন্য মাশরাফির কথাটাই যথার্থ। যে দল এক ম্যাচ বাকি থাকতেই সিরিজ জিতে নেয়, সে দলকে নিয়ে আশাবাদী হওয়ার, ইতিবাচক ভাবনা ভাবার মতো প্রচুর মণিমুক্তা গভীর সমুদ্র থেকে তীরে এসে আছড়ে পড়বেই পড়বে!