ইউক্রেন: কোনো পক্ষই শান্তি চায় না

SHARE

ucrenfইউক্রেনের সমস্যার মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক তৎপরতা চলছে, জার্মানি এবং ফ্রান্সের মতো ইউরোপের শক্তিধর দেশগুলি বড় ভূমিকা নিয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধবিরতির যে প্রস্তাব গৃহীত হলো, তা বিশেষ আশা জাগায় না। ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যাদের স্বার্থের অনুকূল, তাদের অবস্থান পালটায়নি। তবে রাজনীতির কিছু তাৎক্ষণিক বাধ্যবাধকতা থাকে, যার ফলে একটা সাময়িক বোঝাপড়া সম্ভব হতে পারে, যে বোঝাপড়া থেকে আবার ইউক্রেনের একটা নতুন এবং স্থায়ী মানচিত্র তৈরি হতে পারে। যেমন যুগোস্লাভিয়ার ক্ষেত্রে  অনেকগুলো যুদ্ধবিরতি এবং বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে একটা স্থায়ী সমাধানে পৌঁছানো গিয়েছিল।

ইতিমধ্যে এক দিকে পশ্চিম ইউরোপে এবং অন্য দিকে পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়া, দুই অংশেই আবেগ ও আকাঙ্ক্ষা প্রবল থাকবে এবং তার ফলে সংঘাতের পরিবেশও জারি থাকবে। টিমথি গার্টন অ্যাশ-এর মতো যে সব ইউরোপীয় পর্যবেক্ষকের লেখাপত্র কলকাতায় অনেকেই পড়েন, তারা বলেই চলবেন যে, রাশিয়ানদের ভাতে মারার নীতিই আমেরিকার অনুসরণ করা উচিত। তারা আসলে ঠান্ডা লড়াইয়ের পুনরাবৃত্তি চান। অন্য দিকে, রাশিয়া এবং পূর্ব ইউক্রেনের মানুষের চোখে কিয়েভ হল ‘বান্দেরা’দের-এর ঘাঁটি। (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউক্রেনের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা স্তেফান বান্দেরা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্তদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন।)

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কা এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত দোনিয়েত্স্ক ও লুহান্স্ক-এর নোভোরুসিয়া (নব-রাশিয়া)-পন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী, কোনো তরফেরই যুদ্ধবিরতি মেনে চলার তাগিদ নেই। কিয়েভ-এর রাজনীতিক ও অফিসাররা মনে করেন, ন্যাটো যথেষ্ট অস্ত্র সরবরাহ করলে এই যুদ্ধ তারা জিততে পারবেন, যদিও বহু প্রাণের বিনিময়ে। সে জয় না পেলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং নেটোর সদস্যপদের জন্য ইউক্রেনের দাবি আদায় করা কঠিন হবে। উল্টো দিকে, বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং তাদের রুশ পৃষ্ঠপোষকরা যুদ্ধে জয়ী হতে কৃতসঙ্কল্প, সুতরাং এই লড়াইয়ে তারাও একটা স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন। তার ফলে রাশিয়াতে নানা গোষ্ঠী পূর্ব ইউক্রেনের বিদ্রোহীদের সমর্থনে জোট বেঁধেছে: পুতিনের প্রেরণায় উজ্জীবিত রুশ জাতীয়তাবাদীরা যেমন আছেন, তেমনই আছেন রস্তভ-এর কসাকরা, যারা ইউক্রেন-বাসী ভাই-বেরাদরদের সহমর্মী।

ইউক্রেনের লড়াইয়ে এক দিকে আছে সে দেশের সেনাবাহিনী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্ল্যাকওয়াটার নিরাপত্তা রক্ষী বাহিনী, পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া এবং সুইডেন। অন্য দিকে আছে রাশিয়ার রাষ্ট্রশক্তি। ইউক্রেনের সরকারি ভাষ্যকাররা যা-ই বলুন, রাশিয়ার ফৌজ এই লড়াইয়ে সরাসরি যোগ দেয়নি, সংঘর্ষটা চলছে ইউক্রেনের মানুষের দুটি গোষ্ঠীর মধ্যেই। কিন্তু রাশিয়া বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রভূত সাহায্য করছে, অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে, সংগঠন দিয়ে এবং অন্য নানা ভাবে। অভিযান পরিচালনার ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ক্রাইমিয়া, ইউক্রেন-সন্নিহিত রাশিয়ার রস্তভ ও বেলগোরোদ অঞ্চল, আর কুবান, কুর্স্ক ও মস্কোয় রুশ ফৌজ এবং প্রধান গোয়েন্দা সংগঠন এফএসবি’র কিছু অংশ।

দুই তরফই এই যুদ্ধে অনেকটা বিনিয়োগ করেছে। এখনও ধ্বংস এবং প্রাণহানি এমন মাত্রায় পৌঁছায়নি যে সেই বিনিয়োগকারীরা বলবেন, ‘আর নয়, এবার থামা দরকার’। এদের মধ্যে আছেন পশ্চিম ইউক্রেনের ক্ষমতাবানরা (যারা পোরোশেঙ্কোর বন্ধু এবং হিতৈষী)। অন্য দিকে আছেন পূর্ব ইউরোপের ক্ষমতাশালীরা, যারা সোভিয়েত যুগের ক্ষমতার উত্তরাধিকার বহন করছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে বিভাজন ঘটে গেছে। ক্রিমিয়া রাশিয়ার দখলে চলে যাওয়ায় তাদের কারও কারও স্বার্থহানি ঘটেছে, যেমন পূর্ব ইউক্রেনের দ্নেপোপেত্রভ্স্ক প্রদেশের গভর্নর কলমইস্কি, তিনি এখন কয়লা ও লোহার খনিতে সমৃদ্ধ দনিয়েৎস্ক অঞ্চলে প্রতিপত্তি ফিরে পেতে একটা আপসের পথে যেতে চান, তাই সেখানে সুস্থিতি ফিরুক এটাই তার কাম্য। অন্য দিকে আছেন সোভিয়েত আমলের কমিউনিস্ট পার্টির কিছু মাতব্বর, যারা সোভিয়েত-উত্তর রাশিয়াতে বিপুল সম্পদের মালিক হন, যেমন রিনত আখমেতভ, যিনি এই অঞ্চলগুলির খনি এবং শিল্প নিয়ন্ত্রণ করেন। এরা দু’দিক রেখে চলার চেষ্টা করছেন, এদের পিছনে আছেন রাশিয়ার ক্ষমতাবানরা।

এই সংঘাতকে কেন্দ্র করে যে বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চলছে, তাতেও আবার দুই পক্ষেরই নিজস্ব ভূমিকা আছে। মনে রাখতে হবে, ইইউ-এর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের মধ্যে একটা আধিপত্য কাজ করে। ওয়াশিংটনের দুনিয়াদারির সাধনায় প্রধান বাধা হলো রাশিয়ান ফেডারেশনের সামরিক শক্তি। ২০১৪’য় ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ-এ যে শাসকরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, রাশিয়াকে ঠেকিয়ে রাখার উদ্যোগে শরিক হিসেবে তারা পশ্চিমের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ইইউয়ের নিজস্ব স্বার্থ এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনের পক্ষে বিশেষ সুবিধাজনক, আবার ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে রুশ-ভাষী এবং অন্যদের বিভাজনও তাদের পক্ষে কম সুবিধার নয়। ইউক্রেনকে ইইউয়ের শরিক করে নেওয়ার প্রকল্পটি নিয়ে ইউরোপের দেশগুলিতে দু’রকম মতই আছে, এক দল এই উদ্যোগে উৎসাহী, অন্য দল উৎসাহী নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে ওয়াশিংটন ইইউয়ের উপর নিজের মত চাপিয়ে দিতে পারে, সেখানেই তার আধিপত্য।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচারে, রাশিয়ার অর্থনৈতিক শক্তি তেলের দামের উপর বিশেষ ভাবে নির্ভরশীল, কিন্তু দুনিয়ায় সামরিক শক্তিতে রাশিয়া এখনও আমেরিকার পরে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। রাশিয়া সম্পর্কে মার্কিন নীতিবিশারদদের মধ্যে নানা মত আছে। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ডেপুটি সেক্রেটারি স্ট্রোব ট্যালবট বা সাম্প্রতিক কালে রাশিয়ায় নিযুক্ত ভূতপূর্ব মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইকেল ম্যাকফল রাশিয়ায় উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে তৎপর হয়েছিলেন, সে দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতাকাঠামোয় তার কী প্রতিক্রিয়া হবে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে চাননি। আবার  ব্র্জেজিনস্কির মতো কূটনীতিবিশারদরা সওয়াল করেছেন যে, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে মার্কিন-ইউরোপীয় প্রকল্পের জন্য রাশিয়ার এখনকার চেহারাটাকেই বিসর্জন দিতে হবে- রাশিয়ার নিজের পক্ষে এর পরিণাম কী হতে পারে সেই প্রশ্নটা তারাও অগ্রাহ্য করেছেন।

আমেরিকা ও ইউরোপের এই উদ্যোগ ঠেকাতে পুতিন ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলির রাষ্ট্রনায়কদের সংহতির আহ্বান জানিয়েছেন, আহ্বান জানিয়েছেন পশ্চিম এবং পূর্ব এশিয়ার সমমনোভাবাপন্ন রাষ্ট্রনেতাদেরও। গণতন্ত্র সম্পর্কে ইউরো-মার্কিন ধারণার আধিপত্য অস্বীকার করে পুতিন বলছেন ‘সার্বভৌম গণতন্ত্র’-এর কথা, যা বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানকে গণতন্ত্রের সঙ্গে মানানসই বলে মনে করে, ইউরো-মার্কিন ধারণার সঙ্গে তা না মিললেও। ‘ইউরেশিয়ান ইউনিয়ন’ তৈরি করে তিনি সোভিয়েত বলয়ে অর্থনৈতিক শক্তির ভিত্তিতে এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান।

তবে পূর্ব ইউক্রেনের দ্বন্দ্বভূমিতে এই ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের বিশেষ ভূমিকা নেই। সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীরা প্রশাসনিক দফতরগুলি দখল করেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়েছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পেনশন ফান্ডের পরিচালনা, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং জনস্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলিকে কিয়েভের হাতেই ছেড়ে রেখেছে। তারা নিজেদের মুদ্রা প্রচলন করেছে এবং বিভিন্ন জনকল্যাণ কর্মসূচি প্রচলনের কথা বলেছে, কিন্তু এই ব্যাপারগুলোকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। দনিয়েৎস্ক এবং লুহান্স্ক অঞ্চলে রাজস্ব সংগ্রহ এবং প্রশাসন পরিচালনায় যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার জন্য তাদের আরও বেশি এলাকা দখলে আনা দরকার। রাশিয়া তার দায় নেবে না, বিশেষ করে তেলের দাম এত কমে যাওয়ার পরে। এখনই যুদ্ধ থেমে গেলে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সেই প্রয়োজনীয় ক্ষমতা পাবে না। তাই শান্তি তাদের স্বার্থের অনুকূল নয়। অন্য দিকে, ইউক্রেন সরকার তার বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি পালনে বার বার ব্যর্থ হয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে সীমান্তের উপর তার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। যুদ্ধবিরতি জারি থাকলে কিয়েভকে তার আর্থিক দায়গুলি মেটাতে হবে, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এলাকাগুলিতে সুস্থিতি আনতে হবে। শান্তি পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার এই লক্ষ্য পূরণের অনুকূল নয়।

তবে শান্তি বজায় থাকাটা বাণিজ্যিক লেনদেনের পক্ষে ভাল এবং সেটা জ্বালানি সরবরাহের বন্দোবস্তকেও নতুন করে ঠিকঠাক করে নিতে সাহায্য করবে। এই কারণেই ইউরোপ ও রাশিয়া যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছে। তা ছাড়া, শান্তি বজায় থাকলে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ ইউক্রেনে একটা ফেডারেশন তৈরির ব্যাপারে কথা চালাতে পারবে। সেই আলোচনা সফল হবে না, কিন্তু তার ফলে দুই তরফেরই প্রত্যাশা নিয়ন্ত্রিত হবে এবং যথাযথ সমাধানে পৌঁছনোর পথটা প্রসারিত হবে। এটাই এই পরিস্থিতিতে একমাত্র আশার আলো।

অবস্থা উদ্বেগজনক। ব্যবসাবাণিজ্য চলছে, যেমন চলছে কয়লাখনি বা কারখানাগুলিও, কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জনপরিষেবার হাল খুব খারাপ। যুদ্ধবিগ্রহের ফলে বিভিন্ন এলাকায় সরাসরি ক্ষয়ক্ষতি তো ঘটছেই, বিধ্বস্ত ইমারতের ছবিগুলোই তার প্রমাণ, পাশাপাশি সরবরাহ ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় আঘাত পড়ার ফলে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হচ্ছে। উদ্বাস্তু মানুষের স্রোত অব্যাহত। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনের ফল সীমিত হতে বাধ্য। এই ধরনের পরিস্থিতিতে সচরাচর ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ কথাটি ব্যবহৃত হয়, যদিও ব্যর্থতাটা কার, সেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্পষ্ট হয় না। তবে পূর্ব ইউক্রেনের ভবিষ্যত্ অন্ধকারাচ্ছন্ন, রুপোলি রেখাগুলো নজর করার পরেও অন্ধকার ঘোচে না।