আহত ব্যক্তির সাহায্যে কেন মানুষ এগিয়ে আসে না?

SHARE

ovijit7লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ড স্তম্ভিত করেছে অনেককেই। তবে সেইসাথে সমালোচনা চলছে আরেকটি বিষয় নিয়েও।

মি. রায় যখন মুমূর্ষু অবস্থায় ঘটনাস্থলে পড়ে ছিলেন তখন তার স্ত্রীর চিৎকারেও সাহায্য করার জন্য দীর্ঘসময় যাবত কেউ এগিয়ে আসেনি।
বিভিন্ন সময়ে এধরণের হামলা বা দুর্ঘটনায় উপস্থিত মানুষের নির্লিপ্ততা দেখা যায়। কিন্তু এই নিষ্ক্রিয়তার কারণ কি?

এটি কি শুধুই নিজেকে ঝামেলা থেকে রক্ষা করার জন্য, নাকি মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়?

২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের পাশে ফুটপাতে হামলার শিকার হন অভিজিৎ রায়।

হামলাকারীরা তাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে পালিয়ে যাবার পর, সেখানেই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে মি. রায়ের দেহ। আর তার পাশে তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ চিৎকার করতে থাকেন সাহায্যের জন্য।

এসময় সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের ভেতর থেকে চিৎকার শোনেন ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদ। তিনি ভেতর থেকে উদ্যানের মূল ফটক দিয়ে বেরিয়ে যখন ঘটনাস্থলে পৌছান তখন পেরিয়ে গেছে প্রায় আরো ১০ মিনিট। কিন্তু তখনো সেখানে উপস্থিত প্রায় শতাধিক মানুষের মাঝে কেউই আহতদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি।

জীবন আহমেদ যখন নিজেই একটি অটোরিক্সা ঠিক করে যখন মি. রায়ের স্ত্রীকে সাথে নিয়ে তিনি হাসপাতালে যাবার চেষ্টা করেন, তখন কয়েকজন তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন। কিন্তু এর আগে কেউ সাহস করে এগিয়ে আসেননি।

জীবন আহমেদ বলছিলেন, পেশাগত দায়িত্বের কারণে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন, কিন্তু মানবিক কারণে তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন আহত ব্যক্তির সাহায্যের জন্য।

তিনি বলেন, “আমার বিবেকটা তখন পারছিল না দাড়িয়ে থাকতে। সবার মধ্যেই তো একটা মনুষ্যত্ববোধ কাজ করে। সে ব্লগার না কি তা আমি তখনো জানি না। সে আমার ভাই বা বোনও হতে পারতো। আমি দেখলাম তাকে সাহায্য করা প্রয়োজন। এজন্যেই তাকে উঠিয়েছি।”

এধরণের ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আহতদের সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে আসতে চায় না। অনেকেই বলেন, নিজেরা পরবর্তীতে ভোগান্তিতে পড়তে চান না বলেই তারা এসব বিষয় এড়িয়ে চলেন।

তবে ভোগান্তিতে যে একেবারেই পড়তে হয় না তাও নয়।

২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই কুপিয়ে আহত করা হয় অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে, তখন সেখানে এগিয়ে গিয়েছিলেন শরিফুল হাসান। বর্তমানে প্রথম আলোর সাংবাদিক শরিফুল হাসান তখন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।

তিনি বলছিলেন, নৈতিক কারণে তখন তিনি এগিয়ে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে পারেননি। কিন্তু পরে তাকে এনিয়ে তাকে ভোগান্তিও পোহাতে হয়েছে। এমনকি হুমায়ুন আজাদকে উদ্ধারের সময় তার একটি ছবিকে কেন্দ্র করে তাকেই অনেকে অভিযুক্তও করতে চেয়েছিলেন। তাকে গ্রেপ্তারেরও একটি নির্দেশ ছিল বলে পুলিশ কর্মকর্তারা পরে তাকে জানিয়েছিলেন।

“এই ঘটনায় সিআইডির কর্মকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সাথে কথা বলেন। পরে সিআইডি অফিসে গিয়ে আমি স্টেটমেন্ট দিই। এরপর থেকে ১১ বছর ধরে চলছে। সেই মামলার ২ নম্বর সাক্ষী আমি। প্রায় কোর্টে গিয়ে সাক্ষী দিতে হয়, কোর্টে গিয়ে দাড়িয়ে থাকতে হয়। হয়তো এসব ভোগান্তির চিন্তা করেই অনেকে এগিয়ে আসে না।” বলেন মি. হাসান।

যদিও মি. হাসান বলছেন যে, ঝামেলা পোহাতে হলেও সেমুহুর্তে তিনি যা করেছেন সেটি ঠিক ছিল বলেই তিনি মনে করেন। একইভাবে জীবন আহমেদও এখন ভবিষ্যৎ ভোগান্তি নিয়ে কিছুটা চিন্তিত হলেও, যা করেছেন তা নিয়ে তার কোন আক্ষেপ নেই।

কিন্তু কোনো ব্যক্তি যদি হামলার শিকার হয়ে কিংবা দুর্ঘটনায় পড়ে আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকেন, এসব ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষকেই দেখা যায়, দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কিংবা উপেক্ষা করে চলে যেতে।

যদিও ঢাকার রাস্তায় কয়েকজন মানুষের কাছে এধরণের ঘটনায় তাদের প্রতিক্রিয়া কি হবে জানতে চাইলে, অধিকাংশ মানুষই বলেন, তারা সাহায্য করতে এগিয়ে যেতে চান।

একজন পথচারী মি. সৈকত বলেন,”আমি একবার একজনকে আমার গাড়িতে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর আমার জরুরি কাজে আমি ফিরে আসতে পারিনি, বরং আমাকে আদালতে একরকম প্রমাণ করতে হয়েছে যে কাজটার জন্য আমি দায়ী কিনা।”

তবে বিপদে মানুষকে সাহায্য করার মতো মানবিক একটি কাজ করে কি একজন সাহায্যকারীরই সমস্যায় পড়ার কথা? সিনিয়র আইনজীবী শাহদিন মালিক বলছিলেন, এই সমস্যাটি আইন বা নিয়মের নয়, বরং এটি তৈরি হয় আইনের অপব্যবহারের কারণে।

“লোকের একটা ভয় থাকে যে, হামলার ঘটনা হলে পুলিশ হয়তো কাউকে না পেয়ে তাকেই অপরাধী করে দিতে পারে। এধরণের ব্যাবহারিক অপপ্রয়োগগুলো হয় বলেই আমার ধারণা লোকজন নিজেদের যতদূর সম্ভব দুরে বাঁচিয়ে রাখতে চায়।” বলেন মি. মালিক।

কোনো হামলার ঘটনা বা দুর্ঘটনায় সাধারণ মানুষের এগিয়ে যাওয়াটা যদিও অনেকটা ঐচ্ছিক, তবে একাজটি যাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে সেই পুলিশের বিরুদ্ধেও নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ প্রায়সময়ই ওঠে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের সময়ও রাস্তার উল্টো পাশেই পুলিশের একটি ট্রাক অবস্থান করছিল। আর হুমায়ুন আজাদের ঘটনায়ও কাছে পুলিশ থাকা সত্ত্বেও তারা প্রথমে এগিয়ে আসেনি। উদ্ধারকারীরা অনুরোধ করার পরই পুলিশ কিছুটা তৎপর হয়।

বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা বলছিলেন, এসমস্ত ক্ষেত্রে অপরাধ প্রতিহত করাটা পুলিশের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু তারা যদি সেটা না করে, তার পেছনে মূলত সংশ্লিষ্ট পুলিশের মনোভাবকেই দায়ী মনে করছেন মি. হুদা।

তিনি বলেন “অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তির বিচ্যুতি হয় বলেই আমার অভিজ্ঞতা। এধরণের ঘটনায় তার মধ্যে যদি ইতস্তত ভাব থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এ্যাকশন না নেয়াটাও একটি বড় ব্যত্যয়। আর অন্যটি হতে পারে সংস্থাগতভাবে যদি তার ঠিকভাবে ব্রিফ না থাকে। তবে অপরাধ ঘটার সম্ভাবনা থাকলে তাকে এ্যাকশন নিতেই হবে। ”

মি. হুদা বলছেন, মারাত্মক ধরণের অপরাধ ঘটতে দেখলে সেখানে সাধারণ মানুষেরও অধিকার আছে তাতে বাঁধা দেবার। তবে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে যাবার ভয়ে সাধারণ মানুষও অনেকসময় বাধা দেন না বা ঘটনার পর আক্রান্তকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন না।

“কোর্ট-কাচারি থেকে সাধারণত মানুষ দুরে থাকতে চায়। হয়তো কোথাও বেশি এবং কোথাও কম। তবে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়লে মানুষ এসব আইনি প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে থাকবে না। ” মন্তব্য করেন মি. মালিক।

শাহদিন মালিক মনে করছেন, এসব ক্ষেত্রে ভোগান্তি বা হয়রানির ভয় যেমন মানুষের মাঝে কাজ করে, তেমনি নৈতিকভাবেও অনেকে এগিয়ে যাবার তাগিদ অনুভব করেন না।

“নৈতিক কারণেই আমরা সাহায্য করতে এগিয়ে যাই। কিন্তু এখন আমাদের ভালো-মন্দের ধারণাগুলি এতটাই গুলিয়ে গেছে যে আমরা নৈতিকতার তাগিদে সাহায্য করতে এগিয়ে যাচ্ছি না। বরং ব্যবহারিক অসুবিধার কথা চিন্তা করে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকছি।”

তবে অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে যদি আক্রান্ত কারো সাহায্যে অন্যরা এগিয়ে না আসেন, তার ফলাফল আরো বেশি গুরুতর হতে পারে। কারণ, বাংলাদেশে এম্বুলেন্স বা অন্যান্য জরুরি সেবা পাওয়া অতটা সহজ নয়। কোন নির্দিষ্ট টেলিফোন নম্বরে ফোন করলে দ্রুত সেবা পাওয়া যাবে এমন কোন নিশ্চয়তায়ও নেই। যেকারণে অনেকসময় দেখা যায় শুধুমাত্র দ্রুত চিকিৎসার অভাবেই সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত বা আক্রমণের শিকার কোন ব্যক্তিকে বাঁচানো সম্ভব হয় না।

সাধারণ মানুষদের অনেকেই বলছেন, তারা চান এসব ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাহায্য করতে । “ভালো-মন্দের ধারণাগুলি আমাদের এতটাই গুলিয়ে গেছে যে ঐ নৈতিকতার তাগিদে আমরা সাহায্য করতে যাচ্ছি না। বরং ব্যাবহারিক সমস্যার কথা চিন্তা করে আমরা সাহায্য করা থেকে বিরত থাকছি।”

বিশ্লেষকরাও মনে করেন, সাহায্য করার পর যদি তারা হয়রানির শিকার হবেন না এই নিশ্চয়তা যদি দেয়া যায়, তাহলে হয়তো অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন হতে পারে।– বিবিসি