স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, পিসির পাশাপাশি টিভি, ফ্রিজের মতো গৃহস্থালি জিনিসপত্রও এখন ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। পরস্পর সংযুক্ত এ যন্ত্রগুলো তথ্য আদান-প্রদান করে মানুষের কোনো সাহায্য ছাড়াই। একে বলা হচ্ছে ইন্টারনেট অব থিংস। কিন্তু এ আন্তঃসংযুক্ত প্রযুক্তিই ব্যক্তির গোপন তথ্য ফাঁসের হাতিয়ারে পরিণত হতে পারে। সম্প্রতি লাস ভেগাসে অনুষ্ঠিত কনজিউমার ইলেকট্রনিক শোতে (সিইএস) বিশেষজ্ঞরা এ আশঙ্কা প্রকাশ করেন। খবর বিবিসির।
‘ইন্টারনেট অব থিংস’-এর ব্যবহার ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ধরনের প্রযুক্তিগুলোই ভবিষ্যতে নিরাপত্তা জটিলতার কারণ হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তারা। সাম্প্রতিক সময়ে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার। টেলিভিশন থেকে শুরু করে রেফ্রিজারেটরও এখন স্মার্ট পণ্যের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এছাড়া রয়েছে স্মার্টফোন ও ট্যবলেটের মতো পণ্যগুলো। গত সময়ে বিশ্বজুড়ে স্মার্টফোনে হ্যাকিংয়ের হার ব্যাপক পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে স্মার্ট টেলিভিশন এমনকি ফ্রিজ পর্যন্ত ব্যক্তি গোপনীয়তা ফাঁসের হাতিয়ারে পরিণত হতে পারে বলে সম্মেলনে জানান বিশেষজ্ঞরা।
সিইএসে এমন অনেক প্রযুক্তি দেখানো হয়েছে যেসব প্রযুক্তি তাদের মালিকদের বিভিন্ন তথ্য সংরক্ষণ করতে পারবে। গ্রাহকরা কী করছেন, তাদের পছন্দ-অপছন্দসহ ব্যক্তিগত অনেক তথ্যই এ প্রযুক্তিগুলোয় সংরক্ষিত থাকবে। এতে যেকোনো হ্যাকারের পক্ষেই খুব সহজে শুধু এ পণ্যগুলো হ্যাক করার মাধ্যমে গ্রাহকদের তথ্য চুরি করা সম্ভব হবে।
ইন্টারনেট অব থিংস বলতে সাধারণত আন্তঃসংযুক্ত পণ্যগুলোকেই বোঝানো হয়ে থাকে। কিন্তু সাধারণ আন্তঃসংযুক্ত পণ্য ও ইন্টারনেট অব থিংসের মধ্যে বেশ অল্প কিছু হলেও পার্থক্য রয়েছে। ইন্টারনেট অব থিংস পণ্যগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেদের মধ্যে তথ্য লেনদেন করতে পারে। এতে গ্রাহকদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়।
কিন্তু ইন্টারনেট অব থিংস প্রযুক্তি এখন অনেকাংশেই যে কারো তথ্য হাতিয়ে নেয়ার উত্তম মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে। সাধারণত কারো ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে হলে বিভিন্ন উত্সর ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু ইন্টারনেট অব থিংস থেকে গ্রাহকদের সব তথ্য একত্রেই সংগ্রহ করতে সক্ষম হচ্ছেন হ্যাকাররা।
এছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য লেনদেন করায় মাঝে কোনো ব্যবস্থার ঊনিশ-বিশ করেই তথ্য হাতিয়ে নিতে পারবেন সাইবার অপরাধীরা। এক্ষেত্রে তথ্য যে চুরি হচ্ছে, তা গ্রাহকরা টেরও পাবেন না। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা ইন্টারনেট অব থিংস থেকে তথ্য হাতিয়ে নেয়াকে খুবই ভয়ঙ্কার ব্যবস্থা বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ এ ব্যবস্থাটি একদিকে হ্যাকারদের জন্য যেমন নিরাপদ, অন্যদিকে গ্রাহকদের জন্য ততটাই বিপজ্জনক।
কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো দিন দিন ইন্টারনেট অব থিংস ভিত্তিক পণ্যের ব্যবহার ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রথম দিকে প্রযুক্তিতে উন্নত দেশগুলোর গ্রাহকরা এ সেবা ব্যবহার করত। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তির প্রসারের সুবাধে বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তেই এ সেবা পৌঁছে গেছে। এত বিশাল ব্যপ্তির কারণে গ্রাহকদের ব্যক্তি নিরাপত্তা এখন হুমকির মুখে রয়েছে বলে মন্তব্য করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক পরামর্শক ল্যারি ডোনস বলেন, গত বছর ইন্টারনেট অব থিংসের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। চলতি বছরও এ খাতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক আয় করবে। ইন্টারনেট অব থিংস ক্রমেই প্রযুক্তির মূল ধারায় চলে আসছে। এর কারণে ভবিষ্যতে ব্যক্তি গোপনীয়তা হুমকির মুখে পড়বে।
লাস ভেগাসের এ সম্মেলনে স্মার্ট লাইটিং সিস্টেম, শিশুর দেখাশোনায় স্কাইপের ব্যবহার, মাংস রান্নায় তাপমাত্রা নির্ণয়ের জন্য ব্লুটুথ সংযুক্ত থার্মোমিটার ও স্মার্ট ওভেনের মতো অনেক নতুন প্রযুক্তি প্রদর্শিত হয়েছে। সিইএসে বলা হয়, এ প্রযুক্তিগুলো অল্প সময়ের মধ্যেই গ্রাহকদের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে।
কিন্তু আশঙ্কার ব্যাপার হলো এ প্রযুক্তির সবগুলোই আন্তঃসংযুক্ত। আর এ প্রযুক্তির প্রসার গ্রাহকদের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করতে হ্যাকারদের সহায়তা করতে পারে। স্মার্ট টেলিভিশন বাজারে আসার পরই পণ্যটি নিয়ে বিভিন্ন মহল দাবি করে যে স্মার্ট টেলিভিশন গ্রাহকদের তথ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো একে প্রযুক্তির ত্রুটি বলে উল্লেখ করলেও তারা এ ধরনের দাবি অস্বীকার করেনি।
গ্রাহকরা কখন টেলিভশন দেখছেন, কোন কোন চ্যানেলে বেশি দেখছেন, কোন কোন প্রোগ্রাম বেশি দেখছেন ইত্যাদি তথ্য তখন এ স্মার্ট টেলিভিশনগুলো ফাঁস করছিল। কিন্তু পরবর্তীতে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগেই এ সমস্যা সমাধান করা হয়। কিন্তু যেখানে টেলিভিশন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তথ্য পাচার হচ্ছে, সেখানে সাইবার অপরাধীদের হ্যাক করতে খুব বেশি সময় লাগবে না বলে মন্তব্য করেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
নতুন হোম অটোমেশন কোম্পানি স্মার্ট থিংসের প্রতিষ্ঠাতা জেফ হাগিনস বলেন, বর্তমান ইন্টারনেট অব থিংস ভিত্তিক প্রযুক্তির প্রসার দ্রুত হচ্ছে। এবং এসব পণ্যের চাহিদাও বাজারে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে অনেকেই হয়তো চিন্তা করছেন না। কিন্তু গ্রাহকদের নিরাপত্তাহীনতা এ খাতে লোকসানের কারণ হতে পারে।
নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও গ্রাহকদের তথ্য হাতিয়ে নেয়ার প্রবণতা রয়েছে বলেও জানান হাগিনস। বিপণন জন্য অঞ্চল ভিত্তিক গ্রাহকদের তথ্য জানা খুব জরুরি ব্যাপার। কারণ যে প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের পছন্দ ও চাহিদা বুঝতে পারে, তারাই সাধারণত বাজার দখলে এগিয়ে যায়। তাই বর্তমানে ইন্টারনেট অব থিংস ভিত্তিক পণ্য নির্মাতারাও গ্রাহকদের তথ্য জানতে তাদের পণ্যে গোপন অনুসরণ ব্যবস্থা যোগ করছে।
তবে এ ধরনের সমস্যা প্রযুক্তি খাতের জন্য অমঙ্গলজনক বলে অভিমত বাজার বিশ্লেষকদের। কারণ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর এ প্রবণতা সবার সামনে প্রচারিত হলে তাদের ওপর থেকে গ্রাহকদের আস্থা হ্রাস পাবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।