অনেক বছর আগে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার প্রথম দফার সরকারের মেয়াদ যখন শেষ হয়েছিল, তখন জয়নাল হাজারীর মতো একজন রাজনীতিবিদের সঠিক মূল্যায়নকে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছিলাম আমরা- সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা। তার অপরাধী কার্যক্রম অব্যাহতভাবে প্রকাশ করে গিয়েছিলাম আমরা এবং তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ক্রমাগত আমাদের বলেই যাচ্ছিলেন যে এই সবকিছুই বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতাটিকে ধ্বংস করার চক্রান্তের অংশ ছাড়া আর কিছুই নয়।
যখন জয়নাল হাজারী একজন স্থানীয় সাংবাদিককে প্রায় মেরেই ফেলেছিলেন আর শরীরের সব রক্ত বেরিয়ে গিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাকে সড়কের ধারে ফেলে রেখেছিলেন এবং তার চিকিৎসার জন্য আর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর উদ্দেশ্যে যখন তহবিল গঠন ও প্রয়োজনীয় অর্থসংগ্রহে গণমাধ্যম মরীয়া হয়ে উঠেছিল- তখনও সেই সবকিছুকেই দেখা হয়েছিল শুধুমাত্র সরকারকে ধ্বংস করার জন্য ষড়যন্ত্রের কিছু অংশ হিসেবে। আমাদের সংবাদপত্রসহ বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম এই ঔদ্ধত্যকে কখনোই ক্ষমা করেনি।
প্রায় এক দশক পর আমরা আরো একটি ভুল করলাম। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের সত্যিকারের মূল্য বুঝতেও সংবাদমাধ্যম পুরোপুরি ব্যর্থ হলো। প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী এই আবুল হোসেন একজন ‘সত্যিকারের দেশপ্রেমিক’ হলেও পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতিসংক্রান্ত ষড়যন্ত্রের জন্য এই আবুল হোসেনকেই অভিযুক্ত করেছিল বিশ্ব ব্যাংক।
তো হবেটা কী যদি মাত্র শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে পাওয়া প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলারের একটি ঋণ সহায়তা এই জাতির হাত থেকে বেরিয়ে যায়? ৪০ বছরের সময়সীমা বেঁধে দেয়া ছাড়াও ১০ বছরের একটি অতিরিক্ত সময়সহ ঋণশোধের জন্য মোট ৫০ বছর সময় দেয়ার সুবিধাসহ পাওয়া ঋণটি যদি জাতি হারায় তাতে কী হবে? এরকম সহজ শর্তে পাওয়া ঋণ খুবই দুর্লভ হলেই বা কী? বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র ও সম্পদহীন দেশের জন্য এই সুযোগ যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, তাতে কী এসে-যায়?
একজন ‘দেশপ্রেমিক’-এর সম্মান রক্ষার জন্য এইটুকু মূল্য পরিশোধ তো নিতান্তই একটি সামান্য বিষয়।
আমরা, গণমাধ্যমের কর্মীরা আবারো একবার সেই একই ভুল করছি। শামীম ওসমান আর তার পরিবারকে নিয়ে আমরা যে ব্যাপক পরিমাণ লেখা লিখেছি এবং অধিকাংশ সংবাদপত্র যেসব তথ্যবহুল তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে- আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, সেগুলোর সবই ভুল।
যেনতেন জায়গায় নয়, আমাদের মহান পবিত্র সংসদের মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন, “যেখানে অন্যদের বড় বড় অন্যায় নিয়ে কোনো কথাই বলা হয় না, সেখানে তাদের পরিবারের (ওসমান পরিবার) ছোট ছোট ভুলকে সবসময় বিশাল করে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।”
এই বক্তব্যের পরেই প্রধানমন্ত্রীর পরের বক্তব্যটিকে আক্ষরিক অর্থে বলতে চাইলে ‘লৌহবর্মে ভূষিত প্রতিরক্ষামূলক বক্তব্য’ই বলতে হয়- তিনি বলেছেন, “কোনো পরিবার দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করছেন, কিন্তু তারা কোনো অপরাধই করেননি- এমন পরিবার খুঁজে পাওয়াই দুঃসাধ্য।”
প্রধানমন্ত্রী কি এই বক্তব্যের মাধ্যমে এটাই বোঝাতে চাইলেন যে একই ধরনের দুর্নীতি অন্য যেকোনো রাজনীতিবিদের ক্ষেত্রেও এরকমই অত্যন্ত সাধারণ চোখেই দেখা হবে?
তিনি বলেন, “৬০’র দশকে ইয়াহিয়া খানের শাসনামল থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ওসমান পরিবার।” শামীম ওসমানের বড় ভাই ও জাতীয় পার্টি দলীয় প্রয়াত সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আইন নিজস্ব পথেই চলবে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে কোনো পরিবার যেন হেয় না হয় এবং ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ধ্বংস না হয়ে যায়, সেই ব্যাপারে জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে।”
তদন্তকারীরা লক্ষ্য করুন- যদি আমরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সঠিকভাবেই বুঝে থাকি, তার মানে এই দাঁড়ায় যে শামীম ওসমান ও তার পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের কাছে এখন আমাদের ক্ষমা চাইতে হবে। মনে হচ্ছে যেন প্রধানমন্ত্রী আবারো একবার আমাদের সঠিক পথের নির্দেশনা দিচ্ছেন এবং আমাদের উপলব্ধি করাতে চাইছেন যে দেশপ্রেমিকের অর্থ আসলে কী।
তো কী হবে- যদি দেশপ্রেমের মানে জনগণের কাছে অন্য কোনো অর্থ বহন করে?
গত বছরের ত্বকী হত্যা, সম্প্রতি সাত ব্যক্তির হত্যা, ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে বিভিন্ন অবৈধ কার্যকলাপ ও অপরাধী কার্যক্রমের বিষয়ে ক্রমাগত প্রকাশিত হতে থাকা প্রতিবেদন- এই সবকিছুই নারায়ণগঞ্জের জনপ্রিয় পরিবারটিকে ধ্বংস করার চক্রান্তেরই অংশ।
শুধু ওসমান পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্যই নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা যে তাদের সিংহভাগ ভোট সেলিনা হায়াৎ আইভীকে দিয়েছিলেন এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী শামীম ওসমান যে নগণ্য ভোট পেয়ে আইভীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন- সেগুলো অবশ্যই কোনো অর্থ বহন করে না।
প্রধানমন্ত্রীর উপরে উল্লেখ করা যে বক্তব্যগুলো দিয়েছেন তা থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে করা হিংস্র ষড়যন্ত্রের অংশের সার্বজনীন শিকার হয়েছেন নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা। এমন বহু মামলার তদন্ত চলছে যেগুলোর তীর কোনো না কোনোভাবে এই ওসমান পরিবার ও পরিবারটির বহু সদস্যদের দিকেই নির্দেশ করছে। এই বিষয়টি আগাগোড়া অত্যন্ত ভালোভাবে জানার পরেও প্রধানমন্ত্রী জনসম্মুখে এই পরিবারটির পাশেই দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন।
তবে হ্যাঁ, আইন কিন্তু অবশ্যই তার নিজস্ব পথেই চলবে।
সম্প্রতি জাপান সফর শেষে দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী তার সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে এমন আরো কিছু বিষয় শিখিয়েছেন যা শেখা সংবাদমাধ্যমের জন্য অতি প্রয়োজনীয়।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশের বিদেশী বন্ধুদের সম্মানিত করতে যে স্বর্ণপদক দেয়া হয়েছিল, সেখানেও দুর্নীতি করা হয়েছিল। ভেজাল স্বর্ণপদক প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মূল বিষয় এটাই যে তাদের আমরা সম্মানিত করেছি। ওই পদকগুলোকে কী পরিমাণ স্বর্ণ থাকার কথা ছিল আর কী পরিমাণ স্বর্ণ বাস্তবে পাওয়া গেছে, সেসব লেখার মাধ্যমে আমরা শুধুই নিজেদের ছোট করছি।”
এসব বলেই ক্ষান্ত হননি তিনি এবং কোনো না কোনোভাবে এর সঙ্গে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা আছে বলেও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, জনগণের টাকার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির পক্ষপাতিত্ব করা অবশ্যই কোনো উদ্বেগের বিষয় নয় এবং সেজন্যই এই বিষয় নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি করা কোনো গণমাধ্যমেরই উচিত নয়। কাজেই এই ‘পদক অপপ্রচার’-এর সুযোগ নিয়ে যারা টাকা কামাই করেছেন, তাদের বরং ছেড়েই দিন।
খালেদা জিয়ার শাসনামলে তথাকথিত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ অভিযানের সময়, আওয়ামীপ্রধানের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রায় ১৫০ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর ২০০৪ এবং ২০০৫ সালে অভিযান চালিয়ে র্যাব হত্যা করেছিল আরো সহস্রাধিক ব্যক্তিকে। সেই সময় তাদের বিরুদ্ধে কেন কোনো আওয়াজ তোলা হয়নি এবং এখন কেন এত কথা বলা হচ্ছে- প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীর (সুশীল সমাজের অনেক ব্যক্তিই সে সময় প্রতিবাদ করেছিলেন এবং ডেইলি স্টারসহ আরো অনেক সংবাদমাধ্যমও এসব হত্যা নিয়ে অব্যাহতভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করে গেছে এবং র্যাবের বিরুদ্ধে ক্রমাগত তিরস্কারমূলক সম্পাদকীয় লিখে গেছেন অনেক সম্পাদকও)।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য (ভুল) থেকে- যেহেতু তখন কোনো প্রতিবাদ হয়নি, কাজেই এখনো কোনো প্রতিবাদ করা যাবে না- এমন বার্তাটিই কি পাচ্ছি আমরা?
প্রধানমন্ত্রীর নথিবদ্ধ এই বক্তব্যে বলা হয়, খালেদা জিয়ার শাসনামলের মাত্র একটি বছরেই র্যাব এক হাজার লোককে হত্যা করেছিল। তাহলে এতগুলো নিরীহ প্রাণ যে পৃথিবী থেকে মুছে গেছে, তারপর এই সরকারের কি উচিত নয় ওই হত্যাগুলোর তদন্ত করা? অন্তত ওই বক্তব্য থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে সেই সময় থেকেই র্যাব উন্মত্ত আচরণ করতে শুরু করেছিল, তাহলে আবারো কি সেই আগের মতই উন্মত্ত হয়ে র্যাব একই ঘটনা ঘটাতে পারে না?
একই সংবাদ সম্মেলনে সবার দৃষ্টিগোচর হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ব্যবহার করা আরেকটি শব্দগুচ্ছ- ‘স্থায়ী সরকারি দল’।
প্রধানমন্ত্রী বলেন- কিছু ব্যক্তি আছেন যারা সবসময়েই সরকারের লেজ ধরে থাকেন তা সে যে দলই সরকারে থাকুক না কেন। নিজেদের রক্ষা করতে এই ব্যক্তিরা নতুন কোনো দল সরকার গঠন করলেই সেই দলে অংশগ্রহণ করে ফেলেন। এ সময় নারায়ণগঞ্জের ‘সেভেন মার্ডার’ মামলার মূল সন্দেহভাজন নূর হোসেনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন- নূর হোসেন প্রথমে জাতীয় পার্টির লোক ছিলেন, তারপর ১৯৯১ সালে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন এবং সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।
তাহলে প্রশ্ন হলো- এই ইতিহাসের পরেও এই ব্যক্তিকে আওয়ামী লীগের প্রথম সারিতে কেন মেনে নেয়া হল এবং তারপর কেনই বা পরবর্তী ১৮ বছর ধরে তাকে ওই স্থানে থাকতে দেয়া হল? এই লোকটি যে তার অপরাধমূলক কার্যকলাপের জন্য ‘লাইসেন্স’ অর্থাৎ ‘অনুমতিপত্র’ হিসেবে আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবে তার পরিচয়পত্রটি ব্যবহার করেননি, তা যাচাই করার জন্য কি কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে? আওয়ামী লীগে এরকম আর কতজন ‘সরকারি দলে স্থায়ী’ সদস্য আছেন? ক্ষমতাসীন দলের নিরাপত্তার ছায়ায় থেকে এখনো তারা কী কী অপরাধী তৎপরতা ঘটাচ্ছেন?
এই প্রশনগুলো নিয়ে কিংবা এসব সম্ভাবনার বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীকে মোটেই উদ্বিগ্ন মনে হয়নি এবং তার দল থেকে এই ধরনের উপাদানগুলোকে টেনে বের করার ব্যাপারে যে তিনি কোনো পরিকল্পনা করছেন তারও কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
শুধু সংবাদমাধ্যমের জন্যই নয়, বিচারব্যবস্থা সম্পর্কেও সংবাদ সম্মেলনে অনেক শিক্ষা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি প্রশ্ন করেছেন- তিনজন ‘বহিষ্কৃত’ র্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের জন্য কেন উচ্চ আদালতের দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি বেঞ্চ আদেশ দিলেন?
ওই তিন ব্যক্তির মধ্যে একজন বুধবার একটি আদালতে তার অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছেন। যদি ওই তিনজনকে গ্রেফতার না করা হত এবং রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা না হত, তাহলে কি তাকে দিয়ে তার অপরাধ স্বীকার করিয়ে নেয়া সম্ভব হত?
কিন্তু তারপরেও, প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী বিচারকরা ভুল ছিলেন এবং আইনমন্ত্রীর মন্তব্য অনুযায়ী- বিচারবিভাগে অরাজকতা চলছে।
প্রধানমন্ত্রীর এসব বক্তব্যের ভেতর থেকে যে আমরা ঠিক কোন বার্তাগুলো বের করে নেব সে ব্যাপারে আমরা ঠিক নিশ্চিত নই।