দিল্লির জওহরলাল নেহরু ভবনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে ঝাঁ-চকচকে ও সুদৃশ্য নতুন ভবনটি হয়েছে, সেখানে এটা এখন বেশ পরিচিত দৃশ্য- বাংলাদেশে যখনই কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সহিংসতা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, সাংবাদিকরা অবধারিতভাবে মিডিয়া ব্রিফিংয়ে জানতে চান, এ ব্যাপারে ভারতের প্রতিক্রিয়া কী? আর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দীন প্রায় মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মুচকি হেসে জবাব দেন, ‘আপনারা তো জানেনই, প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানো ভারতের স্বভাব নয়! বাংলাদেশের ভবিতব্য সে দেশের মানুষকেই স্থির করতে হবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি …।
আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং শেষে সবাই যখন চা বা পাকোড়া নিয়ে গল্পে মশগুল, তখন সেই আকবরউদ্দীনই এগিয়ে এসে হেসে বলেন, ‘কেন অযথা এ প্রশ্নটা করেন– জানেনই তো কী উত্তর পাবেন!’
এই মুখবন্ধটা করতে হলো কারণ প্রায় গত এক মাস ধরে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক অবরোধ, সহিংসতা আর স্থবিরতা চলছে তাতে দিল্লিও কিন্তু এখন কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ না ফেলে বসে থাকতে পারছে না। এমনকী, সরকারিভাবেও।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, ঢাকার বন্ধুপ্রতিম সরকারকে তারা সম্প্রতি আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন বিএনপি বা জামায়াতকে রাস্তায় নেমে এভাবে অবরোধ আর সহিংসতা কিছুতেই চালাতে দেওয়া যায় না। এতে শুধু বাংলাদেশের উন্নয়ন বা প্রগতিই থমকে নেই ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতাও প্রশ্নের মুখে পড়ছে। কাজেই বিএনপিকে কোনও না কোনওভাবে ‘এনগেজ’ করতেই হবে, যাতে রাস্তার অন্দোলন থেকে তাদের সরিয়ে আনা যায়!
এখন এই ‘এনগেজ’ করার নানা ব্যাখ্যা হতে পারে। ভারতের কর্মকর্তারা বলছেন, এনগেজ করা মানেই যে এখুনি বাংলাদেশের দুই নেত্রীকে রাজনৈতিক সংলাপে বসতে হবে তা নয়। এমনকি, গত বছরের যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ভারত বলিষ্ঠভাবে সমর্থন করেছিল তার বদলে নতুন করে নির্বাচনের দাবিকেও তারা সমর্থন করছে না। কিন্তু উন্নয়নের স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থে বিএনপি-জামাতকে রাজপথের অরাজকতা থেকে সরিয়ে আনা ছাড়া কোনও উপায় নেই। কিন্তু তার রাস্তাটা কী হবে সেটা ঠিক করতে হবে শেখ হাসিনা সরকারকেই!
এখন এই বার্তাটা দেওয়া হয়েছে কীভাবে?
দিনকয়েক আগে বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ দিল্লিতে এসে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে গেছেন। তা নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে কিছু লেখালেখি হয়েছে। তোফায়েল শেখ হাসিনার বার্তা নিয়ে এসেছিলেন, এমনটাও দাবি করেছেন কেউ কেউ।
তবে আসল ঘটনা হলো, সেই বৈঠকের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দিল্লিতে এইচ টি ইমামের সাক্ষাৎ। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টাকে সেই বৈঠকে মোদি সরাসরি বলেছেন, ‘এভাবে দিনের পর দিন চলতে পারে না, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য কিছু একটা উপায় আপনাদেরই বের করতে হবে।’
এইচ টি ইমাম দিল্লিতে এসেছিলেন এই শহরের খ্যাতনামা থিঙ্কট্যাঙ্ক ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্সে ‘সপ্রু হাউস’ স্মারক বক্তৃতা দিতে। ১৬ জানুয়ারির সেই ভাষণে তিনি যেমন বাংলাদেশের যে কোনও সঙ্কটে ভারতের আন্তরিক সাহায্যের কথা উল্লেখ করেছেন, তেমনি বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের সূত্র ধরে এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কটা আসলে ‘ঘাম আর রক্তের’! কিন্তু ওই সফরেই ভারতের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকরা তাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন ঘাম-রক্তের চেয়েও বেশি দামি হল অর্থনীতির সম্পর্ক। সেই সম্পর্ককে বলি দিলে দুদেশই নিজেদের পায়ে কুড়াল মারবে।
এইচ টি ইমাম, গওহর রিজভি আর মশিউর রহমান– যথাক্রমে রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি আর অর্থনীতি বিষয়ক এই তিন উপদেষ্টা হলেন দিল্লির ব্যাপারে শেখ হাসিনার চোখ-কান। এরা তিনজন এত ঘন ঘন ভারতে আসেন যে সাংবাদিকরাও তার খেই রাখতে হিমশিম খেয়ে যান। তাদের অনেক সফরই গোপন রাখা হয়, এমনকী তাদের কেউ কেউ সকালে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে এসে বিকেলে জেট এয়ারওয়েজে ঢাকায় ফিরে গেছেন, এমনও নজির আছে। মনমোহন সিংয়ের ইউপিএ আমল থেকেই এই রেওয়াজ চলে আসছে। আর আট মাস আগে বিজেপি সরকার দিল্লির ক্ষমতায় আসার পরও সেই রুটিনের কোনো ব্যতিক্রম হয়নি।
তবু এই ত্রয়ী যে দিল্লিতে তাদের বন্ধুদের গলায় ইদানীং কিছুটা বেসুরো আওয়াজ শুনছেন না তাও কিন্তু নয়। শেখ হাসিনার প্রতি ভয়ে হোক বা ভক্তিতে, ভারতের বিগত ইউপিএ সরকার বিএনপি-র সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সব ধরনের সম্পর্ক মোটামুটি শিকেয় তুলে দিয়েছিল। কিন্তু এখন ক্ষমতাসীন বিজেপির একটা অংশ বিশ্বাস করে সেটা কোনও কাজের কথা নয়– বিএনপির প্রতিও বাংলাদেশে রীতিমতো ‘পপুলার সাপোর্ট’ আছে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, দুই দেশের অনেক অমীমাংসিত সমস্যা হয়তো বিজেপি আর বিএনপির মতো দুটো দক্ষিণপন্থী দল ক্ষমতায় থাকলে তবেই সমাধান করা সম্ভব। আওয়ামী লীগ সেটা কোনওদিনও করে উঠতে পারবে না।
এমনকী, বারাক ওবামার সদ্যসমাপ্ত ভারত সফরেও যখন দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে দিল্লি আর ওয়াশিংটনের আলোচনা হয়েছে, তখন ভারত মার্কিন প্রেসিডেন্টকে পরিষ্কার করে দিয়েছে, নেপাল হোক বা শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ, তারা ‘ইনক্লুসিভ’ কূটনীতিরই পক্ষপাতী। অর্থাৎ এই প্রতিবেশী দেশগুলোতে কোনও একটি দল বা গোষ্ঠীকে ভারতীয় লবির বলে চিহ্নিত করা হবে, নরেন্দ্র মোদি সেই রেওয়াজ বন্ধ করতে চান বলেই মিস্টার ওবামাকে ব্রিফ করা হয়েছে।
এর মানে অবশ্যই এই নয় যে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ভারত তাদের বন্ধুত্বে এতটুকুও ফাটল ধরাতে চায়। ভারতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ-মিয়ানমার ডেস্কের এক কর্মকর্তার কথায়, ‘বরং উল্টোটাই; আমরা চাই সেই বন্ধুত্ব আরও নতুন উচ্চতায় উঠুক। কিন্তু পেট্রোল বোমা আর ককটেলের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা আর কী করে নিবিড় হবে বলুন? সেই জন্যই আমরা বিএনপি-কে আগে শান্ত করার উপায় খুঁজতে বলছি!’
এইচ টি ইমাম তার এবারের দিল্লি সফরে ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার টিভি চ্যানেলে একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি খুব ইন্টারেস্টিং একটা কথা বলেন, যে নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনার মধ্যে মাত্র কয়েক মাস আগেও এতটুকু পরিচয় ছিল না, কয়েক দফা টেলিফোন আলাপ আর নিউইয়র্কে দীর্ঘ বৈঠকের পর না কি ‘তাদের মধ্যে রিলেশনটা দারুণ ক্লিক করে গেছে!’
এখন বাংলাদেশের পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক করে তোলার জন্য শেখ হাসিনার কোনও একটা উপায়ও ‘ক্লিক’ করে যাক, কায়মনোবাক্যে দিল্লিও ঠিক সেটাই চাইছে!- বাংলা ট্রিবিউন