সড়কে দুর্নীতি, নেপথ্যে কাদেরসহ প্রভাবশালীরা

SHARE

সড়কের ঠিকাদারি কাজে এক বিস্ময়ের নাম ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এনডিই)। ২০১৭ সালের শেষ দিকে প্রতিষ্ঠানটি সড়কে কাজ শুরু করে। মাত্র ছয় বছরে তারা সড়কে একক ও যৌথভাবে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারি পেয়েছে, যা মোট কাজের ১০ শতাংশ।

সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের সাতজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এনডিই ঠিকাদারি কাজ পেতে আওয়ামী লীগ সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করত। ওবায়দুল কাদের কর্মকর্তাদের বলে দিয়েছিলেন যে প্রতিষ্ঠানটির পেছনে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক।

২০১১-১২ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত এক যুগে সওজের ঠিকাদারি কাজের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ সময়ে এনডিইর মতো ১৫টি প্রতিষ্ঠান ব্যয়ের দিক দিয়ে মোট কাজের ৯০ শতাংশ পেয়েছে। এক যুগে সড়ক ও সেতু নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে ৮৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করেছে সরকার। যার মধ্যে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার কাজ একক ও যৌথভাবে পেয়েছে ওই ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, ঠিকাদারি কাজ পাওয়া, নিম্ন মানের কাজ করে টাকা তুলে নেওয়া এবং বেশি কাজ করা দেখিয়ে বাড়তি বিল আদায়—এগুলোর জন্য ঠিকাদারেরা মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতাদের হাতে রাখতেন। এটা বিগত সরকারের আমলে ‘ওপেন সিক্রেট’ হয়ে পড়েছিল। এটা ছিল দুর্নীতির মহামারি।

সওজের তালিকাভুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় ১ হাজার ১০০টি; কিন্তু মাত্র ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কীভাবে ৯০ শতাংশ কাজ পেয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সওজের প্রকৌশলীরা বলছেন, এসব ঠিকাদার সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের ‘আশীর্বাদে’ ছিলেন। যদিও ঠিকাদারদের কেউ কেউ বলছেন, নেতাদের আশীর্বাদের সঙ্গে মন্ত্রণালয় ও সওজের কর্মকর্তাদের ‘কমিশন’ দিতে হতো। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব নিলেই তাঁদের অবৈধ আয় বেরিয়ে আসবে।

সবচেয়ে বেশি কাজ পাওয়া ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হলো হাসান টেকনো বিল্ডার্স, রানা বিল্ডার্স, এনডিই, মোজাহার এন্টারপ্রাইজ, মো. মঈনউদ্দিন (বাঁশি) লিমিটেড, তাহের ব্রাদার্স, মোহাম্মদ আমিনুল হক লিমিটেড, মাসুদ হাইটেক ইঞ্জিনিয়ার্স, স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স, এম/এস সালেহ আহমেদ, এম এম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স, রিলায়েবল বিল্ডার্স, তমা কনস্ট্রাকশন, মাহফুজ খান লিমিটেড ও আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন।

কাজ পেতে জালিয়াতি ও অনিয়ম প্রকাশ পাওয়ায় চলতি বছরের শুরু থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৫টি প্রতিষ্ঠানকে ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে শীর্ষ ১৩টি ঠিকাদারি (স্পেক্ট্রা ও এম এম বিল্ডার্স ছাড়া) প্রতিষ্ঠান ছিল।

সওজ সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সড়কের ঠিকাদারি কাজ তিনটি পক্ষ নিয়ন্ত্রণ করত: ১. আওয়ামী লীগের কিছু প্রভাবশালী নেতা–সংসদ সদস্য। ২. সাবেক সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের স্বজন ও ঘনিষ্ঠ কয়েকজন এবং ৩. সওজের কয়েকজন প্রকৌশলী। ২০১১ সালে ওবায়দুল কাদের সড়কমন্ত্রী হওয়ার পর ধীরে ধীরে ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী, ওবায়দুল কাদেরের ভাই আবদুল কাদের মির্জা, ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রী ইশরাতুন্নেছা কাদের ও নোয়াখালীর সাবেক সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর চক্র গড়ে ওঠে।

২০২১ সালে কাদের মির্জা নিজের ভাই, ভাবি ও একরাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিয়ে সারা দেশে আলোচিত হন। সাবেক সড়কমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, ঠিকাদারি কাজের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়েই কাদের মির্জার সঙ্গে ওবায়দুল কাদের ও তাঁর স্ত্রীর বিরোধ তৈরি হয়। পরে অবশ্য দুই ভাইয়ের মধ্যে মনোমালিন্য দূর হয়। মন্ত্রণালয় ও সওজে আবার তদবিরের সুযোগ ও ঠিকাদারি কাজ পেয়ে চুপ হয়ে যান কাদের মির্জা।

সড়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, আসলে বিগত সরকারের আমলে কাকে কাজ দেওয়া হবে, তা আগে ঠিক করা হতো। এরপর দরপত্র ডাকার আনুষ্ঠানিকতা করা হতো। তিনি বলেন, এটা আর চলবে না। প্রতিযোগিতা বাড়াতে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করা হবে। অতীতের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে তিনি একটি বিস্তৃত তদন্ত করার কথাও ভাবছেন।