ভেন্যু নিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে ষড়যন্ত্র হয়নি

SHARE
icc curterআইসিসি যতটা না ক্রিকেটের অভিভাবক, তার চেয়ে অনেক বেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এই যে, আগামীবার থেকে বিশ্বকাপ ১০ দলে কমিয়ে আনার প্রস্তাব; সেটার মূলেও এই বাণিজ্য। ফিফার আদলে যারা আইসিসিকে ভাবেন, তাদের ভাবনায় কোথাও একটা ভ্রান্তি আছে!
সংগঠন হিসেবে ফিফার ধারেকাছেও আইসিসি ঘেঁষতে পারবে না। ফিফা যে পেশাদারিত্ব, শৃঙ্খলা ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করে পরিচালিত হয়, সেটা আইসিসির ক্ষেত্রে দুষ্প্রাপ্য বস্তু মনে হবে ইদানিং। এর জন্য অবশ্য খুব বেশি উদাহরণ দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। আইসিসির ‘বিগ্র থ্রি’র ধারণাটা সামনে আনলেই সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়। অভিযোগ উঠেছে, এবারের বিশ্বকাপে সেই ‘বিগ্র থ্রি’র অন্যতম ভারতকে অন্যায়ভাবে সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ, ওই বাণিজ্য!
ভারত বিশ্বকাপ থেকে আগেভাগে বিদায় নিলে বাণিজ্যে কতটা ঘাটতি পড়ে, সেটার খুব ভালো আঁচ পাওয়া গিয়েছিল ২০০৭ সালের ক্যারাবিয়ান আসরে। সেবার বাংলাদেশের কাছে হারের কারণেই ভারতকে প্রথম পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয়। ভারত তো বিদায় নিল নিলই, সঙ্গে বিশ্বকাপের বিপণনেরও বারোটা বাজিয়ে ছাড়ল! আইসিসি তাই ঝুঁকি নিবে কেন! অথচ, ফিফার বিপক্ষে এমন অভিযোগ ওঠা বিরল যে, তারা ব্রাজিল বা ইংল্যান্ড বা স্পেনকে বাড়তি সুবিধা দিবে শুধু বাণিজ্য মাথায় রেখে।
আইসিসির ব্যাপারে এমন সন্দেহ-আশংকা পোষণ করা যায় বলেই, খুব সুনির্দিষ্ট একটা অভিযোগ উঠেছে এমন- ‘ভারতের আবদারের কারণে কোয়ার্টারের ভেন্যু পরিবর্তন করল আইসিসি!’ ভারতের কোয়ার্টার ফাইনালের খেলা পড়েছে মেলবোর্নে। প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ। অতএব, ধারণা করা যেতে পারে, এই অভিযোগটা বাংলাদেশের তরফ থেকেই উঠছে বেশি। বাংলাদেশ বলতে অবশ্য বিসিবি নয়, উঠছে সমর্থকগোষ্ঠী ও কয়েকটি মিডিয়ার তরফ থেকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোও এই অভিযোগে সয়লাব। কিন্তু, এই অভিযোগের বাস্তব ভিত্তি আসলে কতটুকু? সকল উপাত্ত যাচাই করলে দেখা যাবে, শতকরা শূন্য ভাগ!
কোয়ার্টার ফাইনালের জন্য আইসিসি এবার কিছু মানদণ্ড অবলম্বন করেছে। যেটা ‘কোয়ার্টার ফাইনালের ভেন্যু বরাদ্দের মানদণ্ড’ শিরোনামে একটি আলাদা পাতাতে বিস্তারিত বলা আছে আইসিসির ওয়েবসাইটে (http://www.icc-cricket.com/cricket-world-cup/fixtures/finals)।
বিশ্বকাপ শুরুরও অনেক আগে, যখন ফিকশ্চার ও সূচি প্রকাশিত হয়, তখনই বলা হয়েছিল, যদি দুই স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড পুল ‘এ’ থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে পারে, তাহলে তাদের জন্য কোয়ার্টারের ভেন্যু বরাদ্দ থাকবে নিজেদের দেশে। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম পর্বে এক থেকে চারের মধ্যে যেখানেই অবস্থান হোক না কেন, তাদের কোয়ার্টার ফাইনালটি অনুষ্ঠিত হবে অ্যাডিলেডে, ২০ মার্চ। একইভাবে, নিউজিল্যান্ডের কোয়ার্টার ফাইনালটি অনুষ্ঠিত হবে ওয়েলিংটনে, ২১ মার্চ। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড উভয় দলই কোয়ার্টারে উত্তীর্ণ হয়েছে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, তাদের খেলাগুলো ওই দুই নির্দিষ্ট ভেন্যুতেই পড়ছে।
পুল ‘এ’ থেকে প্রথম হয়ে নিউজিল্যান্ড খেলছে পুল ‘বি’-এর চতুর্থ হওয়া দল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। পুল ‘এ’ থেকে দ্বিতীয় হয়ে অস্ট্রেলিয়া খেলছে পুল ‘বি’-এর তৃতীয় হওয়া দল পাকিস্তানের বিপক্ষে।
মজার বিষয় হলো, দিন-তারিখ অনুযায়ী, এবারের আসরের শেষ কোয়ার্টার ফাইনালটি ২১ মার্চ অনুষ্ঠিত হলেও, ওয়েলিংটনের এই লাইনআপটা এ১-বি৪ হয়ে যাওয়ায়, এটাই এবারের প্রথম কোয়ার্টারের স্বীকৃতি পেয়েছে!
একইভাবে, অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তানের লাইনআপটা এ২-বি৩ হয়ে যাওয়ায় সেটা পেয়েছে দ্বিতীয় কোয়ার্টারের স্বীকৃতি।
বাকি যে দুটি কোয়ার্টার ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে, সেগুলোর মধ্যে ১৮ মার্চ সিডনিতে অনুষ্ঠিতব্য শ্রীলংকা-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচটা পেয়েছে তৃতীয় কোয়ার্টারের স্বীকৃতি। কারণ, ওই যে লাইনআপ বলছে এই লড়াইটা পুল ‘এ’-এর তৃতীয় হওয়া শ্রীলংকা ও পুল ‘বি’-এর দ্বিতীয় হওয়া দক্ষিণ আফ্রিকার। এ৩-বি২ তো তৃতীয় কোয়ার্টারই হবে নাকি!
একইভাবে, দ্বিতীয় দিনে অনুষ্ঠিত হলেও, ১৯ মার্চ মেলবোর্নে অনুষ্ঠিতব্য বাংলাদেশ-ভারত কোয়ার্টারটি এবারের আসরের চতুর্থ কোয়ার্টার ফাইনাল। বাংলাদেশ পুল ‘এ’-এর চতুর্থ ও ভারত পুল ‘বি’-এর প্রথম দল হিসেবে খেলছে এই ম্যাচটি। যে ম্যাচটিকে ঘিরে অভিযোগ এবং সেই সূত্রেই এই প্রতিবেদনের প্রয়োজনীয়তা।
একটা বিষয় নিশ্চয়ই পরিষ্কার যে, এবারের আসরে কোন কোয়ার্টারটির ক্রমিক কত তা নির্ধারিত হয়েছে পুল ‘এ’-তে কোন দলের পয়েন্ট তালিকার অবস্থান কেমন, তার ওপর। এ কারণেই, এ১-এর ম্যাচটি প্রথম কোয়ার্টার, এ২-এর ম্যাচটি দ্বিতীয় কোয়ার্টার, এ৩-এর ম্যাচটি তৃতীয় কোয়ার্টার ও এ৪-এর ম্যাচটি চতুর্থ কোয়ার্টার। তার মানে, পুল ‘বি’-এর কোন দলের ওপর ভিত্তি করে কোয়ার্টারের ক্রমিকের স্বীকৃতি প্রযোজ্য নয়।
এবার আসা যাক, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ভেন্যু বরাদ্দের মানদণ্ড প্রসঙ্গে। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের জন্য যেমন, তেমনি পুল ‘এ’ থেকে কোয়ার্টারে উত্তীর্ণ বাকি দুটি দলের জন্যও সেই সময়েই ভেন্যু বরাদ্দ করে ফেলা হয়। এই দুটি দলকে নির্বাচন করা হয়েছিল, তখনকার আইসিসি র্যাং কিংয়ের ক্রম অনুসারে। পুল ‘এ’-তে দুই স্বাগতিক দল বাদে, বাকি পাঁচ দলের মধ্যে সেরা র্যাংকিং শ্রীলংকা ও ইংল্যান্ডের। এই দুই দলকে বলা হয়েছে স্বাগতিক দুই দল বাদে ‘পরবর্তী সর্বোচ্চ র্যাংযকিংধারী’ দল। সেই হিসাবে, এই দুই দলের জন্যই বরাদ্দ করা হয় কোয়ার্টারের ভেন্যু।
শ্রীলংকার জন্য বরাদ্দ হয় ১৮ মার্চের ভেন্যু সিডনি। তা শ্রীলংকার পুল ‘এ’-তে অবস্থান যদি তিন না হয়ে চারও হতো, তাও তারা কোয়ার্টার ফাইনালটা সিডনিতেই খেলত। তখন পুল ‘বি’-এর এক নম্বর ভারতকে সিডনিতেই খেলতে হতো।
ইংল্যান্ডের জন্য বরাদ্দ হয় ১৯ মার্চের ভেন্যু মেলবোর্ন। ইংল্যান্ড যদি বাদ না পড়ে, পুল ‘এ’-তে প্রথমও হতো, তাও তাদের কোয়ার্টারের ভেন্যু হতো মেলবোর্নই।
এসব মানদণ্ড নির্দিষ্ট করার সময় এটাও জানিয়ে দেওয়া হয় যে, এই চার দল অর্থাৎ দুই স্বাগতিক অস্ট্রিলিয়া-নিউজিল্যান্ড ও দুই ‘পরবর্তী সর্বোচ্চ র্যাংদকিংধারী’ শ্রীলংকা-ইংল্যান্ডের মধ্য থেকে কেউ কোয়ার্টারে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হলে, তাদের পরিবর্তে যে দল উঠবে, তারা সেই দলটির জন্য বরাদ্দকৃত ভেন্যুতে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলবে। সেই হিসেবেই, ইংল্যান্ড বিদায় নেওয়ায় এবং বাংলাদেশ কোয়ার্টারে উঠায় বাংলাদেশের খেলা পড়েছে ১৯ মার্চের ভেন্যু মেলবোর্নে।
যদি, ইংল্যান্ড বাদ না পড়ে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড বাদ পড়ত, তাহলে বাংলাদেশের খেলাটা ওয়েলিংটনে পড়ত। কিংবা যদি আরেক স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া বাদ পড়ত, তাহলে বাংলাদেশের খেলাটা অ্যাডিলেডে পড়ত।
যদি, শ্রীলংকা-নিউজিল্যান্ড উভয় দলই বাদ পড়ত, তাহলে ধরে নেওয়া যাক, বাংলাদেশ-আফগানিস্তান এই পুল থেকে কোয়ার্টারে খেলত। সেক্ষেত্রে, বাংলাদেশ যদি পুল ‘এ’-তে পয়েন্ট টেবিলে তৃতীয় হত তাহলে বাংলাদেশের খেলাটা পড়ত সিডনিতে। আফগানিস্তানের খেলাটা পড়ত ওয়েলিংটনে।
কীভাবে? কী কারণে? এক্ষেত্রে হিসাবটা হলো, কোয়ার্টারের যে খেলাটা দিন-তারিখের ভিত্তিতে আগে আছে, পয়েন্ট টেবিলে এগিয়ে থাকা দলকে সেই দিন-তারিখের ভেন্যুটা বরাদ্দ দেওয়া। যেহেতু, সিডনির (১৮ মার্চ) খেলা ওয়েলিংটনের (২১ মার্চ) আগে আছে ফিকশ্চারে, সেহেতু বাংলাদেশের খেলাটা পড়ত সিডনিতে আর আফগানিস্তানেরটা ওয়েলিংটনে।
ভারত যদি আইসিসির ‘পা-ও ধরত’, কেঁদেকেটে সাগর বানিয়ে ফেলত, তা হলেও তার ওয়েলিংটনের বাইরে যাওয়ার উপায় ছিল না। আইসিসিরও ক্ষমতা ছিল না অন্য কোন ভেন্যু বরাদ্দ দেয়। কারণ, পুল ‘বি’-এর প্রথম হওয়ায়, পুল ‘এ’-এর চতুর্থ হওয়া দলের খেলা যে ভেন্যুতেই হোক না কেন, ভারতকে সেখানেই খেলতে যেতে হতো। এই ক্ষেত্রে অন্তত তাদের মোড়লগিরি খাটত না! তাই, ভারত মেলবোর্নে ম্যাচ সরিয়ে এনেছে নিজেদের সুবিধার্থে, এই অভিযোগটা ভিত্তিহীন ও কল্পনাপ্রসূত। ভেন্যু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সকল ভিত্তিই তো পুল ‘এ’-এর দলগুলো। সেখানে, পুল ‘বি’-এর ভারতকে অযথাই টেনে আনা কেন!
এই জটিলতাটা করেছে আইসিসি নিজেই। স্বাগতিক দুই দেশকে নিজেদের দেশে বেশি বেশি খেলার সুযোগ দিতে গিয়ে তারা এতোটা জটিল অবস্থার সৃষ্টি করেছে। না হলে যে, বাণিজ্য হয় না! তাছাড়া, ওই মানদণ্ড ঠিক করার অংশটিতে তারা ছকগুলো এমনভাবে সাজিয়েছে যে, যে কেউই মানদণ্ডগুলো ভালোভাবে না পড়ে শুধু ছকগুলোর দিকে এক নজরে তাকালে বিভ্রান্ত হবেন! ছক ২ ও ৩-কে সমান্তরালে বসিয়ে পড়ে দেখুন তো, আপনি বিভ্রান্ত হন কি না! কী, চতুর্থ কোয়ার্টার ফাইনালটা (বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ) ওয়েলিংটনে পড়ছে তা-ই না? আসলেই কি তা-ই! তাহলে নিউজিল্যান্ড স্বাগতিক হিসেবে কোথায় খেলবে বলুন তো!
আইসিসি অবশ্য কোথাও বাণিজ্যের কথা বলেনি। বলেছে, স্বাগতিক দর্শকদের বাড়তি সুবিধা দিতেই স্বাগতিক দলগুলোকে নিজেদের দেশে খেলানোর এই ব্যবস্থা তাদের করতে হয়েছে। ভালো চিন্তা বটে!
এই সুবিধা গত বিশ্বকাপেও দেওয়া হয়েছিল। ভারত কোয়ার্টার খেলেছিল আহমেদাবাদে, শ্রীলংকা কলম্বোতে। সেমিফাইনালেও তা-ই। ভারত মোহালিতে, শ্রীলংকা কলম্বোতে। আর সব সমীকরণ মিলিয়ে বাংলাদেশও যদি সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছুত, তাহলে বাংলাদেশের খেলাগুলোও গতবার ঢাকাতেই পড়ত। বিধি বাম, বাংলাদেশ তো গতবার প্রথম পর্বই পেরোতে পারেনি!
এবারও, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড সেমিফাইনাল খেলবে নিজ নিজ দেশে, যদি তারা কোয়ার্টারে জেতে। পাকেচক্রে, দুই স্বাগতিকের সেমিতে দেখা হচ্ছে না। নইলে, পুল ‘এ’-তে নিজেদের মধ্যে এগিয়ে থাকার সুবাদে নিউজিল্যান্ড দেশের মাটিতেই খেলত। অস্ট্রেলিয়াকে তখন খেলতে যেতে হতো অকল্যান্ডে। তারা মুখোমুখি হচ্ছে না বলেই, কোন সেমিটা কোথায় হবে সেটা আগাম বলে দেওয়া গেছে। নইলে, কোয়ার্টার শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলাই যেত না! যদি বলা না যেত, তাহলে, তখন ছক-৪ ও ছক-৫ এমনভাবেই বিভ্রান্ত করে যেত!
বাংলাদেশের বিপক্ষে অন্তত ভেন্যু সংক্রান্ত ষড়যন্ত্র যে হয়নি, সে বিষয়ে নিশ্চিত থাকুন। তবে, বিশ্বকাপের বিপণন-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে, ভারতকে টুর্নামেন্টের শেষতক পৌঁছে দেওয়ার জন্য, অন্য কোন উপায় খোঁজা হয়েছে বা হচ্ছে কি না সেটা জানতে আমাদের ১৯ মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। চোখ রাখুন মেলবোর্নে!
তার পরও, আমরা যেন আমাদের খেলোয়াড়দের খেলোয়াড়ি দক্ষতার ওপর আস্থা না হারাই। এভাবে বিভ্রান্তি ছড়ালে খেলোয়াড়-সমর্থক সবারই মনোযোগ খেলা থেকে অন্য দিকে চলে যায়, এটা আমরা বুঝব কবে!