LOVE নাকি লাভ

SHARE

love loveফেব্রুয়ারির গোড়া থেকেই রুখাশুখা ফুটপাথ সেজে উঠেছে রঙবেরঙের কার্ডে৷ লাভ সাইন পিলো আর হরেক গিফটের বাহার যেন আগেভাগেই শহরকে বলে উঠতে চাইত, ‘বসন্ত এসে গেছে’৷ বাতাসের শিরশিরানিতে তখনও লাগেনি ফাল্গুনি ছোঁয়া৷ গাছে গাছে তখনও ফোটেনি প্রথম পলাশ৷ তবু ফুল ফুটুক না ফুটুক শহরের প্রেমিক মন জানত বসন্তের আর দেরী নেই৷ ভ্যালেন্টাইন্স ডে কী, আর কী নয়, সে প্রশ্ন তুলে রেখে, গোপনে কার্ডের বুকে বুকে লেখা হয়ে যাচ্ছে প্রিয়জনের নাম৷ এ দিনের এমনই জাদু৷ শুধু এ শহর কেন, সারা পৃথিবীতে কার্ড বিনিময়ের এমন হিড়িক যে, ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রায় ১৫০ মিলিয়ন কার্ড বিনিময় হয়, এবং সংখ্যাতত্ত্বে কার্ড দেওয়া-নেওয়ার এটাই দ্বিতীয় বড় দিন৷ এহেন যে দিনের ম্যাজিক, তার পিছনে ইতিহাস নিশ্চয়ই একটা আছে৷ কিন্তু ফিলহালের কফির উপর লাভসাইন ক্রিম তো আর ইতিহাসের পাতা মাথায় রাখার তোয়াক্কা করে না৷ গিফট আর ফোনে-ফেবুতে উইশলিস্টের ভিড়ে গল্পগাছা আছে যা তা প্রায় রবাহুতের মতো মুখ লুকিয়ে৷ তবু হান্ড্রেড পার্সেন্ট লাভের দিনে একবার গোড়ার কথায় না ফিরলেই নয়৷

LOVE  নাকি লাভ…
ভ্যালেন্টাইন্স ডে LOVE নাকি লাভের সে নিয়ে বেশ সরগরম বাজার৷ অনেকেই বলেন, প্রেমেরে বিদায় দিয়ে, শুধু গিফট দিয়ে আর কী হবে৷ মুক্তবাজারের অর্থনীতির দিকে আঙুল তুলে বলেন, পুরোটাই আসলে প্রেমের সেন্টিমেন্ট ভাঙিয়ে খোলবাজারের গাঁটকাটার কারসাজি৷ বাজারের দিকে তাকিয়ে সে কথার যে সারবত্তা নেই তাও বলা যায় না৷ যেভাবে উপহারের উপাচারে এ দিনের ভ্যালুয়েশন চলে, যেভাবে পার্টি, ডিজে, লাঞ্চ-ডিনারের বিশেষ ছাড়ের ঘোষণা করে রেস্তরাঁগুলো, যেভাবে অনলাইন শপিং ডেস্টিনেশনে খুড়োর কলের মতো নাকের ডগায় ডিসকাউন্ট ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, তাতে কে বলবে আসলে এ দিনের ফোকাস থাকার কথা প্রেমে, অন্য কিছুতে নয়৷ তবু প্রেম ছেড়ে কবে থেকে যেন তা হয়ে গেছে প্রেম দেখানোর দিন৷ বিজ্ঞাপনের সেই ‘দেখো আমি বাড়ছি মাম্মি’র মতো, এও যেন লোক ডেকে হেঁকে বলা, শোনো হে খোলাবাজার, প্রেম করেছি আমি৷ অথচ সে কথা তো শোনার কথা ছিল শুধুমাত্র দখিনাহাওয়ার৷ চোখে নেশা লাগলে যে পথ  ভুলতে হয়, সে পথ যে বাজারি অর্থনীতির চোরাগলিতে লেংচে বেড়াবে, এমন কথা স্বয়ং ভ্যালেন্টাইন সাহেবও নিশ্চয়ই কল্পনা করেননি৷

তবুও প্রেম..
তবু কেউ কেউ বলেন, ভ্যালেন্টাইন্স গোলাপে নাকি কাঁটা থাকে না৷ তা ঠিক না ভুল সে না হয় খুঁজে দেখার বিষয়৷ তবে প্রেমিকহৃদয় কবে আর কাঁটার তোয়াক্কা করেছে! আসলে সময়টাই যা বদলেছে৷ বদলে গেছে সেলিব্রেশনের ধরনও৷ আজ প্রেমিক-প্রেমিকের মুশকিল আসান করে খবরের কাগজ থেকে রেডিও চ্যানেল সবাই উপহারের পরামর্শ দেয়৷ বলে দাও হে পেনডেন্ট, দাও হে প্রেমের গ্রাফিটি দেওয়া কুশন৷ কিন্তু সত্যি কি আর তাতে মুশকিল আসান হয়৷ ভালোবাসা যে হৃদয়ে বাসা বাঁধে তার সবথেকে মুশকিল এই যে, সে সবথেকে বেশি ভালোবাসে ভালোবাসাকেই৷ সে তো অন্তরের গহীন প্রদেশ৷ বাজারের উপহার তার ধারকাছ দিয়ে বহুবার ঘুরে গেছে, কিন্তু ছুঁতে পারেনি৷ আর ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেই, যে ছিল অন্তরে সে বের হয়ে আসে৷ আসনপিঁড়ি পেতে দেয় প্রেমের জন্যে, আর মনে মনে বলে ওঠে, ‘অতল তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারেনি বলে, হৃদি ভেসে গেছে অলকানন্দ জলে’৷ আজ ‘ভালোবাসা মানে আর্চিজ গ্যালারি’ হয়ে যায় চোখের আলোয়, কিন্তু অন্তরে আজও দেখলে চোখে পড়বে টলটল করছে একদিঘী জল৷ সেই আঁজলা ভরা জলেই আজও চোখ ধুয়ে নেয় প্রেমিক-প্রেমিকরা৷ একজন বলে, ‘… পাগলি তোমার সঙ্গে ধুলোঝড় জীবন কাটাবো.. পাগলি তোমার সঙ্গে ভোর ভায়োঁ কাটাব জীবন৷’ আর একজন বলে, ‘.. হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্ট্যাল মিঠে কুয়াশায় ভেজা আস্তিন..আমি ভুলে যাই কাকে চাইতাম, আর তুই কাকে ভালোবাসতি..৷’ আর তখনই চিলেকোঠার পাশে বেজে ওঠে একতারা৷ ঠিক সন্ধ্যা নামার মুখে কে যেন কার নাম ধরে ডেকে ওঠে আজও, আর মনখারাপের রাতে চোখে ঘুম হয়ে নেমে আসে এক রাতজাগা তারা৷

প্রেম শুধু এক মোমবাতি, আমাদের শুনিয়ে গিয়েছিলেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনের রঙ যে বদলে দিতে পারে রাতারাতি৷ আজও সে তা পারে৷ এই যে দলে দলে যুগল আজ ভালোবাসার শপথে হাতের উপর হাত রাখার প্রতিশ্রুতি নিয়ে কাছে আসছে তাদেরও জীবনের রঙ যে রাতরাতি বদলে দিতে পারে প্রেম৷এখনও, এই বাজার অর্থনীতি ইত্যাদি প্যারামিটার সঙ্গে নিয়েই৷ তাই ‘বেশ করেছি প্রেম করেছি’-জমানাটাই যা বদলে যায়, প্রেম বদলায় না?

প্রেম কি একদিনের জন্য হয় নাকি? কক্ষণও নয়৷ সেদিনও ছিল না৷ আজও নয়৷ তবে এমন ঘটা করে উদযাপন কেন? আহা, স্বাধীনতাও কি একদিনের নাকি? তবু একটা দিন তো স্বাধীনতার নামে বরাদ্দ থাকে৷ সেরকমই একটা দিন যদি প্রেমের নামে তোলা থাকে ক্ষতি কী! একদিন যদি সবাই বলে উঠতে পারে ‘বিদ্রোহ আর চুমুর  দিব্যি শুধু তোমাকে চাই’ তবে মন্দ কী! না হয় শহুরে লাভস্পটই হলো, না হয় হাতে একটা গিফট নিয়েই কেউ দাঁড়াল, তবু যদি প্রেমহীন দাঁত-নখ বের করা সময়ে দাঁড়িয়ে কেউ বলে ওঠে ‘এ জীবন ভালোবেসে তোমাকে চাই’.. তবে জীবনই তো কিশলয়ে ভরে ওঠে৷ প্রতি প্রেমের উচ্চারণে কোথাও না কোথাও যদি ফুটে ওঠে পলাশ, তবে পৃথিবীটাই তো রঙিন হয়ে উঠতে পারে৷ তাই শ্যাওলা যতটুকু জমে আছে সময়ের ধর্মে তা হয়তো অস্বীকার করা যায় না, তবু শ্যাওলা সরালে যে প্রেমটুকু চোখে পড়ে তাকে স্বীকার না করে কীইবা লাভ আছে! চোখের তারায় যে আয়না ধরে, যার আদরে কান্না আসে, যার জন্য সব দাবি-দাওয়া, অমরত্বের প্রত্যাশাও তুচ্ছ হয়ে যায়, সেই প্রেমের জন্য একটা দিন যদি তোলা থাকে, থাকুক৷ প্রেম তো চিরকালই জেনে এসেছে, এখনও জানে, ভ্রূপল্লবে ডাক দিলে দেখা ঠিক হবেই, চন্দনের বনে৷