ডাক্তার-প্রকৌশলীর পেশা বদল

SHARE

সম্প্রতি ৩৮তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে ২৪টি ক্যাডারে দুই হাজার ২০৪ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। এর মধ্যে পররাষ্ট্র ক্যাডারে যে ২৫ জন প্রার্থীকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে সাতজনই বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করেছেন। আর ১৩ জন পাস করেছেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তাঁদের ১০ জনই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ছিলেন। অন্যদের মধ্যে একজন রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট), একজন খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) এবং আরেকজন অন্য একটি প্রকৌশল শিক্ষার প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করেছেন।

এই বিসিএসে শুধু পররাষ্ট্র ক্যাডারেই নয়, প্রশাসন, পুলিশসহ আরো কিছু ক্যাডারেও ডাক্তার-প্রকৌশলীর আধিক্য দেখা গেছে। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা অর্ধশতাধিক ডাক্তার এবং বুয়েটসহ বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা প্রায় ১২০ জন প্রকৌশলী নিয়োগ পাচ্ছেন। অর্থাৎ বিশেষায়িত বিষয়ে পড়ালেখা করে চাকরি করতে চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়।

ডাক্তার-প্রকৌশলীই শুধু নন, কৃষিবিদরাও পেশা বদল করছেন। ৩৮তম বিসিএসে শুধু শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা তিনজন কৃষিবিদ প্রশাসন ক্যাডারের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।

প্রসঙ্গত, ৩৮তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় পাস করেন ৯ হাজার ৮৬২ জন। লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ১৪ হাজার ৫৪৬ জন। গত ৩০ জুন চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করে সাধারণ ক্যাডারে ৬১৩, সহকারী সার্জন ২২০, ডেন্টাল সার্জন ৭১, বিভিন্ন টেকনিক্যাল ক্যাডারে ৫৩২ এবং শিক্ষায় ৭৬৮ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি।

চিকিৎসা-প্রকৌশলসহ বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে নিজ পেশায় না গিয়ে বিসিএস দিয়ে পেশা বদল নতুন নয়। তবে আগে এই সংখ্যা ছিল খুবই কম। কিন্তু ৩৫তম বিসিএস থেকে বিশেষায়িতদের, বিশেষ করে ডাক্তার-প্রকৌশলীদের পেশা বদল ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। যেসব ক্যাডারে ক্ষমতা, সম্মান ও আর্থিক সুবিধা বেশি সেসব ক্যাডারে তাঁদের যোগদান ক্রমেই বাড়ছে। অবশ্য ওই বিসিএসে কতজন ডাক্তার-প্রকৌশলী অন্য পেশায় চলে গেছেন সে তথ্য জানা যায়নি।

তবে অসমর্থিত বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, বিশেষায়িত বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারীদের বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে অন্য পেশায় চলে যাওয়ার হার বাড়ছে; যদিও এই ধরনের পরিসংখ্যান তৈরি করে না পিএসসি।

বিসিএস করা বিভিন্ন পেশাজীবী গ্রুপের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ৩৬তম বিসিএসে দুই হাজার ৩২৩ প্রার্থীকে ক্যাডার পদের জন্য সুপারিশ করে পিএসসি। এর মধ্যে শতাধিক ডাক্তার, প্রকৌশলী ও কৃষিবিদ নিজ পেশায় না গিয়ে প্রশাসন, পররাষ্ট্র বা পুলিশ ক্যাডারে যোগদান করেছেন। শতাংশের হিসাবে তা প্রায় ৪.৩০। ৩৭তম বিসিএসে এক হাজার ৩১৪ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়, যাঁদের মধ্যে বিশেষায়িত শিক্ষাগ্রহণকারী প্রায় ৮০ জন অন্য ক্যাডারে সুপারিশ পেয়েছেন, যা মোট সুপারিশপ্রাপ্তের প্রায় ৬.০৮ শতাংশ। আর সর্বশেষ ৩৮তম বিসিএসে দুই হাজার ২০৪ জন প্রার্থীকে ক্যাডার পদের জন্য সুপারিশ করে পিএসসি। সাধারণ ক্যাডারের ৬১৩ জনের মধ্যে প্রায় ১৭০ জন ডাক্তার-প্রকৌশলী-কৃষিবিদসহ বিশেষায়িত প্রার্থী। মোট ক্যাডার পদের হিসাবে এই হার প্রায় ৭.৭১ শতাংশ।

সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার যোগ্যতা হচ্ছে গ্র্যাজুয়েশন (স্নাতক) থাকতে হবে। এখন সে মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যাগ্রিকালচার, বাংলা না ইতিহাসের গ্র্যাজুয়েট, সেটা আমাদের বিবেচ্য বিষয় না। পরীক্ষার ক্ষেত্রে তার মেধাই হচ্ছে বড় যোগ্যতা। এখন যদি কোনো ডাক্তার প্রশাসন পছন্দ করে সুযোগ পায়, তাহলে তাকে তো আমাদের প্রশাসনই দিতে হবে। ক্যাডারে দেওয়া হয় একজন প্রার্থীর রেজাল্ট ও তার পছন্দ অনুসারে।’

প্রশাসন ক্যাডারে সুযোগ পাওয়া বুয়েট থেকে পাস করা একজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রশাসন ক্যাডারে চাকরির মূল্য, সম্মান ইঞ্জিনিয়ারদের চেয়ে অনেক বেশি। সে জন্যই বেশ আগে থেকেই আমি বিসিএসের পড়ালেখা শুরু করেছিলাম। যদি পছন্দের ক্যাডারে সুযোগ না পেতাম, তাহলে হয়তো ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায়ই যেতাম।’

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সূত্র জানায়, একটি সাধারণ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একজন শিক্ষার্থীর পেছনে রাষ্ট্র অনেক বেশি ব্যয় করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলে পাঁচ বছরের কোর্স। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় করেছিল তিন লাখ ৮০ হাজার টাকা। অন্যদিকে বুয়েটের ব্যয় ছিল দুই লাখ ৩২ হাজার টাকা। আর ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় ছিল যথাক্রমে এক লাখ ৮০ হাজার ও এক লাখ ২০ হাজার টাকা।

সরকারি ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে জানা গেছে, দেশে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাঁচ বছরের এমবিবিএস ডিগ্রি নিতে একজন শিক্ষার্থীর ব্যয় হয় ১৮ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা। সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীপিছু রাষ্ট্রের ব্যয় ১৫ লাখ টাকার মতো।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত বছরের হিসাব অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর দেশে এক লাখের বেশি চিকিৎসক নিবন্ধন নিয়েছেন। সরাসরি চিকিৎসা পেশায় যুক্ত চিকিৎসকের সংখ্যা সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার। কিন্তু দেশের জনসংখ্যা ও রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় কমপক্ষে দুই লাখ চিকিৎসক প্রয়োজন।

সূত্র জানায়, প্রশাসন ক্যাডারে যাঁরা চাকরি পান তাঁদের মাঠ পর্যায়ে প্রথম পদায়ন হয় সহকারী কমিশনার হিসেবে। সেখানে তাঁদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকে। চাকরি নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁরা পদোন্নতি পান জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার হিসেবে। এই পদে থেকেই অনেকে দায়িত্ব পান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে। আর প্রশাসন ক্যাডারে যাঁরা সচিবালয়ে পদায়ন পান, তাঁদের প্রথম পদ সহকারী সচিব এবং এর পরের পদ জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব। মাঠ পর্যায় বা সচিবালয়ের সবাই পরবর্তী পদোন্নতি পান উপসচিব হিসেবে। এরপর তাঁরা পদোন্নতি পেতেই থাকেন। চাকরির শুরু থেকে তাঁরা গাড়িসহ নানা ধরনের সুবিধা পান। উপসচিব হলে সরকার থেকে গাড়ি কেনা ও রক্ষণাবেক্ষণের টাকাও দেওয়া হয়।

অন্যদিকে বিসিএস উত্তীর্ণ ডাক্তাররা প্রথম যোগ দেন সহকারী সার্জন বা জুনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে। এ ছাড়া মাঠ পর্যায়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে তাঁদের প্রথম পদায়ন হয়। এর পরের পদে পদোন্নতি পাওয়া তাঁদের জন্য সহজ নয়। যাঁরা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করতে পারেন তাঁদের সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপকসহ চিকিৎসা প্রশাসনেও পদায়ন হয়ে থাকে। মাঠ পর্যায়ে চাকরির পাশাপাশি স্নাতকোত্তর কোর্স শেষ করতে অনেকেরই আট-দশ বছর সময় লেগে যায়। ডাক্তাররা যাঁরা স্নাতকোত্তর করতে পারেন না তাঁদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল বা সিভিল সার্জন অফিসেই চাকরি শেষ করতে হয়। মেডিক্যাল অফিসার পদে ২০ থেকে ২৫ বছর চাকরি করার পর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচঅ্যান্ডএফপিও) হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া যায়। অন্যদিকে সাত-আট বছরেই প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা ইউএনও হিসেবে পদোন্নতি পান। ইউএনওর অধীনেই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে নানা সভায় অংশ নিতে হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশে চিকিত্কদের জন্য একটি বড় সমস্যা, খুব কম মানুষকেই সন্তুষ্ট করা যায়। একজন শিক্ষার্থী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার পরই হেলথ সার্ভিস নিয়ে সমালোচনা, অসন্তুষ্টি বা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির কথা জানতে পারে। তখন থেকেই তার মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। এরপর স্বপ্নভঙ্গ নিয়েই সে ডাক্তার হয়।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের চিকিৎসকদের সুরক্ষা নেই। সুযোগ-সুবিধা, কাজের পরিবেশ ও সামাজিক মর্যাদার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে সে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে।’

ডা. কামরুলের ভাষ্য, বর্তমানে ৪০ হাজার ডাক্তারের তেমন কোনো চাকরি নেই। বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতেও ডাক্তারদের সুবিধা খুবই কম।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যারা সবচেয়ে মেধাবী তারা চিকিৎসাশাস্ত্রে বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়। তাই বিসিএস পরীক্ষায়ও যে তারা ভালো করবে, এটাই স্বাভাবিক। একজন ভালো অর্থনীতিবিদ বিসিএস দিয়ে প্রশাসনে যে চাকরি পাবেন, সেখানে তাঁর সেই বিদ্যার প্রয়োগ ঘটানোর সুযোগ কম। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, অর্থনীতিবিদ তৈরির জন্য আমাদের দেশ কিন্তু একজন শিক্ষার্থীর পেছনে অনেক অর্থ ব্যয় করছে। এরপর সে যদি তার জ্ঞান স্বক্ষেত্রে কাজে না লাগায়, তবে তা দুর্ভাগ্যজনক।’

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আসলে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থান কোথায় হবে সেই পরিকল্পনা নেই। এ জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। আউটকাম বেজড কোর্স কারিকুলাম দরকার। শিক্ষার্থীদেরও তাদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা সঠিক স্থানে কাজে লাগানো উচিত।’